নগরের ছকবাঁধা জীবন আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে অনেকখানি প্রভাবিত করে । মনস্তাত্ত্বিক বিজ্ঞান বলে, একেঘেয়ে পরিবেশ দীর্ঘদিন থাকতে থাকতে আমরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি, অফিস-বাসা সব সামলাতে সামলাতে যেন একধরনের অবসাদ কাজ করে আমাদের মধ্যে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় হচ্ছে এমন এক পরিবেশে যাওয়া, যেখানে গেলে মুহূর্তেই হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে নগরজীবনের কোলাহল। ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনের যত স্ট্রেস—সব ভুলিয়ে দিয়ে প্রাকৃতিক আবহ মুহূর্তে একধরনের প্রশান্তি নিয়ে আসে।
আমাদের মাঝে মাঝে মনে হয়, নিজের মনের মতো নিরিবিলি একটা জায়গা যদি থাকত, যেখানে কোনো কোলাহল নেই, শহুরে হাঁসফাঁস নেই। যেখানে ঝুম বৃষ্টিতে পুকুরে পা ডুবিয়ে আরাম করে ভেজা যায়, আরাম করে খেয়ে শীতল পাটিতে গা এলিয়ে একটা ভাতঘুম দেওয়া যায়, দোলনায় দোল খেতে খেতে আনমনে ভাবা যায় জীবনটা আসলেই সুন্দর!
কল্পনাবিলাসে খাওয়াদাওয়ার অধ্যায়ও চলে আসে। কাকডাকা ভোরে নানির হাতের পিঠার সুবাস, কিংবা হাঁসের মাংসের সঙ্গে ছিটা রুটি, অনেক রকম ভর্তা দিয়ে বউখুদা, মায়ের হাতের গুড়ের পায়েস। গরম ভাতের সঙ্গে মাছভাজাটা খুব যত্ন করে মাটির পাত্রে কলাপাতায় রাখা। এই আবেগময় ইচ্ছা পূরণের খুব কাছাকাছি আপনি যেতে পারেন ঢাকার অদূরে মুন্সিগঞ্জে অবস্থিত শীলবাড়ির হেঁশেলে এলে।
এখানে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত দলবল নিয়ে এসে মনের খোরাক মেটানোর সঙ্গে পেটপূজাও সেরে নিতে পারবেন। যেমন নান্দনিকভাবে সাজানো পুরো জায়গাটি, তেমন এখানকার দারুণ মজার সব খাবার। সব খাবার রান্না হয় মাটির চুলায়। স্থানীয় গ্রামীণ রাঁধুনিরাই রান্না করেন এখানে খোলা আকাশের নিচে।
পুরো রিসোর্ট ঘুরে দেখতে দেখতে কিছুক্ষণ পরপরই আপনি সুস্বাদু সব জিবে জল আনা খাবারের সুগন্ধ পাবেন। এককথায় পরিবারের সবাই বা বন্ধুরা মিলে অসাধারণ একটি ছুটির দিন কাটাতে চাইলে এ জায়গাটির জুড়ি নেই।
কর্মব্যস্ততা আর কোলাহলের শহর ছেড়ে সারা দিন আয়েশ করে সময় কাটিয়ে আসতে পারেন স্নিগ্ধ মায়াবী শীলবাড়ির হেঁশেলের ডে রিসোর্ট থেকে। এই বাগানবাড়ির বাইরেই রয়েছে প্রশস্ত রাস্তা, যেখানে গাড়ি রাখার সুব্যবস্থা রয়েছে। কাঠ, খড়ি ও শোলা দিয়ে পুরো বাগানবাড়ির চারদিকে বেষ্টনী করা হয়েছে। এক দারুণ ইকোরিসোর্টের আবহ আপনি পেয়ে যাবেন এখানে। পুরো রিসোর্টে দেখা যায় কাঠের কাজের নান্দনিকতা। প্রচুর গাছ রয়েছে এখানে। প্রবেশের পরই দেখা যাবে কাঠের দোলনা। রয়েছে খুব সুন্দর একটা উঠান, যেখানে হাতে রং করা দারুণ সব কাঠের বেঞ্চি আছে বসার জন্য। উঠানে পাতা রয়েছে শীতলপাটি। আভিজাত্যে ভরা পঞ্চাশ দশকের বৈঠকবাড়ির আমেজ রয়েছে এই শীলবাড়ির হেঁশেলে।
