আধেক ভ্রমণ, আধেক ভোজন ১
শেয়ার করুন
ফলো করুন

ডিসেম্বরের ঢাকা শহর। ভোর পর্যন্ত হালকা কুয়াশার চাদর গায়ে জবুথবু বসে থাকে এ শহর। যে–ই না সকালের আলো ফোটে ভালো করে, অমনি চাদর উড়িয়ে ক্যাঁচকোঁচ কলকবজায় ঝাঁকি দিয়ে উঠে দাঁড়ায় ঢাকা। রিকশার টুংটাং, গাড়ির বিকট হাইড্রোলিক ভেঁপু, নতুন দালানের কনস্ট্রাকশনের ঘটাং ঘটাং—সব যেন খাঁচা খুলে বেরিয়ে আসে। প্রিয় শহরের ঘুম ভাঙার এই দৃশ্য অভিভূতের মতো দেখছি। কারণ, দেশে থাকি না। বাস কিংবা প্রবাস সেই সুদূর জার্মানির মিউনিখ নগরে। দেশে এসেছি মাত্র একদিন আগে। জার্মানি টু বাংলাদেশ যাত্রা দৈর্ঘ্যে বেশ লম্বা। ট্রানজিট মিলিয়ে ১৬–১৭ ঘণ্টার মামলা। সে রেশ কাটতে না কাটতেই রীতিমতো হাইজ্যাকড হয়ে বসে আছি নীল রঙের বিশাল হোন্ডা সিভিকের নরম গদিতে।

এই হাইজ্যাক কর্মের মূল হোতা আমার বড় ভাই। সে আর তার বউ মিলে ষড়যন্ত্র করে এই ঝটিকা সফরের নিখুঁত ছক কেটে রেখেছে। দেশে আসামাত্রই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে রওনা দেওয়া হয় দূরে কোথাও। একবার সেন্ট মার্টিন তো পরেরবার শ্রীমঙ্গল। অবশ্য এতে আপত্তির কিছু দেখি না। তাই কাঁধে বোঁচকা ফেলে বেরিয়েছি নতুন এক ভ্রমণে।

এবারের গন্তব্য, সুন্দরবন। দেশের এক প্রান্তে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা পৃথিবীর দীর্ঘতম ম্যানগ্রোভ বন। যার ঝোলায় ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের তকমা পর্যন্ত আছে। কিন্তু তাতে কি। মক্কার লোকে যেমন হজে যায় না, তেমনি দেশে থাকতে ঢাকার বাইরে খুব একটা যাওয়া পড়েনি। ওই ছোটবেলায় শীতের ছুতিতে স্টিমার কি লঞ্চে করে চাঁদপুর ডিঙিয়ে ঝালকাঠি। ব্যস, অতটুকুনই।

বিজ্ঞাপন

অথচ রবীন্দ্রনাথ বাঙালিকে কতশতবার পই পই করে বলে গেছেন, ‘ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া’ যেন ধানের শিষে শিশিরবিন্দুর তালাশ করি। আজকে তাই রবিঠাকুরের কথা রাখতেই সুন্দরবন নামের ঘাসের ডগায় শিশির খুঁজতে চলেছি। তা ছাড়া এই বড়বেলায় যখন বড় ভাইয়ের কল্যাণে দেশটা ঘুরে দেখার সুযোগ মেলে, তখন ছোট মানুষের মতোই মনের এধার থেকে ওধার পর্যন্ত আনন্দের কানাকানি পড়ে যায়।

ভাইয়া আর ঝুমু আপু সমানে নিজেদের ভেতর কথা বলছে। ঝুমু আপুকে আমি ভাবি বলি না। সেও আমাকে ননদ বলে মানতে নারাজ। কারণ, ননদ-ভাবি সম্পর্কের ভেতর কেমন একটা চিরায়ত বাংলার দা-কুমড়া ভাব আছে। ঠিক যেন জি–বাংলা কিংবা স্টার জলসা চ্যানেলের কুটিল দুই রমণী। একজন কানে জবরজং ঝুমকা পরে কই মাছ কাটছে, তো আরেকজন কাতান শাড়ি কোমরে পেঁচিয়ে খুন্তি হাতে কুমড়ার চচ্চড়ি নাড়ছে। এবং অকারণেই তাদের ভেতর গোল বাধে। হাতে উঠে আসে মাছ কাটার দা, তো আর আরেকজনের হাতে বাকি অর্ধেকটা চালকুমড়া। তুমুল এক গৃহযুদ্ধ। তাই দেখে এপার বাংলার মা-শাশুড়িরা হিপ হিপ হুররে করে। সুতরাং আমরা ওসব গোলমেলে টাইটেল এড়িয়ে চলি খুব সাবধানে।  

