চল দোতং পাহাড়
শেয়ার করুন
ফলো করুন

ছোটবেলা থেকেই আমার ট্রাভেল শোগুলোর প্রতি অদ্ভুত একটা আকর্ষণ ছিল। তখন তো বিটিভি ছাড়া আর কিছু ছিল না; বিটিভির ট্রাভেল শো মানেই পার্বত্য চট্টগ্রাম! সেই তখন থেকেই পাহাড়ের প্রতি কী এক অবাক টান আমার।

পাহাড় ঢাকে ঐ
পাহাড় ঢাকে ঐ

এরপর আমার এক ফুফাতো ভাই পড়াশোনার জন্য ঢাকায় থাকতে শুরু করে, তখন আমি ক্লাস সেভেনে। সেই সময় থেকেই ভাইয়া প্রচুর ট্রাভেলিং করত; আজ এই পাহাড় তো কাল সেই ঝরনা। আমাদের গল্পের টপিক ছিলই ওর ঘোরাঘুরি। ওর এই ভ্রমণের গল্প আর ছবি আমার পাহাড়ের প্রতি আকর্ষণ আরও চাঙা করেছিল। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায় পাহাড়ে আসা হয়নি আমার।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু এবার আর কিছুই আটকাতে পারেনি আমাকে। ঈদের ছুটিটা পেয়েই বেরিয়ে পড়েছি। যখন ট্রেনে উঠে বসি, তখনো আমার কাছে কোনো প্ল্যান নেই—কোথায় যাব, কীভাবে যাব। আমি নির্ভর করে আছি আমার ভ্রমণসঙ্গীর ওপর!

সাগর সৈকতে
সাগর সৈকতে

যাহোক, চট্টগ্রামের ট্রেনে চেপে বসি আমরা দুজন; উদ্দেশ্য বান্দরবান। কিন্তু মাঝরাতে ঘুম ভেঙে আমার মনে হলো প্রথমে সমুদ্র দেখেই শুরু করব আমার যাত্রা! ভোরে চট্টগ্রাম পৌঁছেই কক্সবাজারের বাসে উঠে পড়ি। ১২টা নাগাদ পৌঁছে হোটেলে উঠে ফ্রেশ হয়েই ভরদুপুরেই ভোঁ–দৌড় দিই সমুদ্রের দিকে! এখানে বলে রাখি, অফ সিজন হওয়ায় হোটেলের ভাড়া ছিল অবিশ্বাস্য রকম কম। আর পুরো সৈকত এলাকা একদম ফাঁকা! সমুদ্রের এমন রূপ শুধু অফ সিজনেই পাওয়া সম্ভব। সারা দিন আমরা কক্সবাজারে টো–টো করে ঘুরলাম। কলাতলী সৈকত, হিমছড়ি, ইনানী ঘুরতেই সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। এরপর রাতে গেলাম লাবণী আর সুগন্ধা পয়েন্টে। দিনের সমুদ্র যেমন অপরূপ, রাতের সমুদ্র আরও মোহনীয়! যেন কোনো মহাজাগতিক সত্তা।

বিজ্ঞাপন

রাতটা কক্সবাজারে থেকে পরদিনই আমরা রওনা দিই আলীকদমের উদ্দেশে। প্রথমে বাসে চকরিয়া; এরপর জিপ গাড়িতে আলীকদম। আলীকদমে দুপুরে খেয়ে বাইকে চেপে সোজা ১৭ কিলো। উদ্দেশ্য, ১৭ কিলো এলাকার একটা মুরংপাড়া, নাম ‘আদুপাড়া’। আলীকদম থেকে মোটরসাইকেলে করে ১৭ কিলো নামতে হবে, তারপর বাঁ দিকের দামতুয়া যাওয়ার পাহাড়ি রাস্তা ধরে অল্প খানিক হাঁটলেই এই আদুপাড়ার দেখা মিলবে। এখানে কয়েক ঘর মুরং পরিবার বাস করে। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা বাংলা জানলেও নারীরা শুধু মুরং ভাষাটাই জানেন। সবাই যৌথ পরিবারেই থাকেন। এখানে ছিলাম এংরিং নামের এক মুরং যুবকের বাসায়। তাঁদের আতিথেয়তা অসাধারণ, একদম অপরিচিত আমাকে তাঁরা কি অদ্ভুতভাবেই না আপন করে নিয়েছে!

