বর্তমানের ব্যস্ত নগরজীবনে স্বস্তির জায়গা খুব কম। ছুটির দিনগুলোয় বিনোদনকেন্দ্র আর রেস্টুরেন্ট-ক্যাফেগুলো হয়ে থাকে লোকে লোকারণ্য। ঘুরে বেড়ানোর জায়গা নেই বললেই চলে। তাই তো এই একঘেঁয়েমি আর ক্লান্তি কাটাতে ভ্রমণপ্রেমী অনেকেই সুযোগ পেলেই ছুটে যান মেঘের কাছাকাছি সুউচ্চ পাহাড়ি স্থানে। অভিকর্ষের বিপরীতে আকাশের কাছে ছুটে যাওয়ার দুর্নিবার আকর্ষণ মানুষকে টানতে থাকে। পাহাড়ের চূড়া বেয়ে আঁকাবাঁকা পথে এভাবে হেঁটে যাওয়াকেই হাইকিং বলা যায়। কেবল অ্যাড্রিনালিন রাশ আর মানসিক প্রশান্তি নয়, হাইকিংয়ের রয়েছে অনেক উপকারিতা।
হাইকিং আপনার হদ্যন্ত্রের বা কার্ডিওভাস্কুলার সিস্টেমের জন্য উপকারী। এতে আপনার ক্যালরি পোড়ে আর পায়ের পেশি শক্তিশালী হয়। হাইকিংয়ে কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পায়, সেই সঙ্গে বাড়ে জীবনীশক্তি।
নিয়মিত যাঁরা হাইকিং করেন, তাঁদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বেশি থাকে। ন্যাশনাল হার্ট, লাং অ্যান্ড ব্লাড ইনস্টিটিউটের মতে, হাইকিং রক্তচাপকে ৪ থেকে ১০ পয়েন্ট কমিয়ে দিতে পারে এবং যাঁদের উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি আছে, হাইকিং করলে সেই আশঙ্কাও কমে যায়।
হাইকিং হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমায়। হাঁটার সময় হৃৎস্পন্দন বৃদ্ধি পায়। ফলে হার্টের রক্তনালিতে জমা হওয়া চর্বি খরচ হয়। এতে করোনারি হৃদ্রোগের আশঙ্কা অনেকাংশে কমে যায়। যাঁদের উচ্চতার ভয় বা হাইট ফোবিয়া ও অ্যাক্রোফোবিয়া আছে, তাঁদের জন্য ডাউনহিল হাইকিং বা নিচের দিকে হাইকিং করা উপকারী। এটা রক্তের শর্করা কমিয়ে দেয় এবং গ্লুকোজের সহনশীলতা বাড়ায়।
সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোয় অক্সিডেটিভ স্ট্রেস ক্যানসারের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব স্পোর্টস মেডিসিন এক সাম্প্রতিক নিরীক্ষায় অক্সিডেটিভ স্ট্রেস ও হাইকিংয়ের মতো হাই অ্যান্ড ফিজিক্যাল অ্যাকটিভিটি বা উচ্চমাত্রার শারীরিক কসরতের সম্পর্ক নিয়ে ১২ জন স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত নারী ও ৬ জন প্রোস্টেট ক্যানসারে আক্রান্ত পুরুষের ওপর গবেষণা চালায়।
ফলাফলে দেখা যায়, দীর্ঘ দূরত্বের হাইকিং ট্রিপগুলো অনকোলজিক্যাল বা ক্যানসার আক্রান্ত রোগীদের অ্যান্টি–অক্সিডেটিভ মাত্রা উন্নত করেছে। তাই হাইকিং ক্যানসার নিরাময় করে কি না, সেটা স্পষ্ট বলা না গেলেও ক্যানসার প্রতিরোধ ও নিরাময়ের জন্য একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে হাইকিং। এটি মানসিক অবসাদ দূর করে এবং নিজের সম্পকে ইতিবাচক চিন্তা করার প্রবণতা বাড়ায়।
আরেকটি গবেষণায় দুই দল মানুষকে ভাগ করে একটি দলকে প্রকৃতির মাঝে হাঁটতে দেওয়া হয়, আরেক দলকে শহরের রাস্তায়। যাঁরা প্রকৃতির মাঝে হেঁটেছেন, মানসিক অবসাদের সঙ্গে সম্পর্কিত যেসব মস্তিষ্কের কার্যকলাপ ঘটে, সেগুলো কমে গিয়েছিল তাঁদের। মন ভালো রাখার হরমোন অ্যান্ডোরফিনও বেড়ে গিয়েছিল। আর শহরের রাস্তায় হাঁটা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে হয়েছিল উল্টো। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে করা এই গবেষণায় দেখা যায়, হাইকিংয়ের ফলে মস্তিষ্কে নতুন কোষ সৃষ্টি হয় এবং স্মৃতিশক্তি তীক্ষ্ণ হয়।
আমরা যাঁরা শহরে থাকি, সারা দিনের প্রচুর কাজের চাপ, ক্রমাগত কোলাহল এবং প্রযুক্তির প্রতি আসক্তি আমাদের সৃজনশীলতা কমিয়ে দেয়। প্রকৃতির মাঝে হাইকিং আমাদের মানসিক অবসাদ দূর করতে এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করে। একটু সময় বের করে হাইকিংয়ে গেলে তা আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক হতে পারে। এই অস্থির সময়ে দিতে পারে স্বস্তির আভাস।
তথ্য সূত্র: ওয়ান্ডার ইয়োগা, দ্য আলপাইনিস্ট-স্টানিং সোলোজ অন আইস অ্যান্ড রক, ভেরি ওয়েল ফিট।
ছবি: সালেহীন আরশাদী, বাবর আলী, ইকরামুল হক শাকিল (ট্রাভ্রেলার)