বিজ্ঞাপন

যাহোক, খিদেটা ভালোই পেয়ে বসেছে। পেছনে বসে আমরা চারজন উশখুশ করছি। এই চারজনের পরিচয় হলো, ভাইয়ার দুই ছেলে–মেয়ে রন আর রেন। তারা যথাক্রমে ক্লাস টু আর ক্লাস এইটে পড়ে। তাদের পাশে তাফসু মিয়াকে সঙ্গে নিয়ে আমি। তাফসু মিয়া আমাদের ভেতর কনিষ্ঠ। তার বয়স সাড়ে ৭ বছর। ৯ বছরের রনের সঙ্গে তার পিঠাপিঠি ভাব। দুজন দুজনকে পেলেই অল্প বয়সী বানরের মতো খুনসুটিতে মজে যায়।

ওদিকে বানর মাতা এই আমার বয়স চল্লিশের দিকে ঊর্ধ্বগতিতে ধাবমান। তবে আপাতত বয়সটা নিম্নগামী হয়ে ষোলোতে এসে ঠেকেছে। কারণ, রেনের বয়স ১৫। তার পাশে বসলে বয়সের কোঠা থেকে এক-দেড় যুগ এমনি উবে যায়। মনের মিল বলে কথা। আপাতত রেনের সঙ্গে আলাপের প্রধান বিষয় খানাখাদ্য। এ মুহূর্তে আমাদের প্রধান চিন্তা, পথের ধারে কোন রেস্তোরাঁয় থামা হবে আর সেখানে বসে কী কী খাবদাব। বিফ নাকি মাটন? পরোটা খাব নাকি নান–রুটি। বাটার নান, নাকি গার্লিক নান। সঙ্গে কফি নাকি মালাই চা? দুশ্চিন্তায় কপালে চার ভাঁজ।

সোনালি রোদে যেন মুচকি হাসছে পদ্মার ঢেউ
সোনালি রোদে যেন মুচকি হাসছে পদ্মার ঢেউ

রন আর তাফসু মিয়াও নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু, বাংলাদেশি স্কুল বনাম জার্মান স্কুলে হোমওয়ার্কের চাপবিষয়ক তুলনামূলক বিশ্লেষণ। তাফসু মিয়ার ইশকুল ভালো লাগে না। ক্লাসের পড়াশোনা তার কাছে করলা আর হোমওয়ার্ক হলো চিরতার পানি। রনের অবশ্য এ ব্যাপারে ভিন্নমত।  ‘...কিন্তু আমার স্কুলে তো হোমওয়ার্ক খুব কম, তোমার স্কুল আসলে ভুয়া, বুঝলা...’। রনের কথা শুনে তাফসু মিয়া প্রায় কনভিন্সড। জার্মান স্কুল তাকে বেশি প্যারা দিলে সে সেখানকার পাট চুকিয়ে বাংলাদেশে চলে আসবে। নিউ ইস্কাটনের এজি চার্চ স্কুলে এসে ভর্তি হয়ে যাবে রনের ক্লাসে। কী আছে জীবনে।

তবে আমাদের গালগল্পে প্রায়ই লাগাম টানতে হচ্ছে। ভাইয়া-আপুর মুহুর্মুহু জরুরি ফোন আসছে। এরা দুজনই ডাক্তার। ভাইয়া ইন্টারনাল মেডিসিনের আর আপু অর্থোপেডিক্সের। শাহবাগের বারডেম হাসপাতাল তাদের ঠিকানা। দুই ডাক্তার একযোগে ছুটি নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছে শুনে হাসপাতাল আর চেম্বার মিলিয়ে তামাম রোগীমহল তাদেরকে হারিকেন জ্বালিয়ে খুঁজছে। বেচারা দুজন ফোনের ভেতরেই রোগীর সুগার কমিয়ে দিচ্ছে কিংবা ভাঙা ঠ্যাঙের ফলোআপ বাতলাচ্ছে। ডাক্তার জীবন, কঠিন জীবন।

