বোলজানো থেকে জুরিখ
শেয়ার করুন
ফলো করুন
বিজ্ঞাপন

প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ আমার পরিকল্পনা শোনার পর আমাকে পাগল বলে আখ্যায়িত করেছেন; যদিও আমার মনে যে গান বাজে—‘পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না’, তাঁরা তা শুনতে পান না। আমিও মিটিমিটি হাসি আর তাঁদের চোখে আবছা শঙ্কা দেখতে পাই।
এক সপ্তাহের পরিকল্পনা। শুরুর দিকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছি নিজেকে যে এপ্রিল মাসে এই অভিযান কতটা বাস্তবসম্মত? শীত তো এখনো পুরোপুরি কাটেনি। হাইওয়েতে বাতাসের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে। আমার বাইকটা একটা নেকেড বাইক, উইন্ডশিল্ড নেই। ১৩০ কিলোমিটারের বেশি ঠান্ডা বাতাস অস্বস্তিকর হবে।

হেলমেট এ সেনার হেডফোন লাগিয়ে নেয়া হয়
হেলমেট এ সেনার হেডফোন লাগিয়ে নেয়া হয়
ছবি: লেখক

কিন্তু এত কিছু চিন্তা করলে যে আর যাওয়া যাবে না। অভিপ্রায় থেকে যেন না সরে আসি, তার জন্য প্রথম পদক্ষেপ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তাই তো নতুন দুটা চাকার অর্ডার দিই। আর দীর্ঘ পথে গান শোনার জন্য হেলমেটে হেডফোন লাগাই। জিনিসপত্র বহন করার জন্য একটা ৩০ লিটারের ওয়াটারপ্রুফ ব্যাগ আর কর্ডও কিনি। হাইওয়েতে কানে বাতাস আর শব্দ প্রতিরোধের জন্য দুটো এয়ার প্লাগও কিনে নিই। বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য উইন্ডপ্রুফ রেইনকোট আগেই ছিল। পুরো সপ্তাহ অফিসে ব্যস্ততায় কাটে। ভবিষ্যতের দরকারি কিছু কাজ ঘনিষ্ঠ কিছু সহকর্মীকে বুঝিয়ে দিই।

বিজ্ঞাপন

শুক্রবার সারা রাত ঠিক করে ঘুম হয়নি। উত্তেজনায় বিছানায় এদিক–ওদিক করেই রাত কেটেছে। আকাশে হালকা আলোর ছটা দেখেই বিছানা থেকে নেমে শেষবার তদারক করে নিই, সব ঠিকঠাক আছে কি না।

সব গোছগাছ শেষে ভাবি, এ পথ কখনোই কোনো বাংলাদেশি দুই চাকায় পাড়ি দেননি। অন্তত আমার জানামতে। এই ভাবনায় মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে যায়। আরও খুশি লাগে যে আমার এই অভিযান অনেক ভ্রমণপিপাসু দেশি বাইকারকে ইউরোপের ঐতিহাসিক সুন্দর পথগুলো জয় করতে উদ্বুদ্ধ করবে।

শনিবার সকাল সাড়ে সাতটায় বাসার নিচে আমার মেয়ে, ছেলে, মা, স্ত্রী আমাকে বিদায় দেন। আমিও প্রথমবার আমার ডুকাটি মনস্টার ৮২১-এর সাড়ে ১৪ লিটার ট্যাংক পূর্ণ করে সুইজারল্যান্ডের উদ্দেশে রওনা দিই।

আমি থাকি ইতালির বোলজানোতে। এখান থেকে সুইজারল্যান্ড সীমান্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে। আমি গুগল ম্যাপে হাইওয়ে ছাড়ার অপশন চালু করে রেখেছিলাম। তাতে সময় বেশি লাগলেও নৈসর্গিক সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ি রাস্তা, বিপজ্জনক সুন্দর নিচের খাদ আর মাঝেমধ্যে আশপাশে লুকিয়ে থাকা কিছু নীল লেক দেখা হয়ে যাবে। থেমে থেমে কিছু ছবিও তোলা যাবে।

সকালবেলা বোলজানো থেকে যাত্রা শুরু।  উদ্দেশ্য জুরিখ
সকালবেলা বোলজানো থেকে যাত্রা শুরু। উদ্দেশ্য জুরিখ
ছবি: লেখক

রাস্তায় বেশ কিছু বাইকারের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। ইশারায় তাঁদের অভিবাদন জানাতে বেশ ভালো লাগে। মনে হয়, আমরা সবাই যে যেখান থেকেই আসি না কেন, সবাই এক গোত্রের।

দুই ঘণ্টার মধ্যেই বর্ডারে পৌঁছে যাই।

এই সুইস বর্ডার পুলিশের কিংবদন্তি আমার ইতালিয়ান বন্ধুদের কাছে অনেক শুনেছি। তাঁরা নাকি বেশ কট্টরপন্থী বিদেশি বাইকারদের প্রতি। হেডলাইট থেকে শুরু করে থ্রটল, টেইল লাইট সব অরিজিনাল থাকতে হবে, এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশ কম হলে তাঁরা বাহন কবজাও করে ফেলতে পারে। এসব ছিল শোনা কথা।

