আমাদের কাছে আসার গল্প
শেয়ার করুন
ফলো করুন

ঘুটঘুটে অন্ধকার। কুমিল্লা হাইওয়ে ধরে ছুটছিলাম আমরা, সামনে খোলা হাইওয়ে, পাশ দিয়ে হাইস্পিডে বাসগুলো দমকা বাতাস দিয়ে আমাদের পাশ কাটিয়ে ছুটে যাচ্ছে সামনে। কিছুক্ষণ সেগুলোর লালবাতি চোখে পড়ে, তারপর একসময় গভীর অন্ধকারে হারিয়ে যায় সেই লাল আভা। আবার আমরা একা, ছুটে চলছি নিজেদের গতিতে, গন্তব্য ৪০০ কিমি দূরে।

পথের শেষ কোথায়!
পথের শেষ কোথায়!

বৃহষ্পতিবার রাতে বন্ধুরা সবাই কক্সবাজার যাচ্ছে। কক্সবাজারে এত বেশি গিয়েছি যে আমাদের দুজনের যাওয়ার কোনো ইচ্ছাই ছিল না। রাত সাড়ে ১০টায় মুভি দেখতে বসে রাহাত বলল, ‘চলো কক্সবাজারে যাই।’
আমিও বললাম, চলো।
ও আবারও বলল সিরিয়াসলিই যেতে চাও?
উত্তর দিলাম, হ্যাঁ চাই।
ব্যস, ধরো তক্তা মারো পেরেক। ব্যাগ প্যাক করে ফোন ফুলচার্জ করে বেরিয়ে পড়লাম। রাতে হাইওয়েতে আমাদের প্রথম ট্যুর।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে চমৎকার। হাইওয়ের একটি জাদু আছে, যতই ক্লান্ত থাকি না কেন, মোটরবাইকে ফুল সেফটি গার্ড নিয়ে চড়ে বসলে বাড়তি শক্তি চলে আসে। ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। হাইওয়ে, গতি, পথের দুপাশের নান্দনিক সবুজের অপার রূপ সব সময়ই আমাদের মুগ্ধ করে, কাছে টানে।

রাহাত ও ফাহমিদার যেন পায়ের নিচে সর্ষে
রাহাত ও ফাহমিদার যেন পায়ের নিচে সর্ষে

রাত ১২টার কিছু পরে রওনা হয়ে সারা রাত কুমিল্লা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হাইওয়ে ধরে চালিয়ে দুই–তিনটি ব্রেক নিয়ে কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়াই শুক্রবার সকাল ১১টায় মেরিন ড্রাইভের অসাধারণ রাস্তা দিয়ে পৌঁছে গেলাম প্রায় টেকনাফের কাছাকাছি হোটেলে। কক্সবাজার আর মেরিন ড্রাইভের সৌন্দর্য নিয়ে নতুন করে বলার কিছুই নেই।
পরদিন শনিবার রাত আটটায় চলে আসব বলে রওনা দিলাম।

বিজ্ঞাপন

এর মধ্যে বাইকের হেডলাইট কেটে গেল। সেই হেডলাইট ঠিক করাতে গেলাম কক্সবাজার শহরের আরেক মাথায় সার্ভিস সেন্টারে। আর কেউ ঠিক করে না। যেখানে যাওয়ার আসলে কোনো রাস্তা নেই, রাস্তা কেটে এক হাঁটু পানিওয়ালা খাল। সেই খাল দিয়ে দুই কিলোমিটার বাইক চালিয়ে হাঁটু পর্যন্ত ভিজে, আমার চৌদ্দপুরুষকে শাপশাপান্ত করে হেডলাইট ঠিক করার পরে রাহাত বলল, ‘আমার ভাল্লাগছে না’।

জীবন কত না সুন্দর!
জীবন কত না সুন্দর!

- বললাম, ‘চলো আজ বাদ দিই, যেহেতু একটার পর একটা ঝামেলা হচ্ছে।’
তারপর ঢাকা আসা বাদ দিয়ে কুচকুচে কালো, ঘুটঘুটে অন্ধকার, সুনসান, ভুতুড়ে রাস্তা দিয়ে মেরিন ড্রাইভের শেষ মাথায় হোটেলে ফেরত এলাম।

পরদিন সকাল ১০টায় রওনা দিয়ে চিটাগং সিটিতে ভুল ফ্লাইওভারে উঠে দুই ঘণ্টা প্যাঁচ খেয়ে, কুমিল্লায় সাড়ে তিন ঘণ্টা টানা বৃষ্টিতে আটকে থেকে সেই বৃষ্টি মাথায় করেই রওনা দিয়ে হানিফ ফ্লাইওভারের আগে দিয়ে রাস্তার পানিতে কোমর পর্যন্ত ভিজে, ঢামেকের চিপা থেকে বিরিয়ানির প্যাকেট নিয়ে রাত সাড়ে ৩টায় বাসার গেটের সামনে এসে গার্ডকে ৪০বার কল দিয়ে ঘুম থেকে উঠিয়ে ভোর ৪টায় বাসায় ঢুকলাম।
কুমিল্লা থেকে বিরিয়ানির দোকান পর্যন্ত প্রায় দুই ঘণ্টা কোনো ব্রেক নেই। বৃষ্টিতে জিনস ভিজে গায়ের সঙ্গে লেপটে গিয়েছিল।

এরপরেও কেউ কেউ বলবে, ‘এবার তো শিক্ষা হয়েছে?’ উত্তর হলো, একদমই না। কারণ, এরকম এক একটা ট্যুর এক একটা লাইফটাইম এক্সপেরিয়েন্স। এক একটা গল্প। দেশের আনাচে-কানাচের অনেক স্থানেই আমরা মোটরবাইকে ঘুরে বেড়াই।

ফাহমিদা
ফাহমিদা

বলতে পারেন ঢাকার ইট-কাঠের জঞ্জালে ভরা শহরের ব্যস্ততায় আমরা নিজেদের তেমন সময় দিতে পারি না, এই সময়টা আমরা মোটরবাইক ট্যুরে নিজেদের দিই। হেলমেটের কমিউনিকেটরে মাইলের পর মাইল চলে খুনসুটি, লেম জোকস আর জীবনের আলাপ। হয়তো এটাই আমাদের কাছে আসার গল্প।

ছবি: লেখক ও মইনুল ইসলাম রাহাত

প্রকাশ: ২৭ এপ্রিল ২০২২, ১২: ৩১
বিজ্ঞাপন