কথায় কথায় সময় গড়িয়ে পথ পেরিয়ে গিয়েছে অনেকটা। হঠাৎ অদ্ভুত রকমের মসৃণ রাস্তায় উঠে খেয়াল হলো, আরে রাস্তা কই। এ যে সেতু, পদ্মা সেতু! জানালার দুই পাশ থেকে অবারিত পদ্মা ঢেউ তুলে সাক্ষ্য দিল, ‘হ্যাঁ পদ্মা সেতুই বটে, স্বাগত তবে’। সেতুর মুখে টোল দিয়ে উঠে পড়লাম পিচঢালা ঝাঁ–চকচকে সেতুপথে। কী তার লম্বা-চওড়া চেহারা, আর কী তার রাজকীয় গঠন। মনটা গর্বে ভরে গেল।

পদ্মা সেতু থেকে পদ্মা নদী দর্শন
পদ্মা সেতু থেকে পদ্মা নদী দর্শন

ছাও-পাওরা সব বিপুল উৎসাহে মুঠোফোনের স্টপওয়াচ নিয়ে পড়ল। এই সেতুর দৈর্ঘ্য পাড়ি দিতে কত সময় লাগবে, সেটা মেপে ফেলতে হবে। স্টপওয়াচ চলছে তো চলছেই। কিন্তু সেতু আর ফুরোয় না। সকালের সোনারোদে ঝিলিক তুলে পদ্মা নদীও তাল মিলিয়ে মুচকি হাসে। শেষমেশ প্রায় ছয় কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে যখন আরেক প্রান্তে পৌঁছানো হলো, ততক্ষণে স্টপওয়াচের কথা মনেই নেই কারও। তার বদলে গাড়ির স্পিকারে তুমুল ভলিউমে ‘হাওয়া’ সিনেমার গান চলছে, ‘সাদা সাদা কালা কালা, রং জমেছে সাদা–কালা...’।

গাড়ি থেকে নেমে আমরাও একদফা তাজা হাওয়া খেয়ে নিলাম। যাত্রাবিরতি। হাইওয়ে রেস্তোরাঁয় পৌঁছে গেছি। গুগল ম্যাপ আমাদের অনেকটা পথ খামোখা ঘুরিয়ে এনেছে। খিদেয় সবার পেট চোঁ চোঁ করছে। চোখ পর্যন্ত সরু হয়ে এসেছে। শুধু হাওয়ায় পেট ভরবে না। এবার এয়সা দম দিয়ে কবজি ডুবিয়ে খাবার পালা।

নান-পরোটায় রেস্তোরাঁর চওড়া টেবিল ঢেকে যেতে সময় লাগল না। মাটনের ভুরভুরে ঘ্রাণের সঙ্গে বিফ কারির ঝাঁজ মিলে ম–ম করছে চারপাশ। ডিমভাজিটাও বা বাদ যাবে কেন। একে একে থালাগুলো সাবড়ে দিতে সময় লাগল না। কোল্ড ড্রিংকসে ঘাউক ঢেকুর তুলে তৃপ্তি মিলল ষোলো আনা। ষোলোর ওপরে আঠারো আনার লোভে মালাই চায়ের আবদার জানানো হলো ওয়েটারের কাছে। বেচারাদের চাপাতির টিন ফুরিয়েছে। তাই কাগজের কাপে চড়ে এল ফেনিল কফি। বেশি দুধ আর বেশি চিনির ভারে মালাই চায়ের তুলনায় কম নয় সেই কফি। চোঁ করে টেনে উড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ালাম সবাই।

আর মাত্র এক ঘণ্টার পথ। কখনো মসৃণ, কখনো উঁচু–নিচু রাস্তা মাড়িয়ে, আর কখনো পথের ধারে দুমড়ে-মুচড়ে, উল্টে-ভচকিয়ে পড়ে থাকা বাস-ট্রাক-প্রাইভেট কারের ভুতুড়ে কঙ্কাল পাশ কাটিয়ে মোটামুটি নির্বিঘ্নেই পৌঁছে গেলাম খুলনা শহর। সড়ক দুর্ঘটনা যে নিত্যদিনের ঘটনা, বুঝতে বাকি রইল না। এ পথে বেরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানো সবার কপালে জোটে না।