পাহাড়ের পথে
পাহাড়ের পথে

আর পাহাড়ের সৌন্দর্য নিয়ে বলার নতুন কিছু নেই। কোনো বাড়তি শব্দ নেই, বাজে গন্ধ নেই। আমি দিনরাত এখানে বুঁদ হয়ে ছিলাম। কোনো কৃত্রিমতা নেই এখানে, শুধুই অপার সৌন্দর্য। সারা দিন হাত–পা ছড়িয়ে বসেই থাকা যায় এখানে! এত সবুজ, কত নতুন ঘ্রাণ, কতশত নতুন পাখির ডাক। আর আছে রাতের পাহাড়, সে আরেক আশ্চর্য! সারা দিনের চড়া রোদের অসহ্য গরম যেন উধাও হয় নিমেষেই, ঠান্ডা একটা হাওয়া বইতে থাকে সারাক্ষণ। ঝিঁঝিঁ পোকার গান আর থেকে থেকে তক্ষকের ডাক সেই পরিবেশকে আরও মোহনীয় করে তোলে। আদুপাড়ায় ছিলাম দুই রাত। তিন দিন টানা জার্নির ধকল কমাতেই দুই দিনের বিশ্রাম।

এরপর আমরা যাই থানচি, উদ্দেশ্য তাজিনডং যাওয়া। থানচিতেও বেশ সুলভে কটেজ ভাড়া পাওয়া গেল অফ সিজন হওয়ায়! কটেজে ব্যাগপত্র রেখে আমরা পাশেই তমাতুঙ্গি দেখতে গেলাম। তমাতুঙ্গি থেকে কেওক্রাডং, তাজিনডং ও সাকা হাফং—এই তিন চূড়া দেখা যায়। সেখান থেকে ফিরতে রাত হয়ে গিয়েছিল। পরদিন সকালে আমরা রওনা দিই বোডিংপাড়ার উদ্দেশে। আমার ভ্রমণসঙ্গীর প্রায় আট বছর আগের ভ্রমণের স্মৃতি থেকে পাহাড়ি রাস্তা খুঁজে খুঁজে সারা দিন ট্রেকিং করে সন্ধ্যায় আমরা পৌঁছেছিলাম বোডিংপাড়ায়। এটাই ছিল আমার জীবনে প্রথম ট্রেকিং, রাস্তায় এত চড়াই-উতরাই পার করতে ভীষণ কষ্ট হলেও একবারও মনে হয়নি থেমে যাই, আর পারছি না। কারণ, প্রতিটা পা ফেলার পর যে সৌন্দর্য চোখে পড়ছিল, তা আমার কল্পনার অতীত! এত সুন্দর! আহা! এত সুন্দর!
 

তমা তুঙ্গী
তমা তুঙ্গী

সে রাত বোডিংপাড়ায় থাকলাম এক মুরং পরিবারের আতিথেয়তায়। পরদিন আমাদের তাজিনডং যাওয়ার কথা থাকলেও খানিক জটিলতায় সে প্ল্যান বাতিল করে সকালেই আমরা ফিরে আসি থানচি। থানচি এসে রেস্টহাউসে ফ্রেশ হয়ে সিদ্ধান্ত নিই রেমাক্রি ঘুরে এসে আমরা এবারের ট্যুর সমাপ্ত করব। এবারে গাইড ঠিক করতে হলো, আমাদের গাইড মারমা যুবক মং সাচিং। গাইডের মাধ্যমেই আরেক সোলো ট্রাভেলারের সঙ্গে পরিচয় হলো, তিনিও যাচ্ছেন রেমাক্রি। তিনজন একসঙ্গে খানিক আলাপ করার পরই ঠিক করলাম শুধু রেমাক্রি নয়, নাফাখুম পর্যন্ত ঘুরে আসব আমরা। এরপর ট্রলারে উঠে বসলাম তিনজন মিলে। রেমাক্রি পৌঁছে আমাদের তিনজনেরই কী যেন হয়ে গেল, আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম একদম অমিয়াখুম, ভেলাখুম, নাইক্ষ্যংমুখ পর্যন্ত যাওয়ার! তো যেই কথা, সেই কাজ!