সুইজারল্যান্ড সীমান্দের প্রবেশপথ
সুইজারল্যান্ড সীমান্দের প্রবেশপথ
ছবি: লেখক

সুইজারল্যান্ড ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বাইরে। তাই আমি পাসপোর্ট নিয়ে ভ্রমণ করছিলাম। বর্ডারে পৌঁছানোমাত্রই দুই পুলিশ অফিসার আমার বাইক সাইড করতে বলেন। কোথা থেকে এসেছি আর কোথায় যাব—এসব জিজ্ঞেস করতে থাকেন। আমি জানাই, লন্ডনে যাচ্ছি। এটা শুনে অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সী অফিসারের মুখে হাসি লক্ষ করি।

বাইক থামানোর সংকেত
বাইক থামানোর সংকেত
ছবি: লেখক

এক অফিসার আমার কাগজপত্র পরীক্ষা করতে লাগলেন। আর অল্পবয়সী অফিসারটি আমার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলেন। জানালেন মোটরসাইকেলের প্রতি তাঁর ভালোবাসা। তিনি নিজেও একটি কাওয়াসাকি নিনজা ৬৫০ বাইক চালান। আমার ডুকাটির প্রশংসা করে বললেন, সুইজারল্যান্ডে ডুকাটিকে ফেরারি বলেন তাঁরা। দশ মিনিটের মধ্যেই বর্ডার ক্রস করলাম, কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই। আশ্চর্যজনকভাবে আমার বাইকের কোনো পার্টসই তাঁরা পরীক্ষা করে দেখেননি। তাই সব সময় শোনা কথায় কান দিতে নেই।

বর্ডার থেকে বের হচ্ছি, এমন সময় ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেল। আমার মনেই ছিল না যে সুইজারল্যান্ড ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বাইরে। তাই রোমিং বন্ধ হয়ে যাবে বর্ডার থেকে বের হওয়ামাত্রই। সুতরাং গুগল ম্যাপস কাজ করছে না। নেভিগেশন বন্ধ। একটি চৌরাস্তার মোড়ে এসে ভাবছি, ডানে–বামে যাব না সোজা যাব; পাহাড়ি এলাকা, কোথাও কেউ নেই। কিছুক্ষণ ভেবে ঠিক করি, যেভাবেই হোক, আগে জুরিখে যেতে হবে। তারপর কোনো হোটেলে গিয়ে দেখা যাবে, কীভাবে কী করা যায়।

শুরু হলো আমার জীবনে প্রথম সুইজারল্যান্ড ভ্রমণ। পাহাড়ি বাঁকা পথ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। বাঁকা পথ একটু বেশিই বাঁকা; সুতরাং সাবধানে এগোচ্ছি। জানি না কখন, কোথায় শেষ হবে। পরে জেনেছি, যে পথ দিয়ে গেছি, সেটার ইতালিয়ান নাম পাসো এল ফরনো (PASSO DEL FORNO) বা চুল্লির উপত্যকা।

এ যেন এক অন্য জগৎ। পাথরের এমন রং তো আগে কখনো দেখিনি। না দেখেছি পৃথিবীকে এত ওপর থেকে। পাশের পাহাড়গুলোর বরফ এখনো গলেনি। কনকনে বাতাস জ্যাকেট আর ভেতরের দুইটা জামা ভেদ করে হাড়ে গিয়ে বিঁধছে; কিন্তু শারীরিক যন্ত্রণা গ্রাহ্য করার মতো মানসিক অবস্থায় এখন আমি নেই। আমার ক্ষুধার্ত চোখ যে এদিকে সব সৌন্দর্য গিলে খাচ্ছে। তাই মাথায় মেঘ নিয়ে পাহাড়ের ওপর উঠতে শুরু করলাম।

অদ্ভুত সুন্দর পাহাড় দেখে থামি। বেশ ঠান্ডা লাগছিলো।  আশপাশের বরফ তখনো পুরো গলেনি
অদ্ভুত সুন্দর পাহাড় দেখে থামি। বেশ ঠান্ডা লাগছিলো। আশপাশের বরফ তখনো পুরো গলেনি
ছবি: লেখক

অদ্ভুত সুন্দর পাহাড়টাকে দেখে থামলাম। বেশ ঠান্ডা লাগছিল। আশপাশের বরফগুলো এখনো পুরোপুরি গলেনি।

কিছু দূর গিয়ে আমি একটা মনোরম সুন্দর পাহাড়ের দেখা পাই। ছবি তো তুলতেই হয়। সেখানেই একটি জার্মান ট্যুরিস্ট পরিবারের সঙ্গে দেখা হয়। তাদের কাছে জুরিখে যাওয়ার পথ জেনে নিই। তারা আমাকে লোকালয়ের রাস্তা ধরে ল্যান্ডকোয়ার্টের দিকে যাওয়ার পরামর্শ দেয়।