এখানে রয়েছে পরিবেশবান্ধব কাঠের খোলা কটেজ। সেখানে বসার ব্যবস্থা আছে। ইন্টেরিয়রের পুরো থিমটাই সাদা ও হালকা রঙে করা। ভেতরে রয়েছে সোফাসহ কাঠের বৈচিত্র্যময় সব আসবাব, আয়না। পুরো বাগানবাড়িতে মাটির বড় বড় পাত্রে পানিতে ভাসছে গাদা, জবা, নয়নতারা, জারুল, সন্ধ্যামালতিসহ বিভিন্ন রকম ফুল। ভেতরেই রয়েছে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য আলাদা কক্ষ। সঙ্গে সংযুক্ত ওয়াশরুম। দেশীয় ঐতিহ্যবাহী পণ্যের রুচিশীল সাজসজ্জা এখানে আসা দর্শনার্থীদের ঘরে ফিরে যাওয়ার পরও এক নস্টালজিয়ায় আটকে রাখে।
বাগানবাড়ির প্রতিটি কোণে প্রচুর অর্কিড ও মিনিয়েচার গাছ আপনাকে এক সবুজ ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখবে। এর সামনেই রয়েছে বেশ বড় একটা পুকুর। এই পুকুরে নৌকায় চড়তে পারেন আর সেই সঙ্গে মাছ ধরার ব্যবস্থাও রয়েছে। পুকুরের সামনের কাঠের টংয়ে রয়েছে চায়ের ব্যবস্থা। নিজ হাতে বানিয়ে শীতলপাটিতে বসে আয়েশ করে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে প্রিয় মানুষের সঙ্গে গল্প করা অদ্ভুত আনন্দের হতে পারে।
শীলবাড়ির হেঁশেলের অন্যতম বিশেষত্ব হলো এখানকার দারুণ মজার রান্না। সকালবেলা নানা রকম পিঠা, ছিটা রুটি দিয়ে হাঁসের মাংস, ভর্তা দিয়ে বউখুদা, মাঝবেলার স্ন্যাকসে নুন-মরিচমাখা দেশি ফল। আবার বাচ্চাদের নিয়ে গেলে বিশেষ ব্যবস্থায় তাদের জন্য ফ্রায়েড চিকেন বা ফ্রেঞ্চফ্রাইজ থাকে। দুপুরবেলার ভোজে রোস্ট, পোলাও, রেজালা, কালিয়া, কোরমা, বিভিন্ন রকমের ভর্তা, ডাল, বিভিন্ন সবজির পদ, খিচুড়ি, পায়েস, সেমাই—যে যা খেতে চান এখানকার হেঁশেলে তা-ই রান্না হবে। এর ফাঁকে ঘুরে দেখতে পারেন সবুজ নন্দনকোনা গ্রাম।
এখানে রয়েছে বিভিন্ন প্যাকেজ। খরচ পড়বে জনপ্রতি ২০০০ টাকা। প্রাপ্তবয়স্ক ১০ জন হতে ৫০ জনের ধারণ ক্ষমতা রয়েছে এখানে। আসতে হবে আগে থেকে বুকিং দিয়ে। এক দিনে একটি দলকেই বুকিং দেওয়া হয়। তাই পুরো আয়োজনটা থাকে কেবল তাঁদের জন্যই। সকাল ও মাঝবেলার নাশতা, দুপুরের ভোজ আর বিকেলের নাশতা সংযুক্ত এই প্যাকেজে। এখানে খাওয়ার পানি হিসেবে দেওয়া হয় নিজস্ব টিউবওয়েলের পানি।
সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত খোলা থাকে শীলবাড়ির হেঁশেল। এর কর্ণধার রূপবিশেষজ্ঞ আমিনা হক নিজের গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানের খোলা ইউনিয়নের নন্দনকোনা গ্রামে খুব যত্ন করে সাজিয়েছেন এই বাগানবাড়ি। একটি স্বেচ্ছাসেবক দল সারা দিন কাজ করে এখানে, যাতে অতিথিদের কোনো অসুবিধা না হয়। এই ছুটিতে অনায়াসে জীবনের সব নেতিবাচকতা ভুলে হারিয়ে যেতে পারেন শীলবাড়ির হেঁশেলে।