যাহোক, খুলনায় আগে আসিনি। আগ্রহ নিয়ে দেখছি জানালার বাইরেটা। ঢাকার মতো ধূলিধোঁয়ার চাদরে ঢাকা নয়। খুলনা বরং খোলামেলা, নির্ঝঞ্ঝাট এক শহর। বাতাসে একধরনের শুদ্ধতা ছড়ানো। ছোটবেলায় ঢাকাকে যেমন শান্ত, নিরিবিলি দেখেছি, অনেকটা তেমন। গাড়ির চেয়ে রিকশা আর অটোরিকশার আনাগোনাই বেশি। লোকজনের ভেতরও শহুরে তাড়া নেই। বরং স্বস্তিটাই যেন বেশি। অট্টালিকা আছে বটে, তবে আকাশ হটিয়ে নয়। মাথার ওপরে সাদা মেঘেরা এখনো এ শহরে খেলে বেড়ায় অবলীলায়।

সব মিলিয়ে ‘কুল’ শহর খুলনাকে বড্ড ভালো লেগে গেল আমার আর তাফসু মিয়ার। বাকিরা অবশ্য এ শহরের নিয়মিত অতিথি। ঝুমু আপু খুলনার মেয়ে। তার পিছু পিছু প্রায়ই আসা হয় ভাইয়া আর রেন-রনের। আজকে তার সঙ্গে জুটেছি আমরা আরও দুজন। ঝুমু আপুর মামাবাড়িতে আজ রাতটা কাটিয়ে পরদিন রওনা আমাদের আসল গন্তব্য, সুন্দরবনের উদ্দেশে।

গাড়িটা মামার ফ্ল্যাটবাড়ির বাড়ি বারান্দায় ঢোকাতেই স্বয়ং মামা আর তার কলেজপড়ুয়া ছেলে, আলভী হুড়মুড়িয়ে নেমে এসে আমাদের হাতের বোঁচকাগুলো ছোঁ মেরে নিয়ে নিল। বোঝা গেল, মামাটা ঝুমু আপুর একার হলেও মামাবাড়ির আপ্যায়ন সবার জন্য।  

সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই দেখা গেল ডলি মামি হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। এই ডলি মামির ব্যাপারে আমাদের খুব সাবধান করে দেওয়া হয়েছে। এনার রান্নার হাত দুর্দান্ত এবং উনি একবারে আট-দশ পদ রেঁধে লোকজনকে খাইয়ে মেরে ফেলতে পারলে বাঁচেন। এমন কুখ্যাতি শুনে দুপুরের ভাতের জন্য আর তর সইছে না। যদিও মামির ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া মিষ্টি মেয়ে মালিহা মুচকি হেসে ক্রমাগত মাথা নাড়ছে। তাদের আয়োজন নাকি খুব সামান্য, ‘মা আজকে রাঁধেইনি তেমন...’। পেছন থেকে ফিঁচেল হাসিতে দুষ্টু ছেলে আলভীও যোগ দিল। আমরা খুব আশ্বস্ত হলাম। এর মানে, আজকে হুলুস্থুল রকমের রান্না হয়েছে।  

ডলি মামির রান্নার চুম্বক অংশ
ডলি মামির রান্নার চুম্বক অংশ

লাঞ্চের আগে হালকা চা-নাশতার বেজায় ভারি পর্ব সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। তবে পথে নয়, আকাশে। ডলি মামির ছাদবাগান দেখতে। সেখানে ফুলের গাছ, শিমের মাঁচা ইত্যাদি পাশে এক আশ্চর্য বস্তুর দেখা মিলল। তা হলো, ছোট ছোট আকারের বনসাই । ‘বনসাই’ জাপানি শব্দ। গাছের ডাল ছেটেছুটে, তার বৃদ্ধিতে লাগাম পড়িয়ে বামন করে রাখার বিচিত্র শিল্প এই বনসাই। বিশাল দেশি গাছগুলোকে অমন ক্ষুদ্র, মিনিয়েচার আকৃতিতে দেখে তাক লেগে গেল সবার। কোনো শিল্প-সমঝদার চোর এই দুর্লভ সংগ্রহের খোঁজ পেলে রোজ রাতে দালানের পাইপ বেয়ে হানা দিত নিশ্চিত। বনসাইগুলোর বাজারদর কত হবে, কল্পনা করতে করতে লাঞ্চের সময় চলে এল। সিঁড়ির দিকে হল্লা করে পা বাড়াল রন আর তাফসু মিয়া।

