দুঃসময় কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যাশা বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের
শেয়ার করুন
ফলো করুন

কেমন কাটছে দেশীয় ট্রাভেল গ্রুপগুলোর কার্যক্রম এই সময়ে—তাই নিয়ে কথা হলো কয়েকটি গ্রুপের সঞ্চালকের সঙ্গে। আগস্ট থেকে মার্চ–এপ্রিল পর্যন্ত সময়টা ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত। আর এখন তো অনেকেই বেরিয়ে পড়তে চান কোথাও না কোথাও। কিন্তু দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে অন্য অনেক কিছুর মতোই থেমে আছে ভ্রমণও। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিতে না নিতেই বন্যায় বিপর্যস্ত মানুষ। ফলে ভ্রমণ এখন বিলাসিতার নামান্তর। ভ্রমণ গ্রুপগুলো এই পরিস্থিতিতে পড়েছে চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে। অথচ এই খাতে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়। ভ্রমণগন্তব্যের স্থানীয় মানুষদেরও আয়–রোজগারের একটি বড় উৎস এই ভ্রমণ গ্রুপগুলো।

বিজ্ঞাপন

বিগত দেড় মাসে তাদের ব্যবসায় দারুণ প্রভাব পড়েছে। মৌলিক চাহিদা পূরণ করা ছাড়া অন্য কিছুতে কেউ অর্থ ব্যয় করতে চাচ্ছে না; ফলে লোকসান গুনতে হচ্ছে ভ্রমণ গ্রুপগুলোকে। আবার অনেকেই নতুন ভ্রমণের সূচি জানতেও আগ্রহী। এ নিয়ে বেশ উভয়সংকটেই আছে ‘ঝটিকা সফর’ নামে ভ্রমণ গ্রুপ। জানালেন এই গ্রুপের অ্যাডমিন জান্নাতুল ফেরদৌসি মানু।

এখন হাওর বা বরিশালের পেয়ারাবাগান হতে পারে ভাল ভ্রমণগন্তব্য
এখন হাওর বা বরিশালের পেয়ারাবাগান হতে পারে ভাল ভ্রমণগন্তব্য

তিনি বলছিলেন, বর্ষা ও বর্ষা–পরবর্তী সময়ে ভ্রমণপ্রেমীদের গন্তব্য থাকে সিলেট কিংবা চটগ্রামের পাহাড়ি ঝরনা। এখন বন্যার কারণে এসব গন্তব্যে ভ্রমণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
এসব এলাকা বাদ দিয়ে নতুন ট্যুর প্ল্যান জানাচ্ছেন বলেই অভিমত তাঁর। এর মধ্যে আছে জৈন্তাপুরের ডিবির হাওর, ঝালকাঠির পেয়ারাবাগান, শাপলাবিল, সাতছড়ি অভয়ারণ্য, সুন্দরবনসহ বেশ কিছু গন্তব্য। মূলত স্থানীয় অধিবাসীদের ভিলেজ ট্যুরিজম বা কমিউনিটি ট্যুরিজমে অন্তর্ভুক্ত করে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাই তাঁর মূল উদ্দেশ্য। কারণ, এই সময়ে ট্যুরিস্ট কমে যাওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষ যেমন মাঝি বা দোকানদারদের রোজগার কমে যায়। তাঁরা তাই চেষ্টা করেন তাঁদের পাশে দাঁড়াতে।
বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে ভ্রমণ দীর্ঘ তিন মাস বন্ধ থাকায় যথেষ্ট ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়েছে ‘পিয়ালী ইকো রিসোর্ট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারের’, জানালেন স্বত্বাধিকারী কামাল খান, এর সঙ্গে খাঁড়ার ঘা হয়েছে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও বন্যা। দেশের পুরো পর্যটন খাতেই এর প্রভাব পড়েছে। এই ক্ষতি খানিকটা পোষাতে সেপ্টেম্বর মাসজুড়ে ছাড় দেওয়া হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

প্রায় ৫ বছর ধরে খাঁটি মধু সংগ্রহ ও বিক্রিতে নানাভাবে সুন্দরবনের মৌয়ালদের সঙ্গে আছেন কামাল। তিনি বললেন, মৌয়ালরা এবার নিয়েছেন চমৎকার এক উদ্যোগ। সংগৃহীত মধু বিক্রির লভ্যাংশ তাঁরা দিচ্ছেন উপকূলের বাঁধ ভেঙে খুলনার পাইকগাছায় প্লাবিত ১৩টি গ্রামের মানুষকে।  

চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে ‘ট্রাভেলেট'স অব বাংলাদেশ’ ভ্রমণকন্যা
চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে ‘ট্রাভেলেট'স অব বাংলাদেশ’ ভ্রমণকন্যা

‘ট্রাভেলেট'স অব বাংলাদেশ’ ভ্রমণকন্যা। নারীভিত্তিক ভ্রমণ কার্যক্রমে প্রশংসিত ও জনপ্রিয়। সামাজিক দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে কল্যাণকর কর্মসূচিও থাকে নিয়মিত। গ্রুপের শীর্ষ সারির কর্মকর্তাদের অনেকেই চিকিৎসক বলে চলমান বন্যায় দুর্গতদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা দিচ্ছেন তাঁরা। গ্রুপের একজন অ্যাডমিন নুসরাত রিজভী জানালেন, ২৪ আগস্ট থেকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম ও খাগড়াছড়িতে বন্যাকবলিত মানুষকে চিকিৎসাসেবা প্রদান করেছেন। তবে সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির খানিকটা উন্নতি হওয়ায় টাঙ্গুয়ার হাওরের ট্যুর প্ল্যান আছে তাঁদের; এই ভ্রমণ তালিকায় আরো আছে কক্সবাজার, সুন্দরবনের ইরাবতী ও ঢাকার কাছের শীলবাড়ির হেঁশেল।

দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিবেচনায় গত এক মাস ‘জোছনাতরী’র সব কার্যক্রম বন্ধ রাখার পর ২২ আগস্ট থেকে পুনরায় কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জোছনাতরীর অন্যতম স্বত্বাধিকারী আকরাম হোসেন। সুনামগঞ্জ হাউসবোট মালিক সমিতি বিগত বছরের মতো এবারও বন্যার্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে। প্রতিটি হাউসবোট থেকেই চলছে ত্রাণ সংগ্রহের এবং সরবরাহের কাজ। জোছনাতরীর পরবর্তী ট্রিপের ১০ শতাংশ লভ্যাংশও দান করা হবে ফেনী ও কুমিল্লার বন্যার্তদের জন্য।

পর্যটন ব্যবসায়ীরাও সহায়তা করছেন বন্যাত্রাণে
পর্যটন ব্যবসায়ীরাও সহায়তা করছেন বন্যাত্রাণে

হাওরের মানুষের জীবনযাত্রার মানকে সমুন্নত করতে ও কমিউনিটি ট্যুরিজমকে স্থানীয় মানুষের মধ্যে জীবিকার উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে কাজ করে যাচ্ছে ‘ডাহুক’। সংগঠনটির স্বত্বাধিকারী রেজা শাওন জানালেন ডাহুকের নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবীরা কুমিল্লা, ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দুর্গম অঞ্চলে উদ্ধারকাজের সমন্বয় করছেন এবং ত্রাণ বিতরণ করেছেন। ইতিপূর্বে ঘূর্ণিঝড় রিমালে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে ‘উপকূলের জন্য গান’ শিরোনামে একটি কনসার্টের আয়োজন করা হয়।

গেল জুলাই থেকে চলমান পরিস্থিতির কারণ বাংলাদেশ থেকে বিদেশগামী পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ৮০ শতাংশ কমেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ আউটবাউন্ড ট্যুর অপারেটরস ফোরাম। গত ৫ আগস্টের পর থেকে ভারতীয় দূতাবাস বাংলাদেশের জন্য ভিসা প্রদান সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে। অন্যদিকে সামগ্রিকভাবে ভ্রমণ কমলেও থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলো এখনো বাংলাদেশিদের জন্য সীমিতসংখ্যক ভিসা ইস্যু করছে।

উদ্ভূত পরিস্থিত ও ভিসা সমস্যার জন্য ভারতে যাওয়া যাচ্ছে না
উদ্ভূত পরিস্থিত ও ভিসা সমস্যার জন্য ভারতে যাওয়া যাচ্ছে না