আমিও আবার সামনে অগ্রসর হতে থাকি। বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর ভেরেইনা টানেলের মুখে আসি। এখানে একটি শাটল ট্রেন আমাকে সাগলিয়ান্স এঙ্গাডিন থেকে ক্লোস্টার্স সেলফ্রানজায় নিয়ে যাবে; সেখান থেকে ল্যান্ডকোয়ার্ট প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে।

সাদা মেঘের পাহারায় পাহাড়
সাদা মেঘের পাহারায় পাহাড়
ছবি: লেখক

গ্রাউবেন্ডেনের ক্যান্টনের পূর্ব অংশে শীতের মাসগুলোয় ভারী তুষারপাত হয় আর পরিবহন যোগাযোগে তা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। টানেলটি নির্মাণ করায় যান পরিবহনে অনেক সুবিধা হয়েছে। ১৯৯৯ সালে এটি যান চলাচলের জন্য এটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ৩০ মিনিট পরপর শাটল ট্রেনটি ছেড়ে যায়।

শাটল ট্রেন ভেরাইনা
শাটল ট্রেন ভেরাইনা
ছবি: লেখক

যখন ভাবছি বেশ অনেকক্ষণ জিরিয়ে নেওয়া যাবে, তখনই ট্রেন ছাড়ল। অন্ধকার টানেল, খোলা ট্রেন, ঠান্ডা বাতাস আর ভৌতিক শব্দ; বিশ্রাম তো দূরের কথা, বাইকটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বাতাস, শব্দ আর ঝাঁকুনি সামলাচ্ছি। মাথায় আসছে, কী দরকার ছিল? প্লেনের টিকিট কেন কাটলাম না? অন্তত আম্মার কথা শুনে গাড়ি নিয়েও তো আসতে পারতাম। সামনের–পেছনের গাড়িগুলোর মানুষেরা ভেতরে কী আরামে বসে আছে আর আমি বাইরে এই কনকনে ঠান্ডার মধ্যে এসব কী করছি?

কিছুক্ষণ পর যেন একটু তন্দ্রা এল, মাথা নিচু করে দুশ্চিন্তা ঝেঁটিয়ে বিদায় করি। মনকে শক্ত করে ভাবতে থাকি, অভিযান তো কঠিন হবেই, সহজ হলে তো সবাই করত, দুনিয়ার ইতিহাস তো পাগলরাই লিখছে আর লিখবে। সামান্য ৩০ মিনিটের অস্বস্তিতে নিজের সিদ্ধান্তকে কেন ভুল মনে করছি? আমি বের হয়েছি, শেষ দেখেই ছাড়ব।

জুরিখের পথে
জুরিখের পথে
ছবি: লেখক

ক্লোস্টার্স সেলফ্রানজায় পৌঁছে ১০ মিনিটের বিরতি নিয়ে পানি খাই। তারপর হালকা স্ট্রেচিং করে ল্যান্ডকোয়ার্টের দিকে রওনা দিই। কোনো বিরতি ছাড়াই ল্যান্ডকোয়ার্টে এসে পৌঁছাই। একটি পেট্রলপাম্প থেকে তেল নিয়ে এবার জুরিখের পথে রওনা দিই। মেঘ সরিয়ে সূর্য উঠেছে। ঠান্ডাও অনেকটা কমেছে। মাত্র ১০৫ কিলোমিটার পরই জুরিখ। মনটা খুশিতে ভরে ওঠে। তাই রাইডটা আবার উপভোগ করা যাবে। আস্তে আস্তে জুরিখের দিকে যাচ্ছি। অন্তত সুইজারল্যান্ডে আমি কোনো জরিমানা দিতে চাই না। কারণ, প্রায় সব জায়গায় স্পিড ক্যামেরা লাগানো।

মনোরম জুরিখ লেক
মনোরম জুরিখ লেক
ছবি: লেখক

জুরিখের পথেই মনোরম জুরিখ লেক চোখে পড়ল। চোখে পড়ল বিখ্যাত ‘সোনার উপকূল’। এটা হ্রদের উত্তর দিকে। এই উপকূল আপনাকে জোলিকন থেকে ফেল্ডমেইলেন পর্যন্ত নিয়ে যাবে। এই রৌদ্রস্নাত অঞ্চলে করের হার তুলনামূলক কম। তাই ইউরোপিয়ান ও মার্কিন বিত্তবানেরা দামি বাড়ি কিনতে বেশ বিনিয়োগ করেছেন। হ্রদের উপকূলে আপনি সমাজের বিত্তবান লোকদের দুর্দান্ত সব বাড়ি, ইয়ট এবং ভিলা দেখতে পাবেন।

লেকে কিছু ছবি তুলে আবার জুরিখের পথ ধরি। বিকেলের হালকা রোদ গায়ে মেখে পৌঁছে যাই জুরিখে। আমার প্রথম গন্তব্য।
(চলবে)

লেখক: মাস্টার্স দ্বিতীয় বর্ষ, ফ্যাকাল্টি অব ইকোনমিক্স, ইউনিভার্সিটি অব বোলজানো, ইতালি

প্রকাশ: ২৮ মে ২০২২, ০৫: ০০
বিজ্ঞাপন