রেমাক্রি থেকে হাঁটা শুরু, বিকেলের শেষ দিকে পৌঁছালাম নাফাখুম। পথে জায়গায় জায়গায় পাহাড়িদের দোকানে কলা, ডিম আর চা ছিল আমাদের রসদ। যদিও পানি কম কিন্তু তারপরও নাফাখুমের যে রূপ, তাতেই আমি কাত। বিকেল থেকে রাতের আগপর্যন্ত ওর সামনেই বসে রইলাম আমরা হাত–পা ছড়িয়ে।

অচেনা পথে চলার আনন্দ
অচেনা পথে চলার আনন্দ

আলো কমে যেতেই সম্বিৎ ফিরল যেন, তখন উঠে পাশেই নাফাখুমপাড়ায় রাতের থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। এই এলাকাটায় পর্যটকদের আসা–যাওয়া বেশি হওয়ায় এই পাড়াটা বেশ কমার্শিয়াল হয়ে উঠেছে। রাত প্রতি ১৫০ টাকায় ঘর ভাড়া পাওয়া যায়, আরও পাওয়া যায় বাঙালি খাবার।

সেই রাত সেখানে কাটিয়ে পরদিন ভোরেই রওনা দিই অমিয়াখুমের উদ্দেশে। অমিয়াখুম যাওয়ার পথে মাঝেই পড়ে জিন্নাপাড়া আর থুইছাপাড়া। থুইছাপাড়ায় রাতে থাকার বন্দোবস্ত করে এবং খানিক বিশ্রাম নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করি। দুপুরের দিকে পৌঁছাই অমিয়াখুম, সেখানে খানিক থেমে আবার হাঁটা দিই ভেলাখুমের দিকে। ভেলায় করে যেতে হয় তাই ভেলাখুম! মাত্র মিনিট তিনেকের ভেলার পথ, কী যে অদ্ভূত সুন্দর! দুই পাশে খাড়া পাহাড়ের মাঝ দিয়ে জলপথ। ভেলাখুমের ঠিক পরেই নাইক্ষ্যংমুখ। সেখানে আমার ভ্রমণ সঙ্গীরা পানি দেখে আর নিজেদের সংবরণ করতে পারেনি! ঝুপঝাপ ঝাঁপিয়ে পড়ল পানিতে!

জলের ধারায় চোখ জুড়ায়
জলের ধারায় চোখ জুড়ায়

এরপর তাঁদের জলকেলি ফুরালে আবার ফিরতি পথ ধরি। থুইছাপাড়ায় পৌঁছাই বিকেলের শেষ দিকে। সে রাতটা সেখানেই কাটাই। পরদিন খুব সকালে রওনা দেওয়ার কথা থাকলেও ঘুম ভাঙে বৃষ্টির শব্দে! ওহ, পাহাড়ের বৃষ্টি! এই অপার্থিব দৃশ্যও ভাগ্যে ছিল! নিজের কপালকে নিজেরই ঈর্ষা হচ্ছিল তখন!

বৃষ্টি থামলে আমরা ফেরার পথ ধরি। বিকেল নাগাদ পৌঁছে যাই থানচিতে। রাতটা থেকে পরদিন চলে আসি বান্দরবান শহরে। এবার ফেরার পালা!

ওদের সঙ্গে
ওদের সঙ্গে

একঝোলা দুর্দান্ত স্মৃতি নিয়ে চেপে বসি ফেরার গাড়িতে; কিন্তু যে নেশায় পেয়ে বসেছে আমাকে, আমি জানি, আমার সামনের সব ছুটিই পাহাড় বুক করে নিয়েছে! আমি বারবার ফিরে আসব পাহাড়ে।

ছবি: লেখক

প্রকাশ: ১০ আগস্ট ২০২৩, ১৯: ০৯
বিজ্ঞাপন