বাংলাদেশ আউটবাউন্ড ট্যুর অপারেটর ফোরামের সভাপতি চৌধুরী হাসানুজ্জামান বলেন, ‘মূলত ছাত্র আন্দোলনের কারণে জুলাই থেকে সংকটটা শুরু হয়। যেহেতু এই সময়টায় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে ছুটি থাকে, তাই এটা আমাদের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ সময় ছিল, কিন্তু অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর অনেক কম পর্যটক আমরা পেয়েছি। করপোরেট ট্যুর পুরোপুরি বন্ধ এবং অনেকগুলো বাতিলও হয়েছে। আর কিছু এখনো ঝুলে আছে।’ চৌধুরী হাসানুজ্জামান বলেন, ‘এখন থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াতে কিছু ট্যুরিস্ট যাচ্ছে। তবে দুবাইতে অনেক দিন থেকে ভিসা বন্ধ। এভাবে চলতে থাকলে আগামী দুই মাস কর্মচারীদের বেতন দিতে পারব কি না সন্দেহ।’

গন্তব্যের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ থেকে বিদেশভ্রমণকারী পর্যটকের সংখ্যা পরিবর্তিত হয়। বাংলাদেশের ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের মতে, সাংস্কৃতিক বন্ধন, নৈকট্য এবং ভিসা পাওয়ার সুবিধা বিবেচনায় ভারতই বাংলাদেশিদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্য। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়া পর্যটকদের অন্তত ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশই ভারতে যান।

এরপরে চিকিৎসা, ঘোরাফেরা, কেনাকাটা ও অবকাশ কাটানোর জন্য থাইল্যান্ড অন্যতম জনপ্রিয় গন্তব্য। এখানে প্রায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বাংলাদেশি পর্যটকের যাতায়াত রয়েছে। এ ছাড়া মালয়েশিয়ায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ এবং সিঙ্গাপুরে ৫ থেকে ১০ শতাংশ বাংলাদেশি পর্যটক ভ্রমণ করেন।

সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি পর্যটকের মধ্যে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ যাতায়াত করে থাকে। অন্যদিকে ইউরোপে যায় ৫ থেকে ৮ শতাংশ। এ ছাড়া অন্যান্য এশীয় দেশ যেমন নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান ও চীনেও বাংলাদেশি পর্যটকদের ৫ থেকে ৮ শতাংশ ভ্রমণ করে। অন্যদিকে উত্তর আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় ২ থেকে ৫ শতাংশ বাংলাদেশি পর্যটককে ভিসা দেওয়া হয়।

ভারতের পর থাইল্যান্ডে সবচেয়ে বেশি যায় বাংলাদেশিরা
ভারতের পর থাইল্যান্ডে সবচেয়ে বেশি যায় বাংলাদেশিরা

আউটবাউন্ড ট্যুর অপারেটিং এজেন্সি ট্রিপ মেকার সাধারণত আসিয়ান ও সার্কভুক্ত দেশগুলোতে পর্যটক পাঠিয়ে থাকে। এই এজেন্সির মোট ট্রাফিকের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হয় ভারতে। যদিও এটি এখন শূন্যে নেমে এসেছে, যা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

ফিমেল ট্রাভেলারস নেটওয়ার্কের স্বত্বাধিকারী নুসরাত জাহান জানালেন, মূলত মেয়েদের জন্য ট্রাভেল এজেন্সি; তবে ফ্যামিলি ট্রিপ ও যে কেউ ভ্রমণে গেলে তাঁরা সহযোগিতা প্রদান করে থাকে। সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ব্যবসায় বেশ প্রভাব ফেলেছে। বনানী ও গুলশানে দুটো অফিস আছে। এই কয় মাসে কর্মচারীদের বেতন, ভাড়া সব মিলিয়ে প্রায় ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে প্রতিষ্ঠান। নুসরাত বললেন, তাঁর স্বপ্ন সারা বিশ্বের মেয়েরা বাংলাদেশ ভ্রমণে আসবে আর বাংলাদেশের মেয়েরা সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়াবে।

ভ্রমণশিল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, বাংলাদেশের ভ্রমণশিল্পে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি ভ্রমণমুখী হয়েছে। তাই এই দুঃসময় আর দুর্যোগ কাটিয়ে উঠবে দেশীয় ভ্রমণশিল্প। আবারও ফিরবে সুদিন। মানুষ আগের মতোই বেরিয়ে পড়বে নতুন নতুন গন্তব্যে।

প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২: ০০
বিজ্ঞাপন