ইয়া বড় মাছের পেটি, পাঁচ রকমের সবজি আর চপ-কাবাবযোগে লাঞ্চটা হলো সেই রকম পেটচুক্তি। তবে এ নাকি কিছুই না, রাতের আয়োজনই নাকি আসল—এ রকম একটা হালকা ইশারা দেওয়া হলো। ‘বেশি খাইয়ে মেরে ফেলা’ কথাটার ভেতর মনে হয় কিছুটা হলেও সত্যতা আছে।

বিকেল গড়ানোর আগেই বেরিয়ে পড়লাম আমরা। উদেশ্য, মিষ্টি কেনা। খুলনার মেয়ে ঝুমু আপু তার বাড়ি এসেছে অনেক দিন বাদে। যত মামা-খালা আছেন, সবার বাড়িতে ঢুঁ মেরে মিষ্টি দিয়ে আসা হবে, এই তার ইচ্ছা। অতএব আমরা তার ইচ্ছেপূরণের সঙ্গী হলাম। আলভী আর মালিহা, দুই ভাইবোনও আমাদের সঙ্গে আছে। গালগল্পে ফুটপাত সরগরম করে চলছি সবাই।

ছাদবাগানের বনসাই সংগ্রহ
ছাদবাগানের বনসাই সংগ্রহ

দুই পা এগোলেই একটা করে মিষ্টির দোকান চোখে পড়ছে। মজার ব্যাপার, তাদের সব কটার নাম প্রায় একই। ‘সাতক্ষীরা ঘোষ ডেইরি’। সাইনবোর্ডের নিচে আবার মোটা করে লেখা, ‘আমাদের কোথাও কোনো শাখা নেই’। এক-আধটু উঁকি দিতে দেখা গেল, সবার দেয়ালে ফটোফ্রেম টাঙানো আর তাতে গাঁদা ফুলের মালা ঝুলছে। ছবির নিচে ছোট করে লেখা: ‘প্রোপ্রাইটর পরিতোষ ঘোষ’। নাম এক হলেও একেক দোকানের পরিতোষ বাবুর চেহারা একেক রকম। কারও মুখে একচিলতে হাসি, কারও চোখে চশমা-আঁটা গাম্ভীর্য। সব মিষ্টির দোকানের একজন করে পারসোনাল পরিতোষ ঘোষ আছে দেখছি।
এই পরিতোষ-রহস্য ভেদ করা আমাদের মতো মামুলি ঢাকার লোকের কম্ম নয়। সুতরাং, আমরা ও লাইনে না গিয়ে থরে থরে সাজিয়ে রাখা মিষ্টির থালা বরাবর লোভী মাছির মতো তাকিয়ে রইলাম। রসগোল্লার পাশে কাঁচাগোল্লা স্তূপ করে রাখা। বুন্দিয়া লাড্ডুর ডানে কালোজামের থালা। স্পঞ্জ মিষ্টির বাঁয়ে চমচমের সারি। নিচের তাকে গুড়ের সন্দেশ, তো ওপরের র‍্যাকে ছানার সন্দেশ। রস জবজবে জিলিপির অদূরেই মালাই চাপের বাটি চুপচাপ।

স্বাদ পরখের অজুহাতে কয়েক দোকানের মিষ্টি চেখেও দেখা হলো। নাহ্, পরিতোষ বাবুরা ভিন্ন হলেও সব দোকানে মিষ্টির স্বাদ অভিন্ন রকমের দুর্দান্ত। মুখে দিলেই গলে যায়, এমন মখমলের মতো মোলায়েম। সুতরাং খুলনা শহরের সব পরিতোষ ঘোষের স্বর্গলাভ কামনাপূর্বক মিষ্টির অর্ডার দেওয়া শুরু হলো।

ভাইয়া-আপুর বিল মেটাতে সময় লাগছে। আলভীটাও গেছে অটোরিকশা খুঁজতে। এই ফাঁকে রেন আর আমি চারপাশটা চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। স্কুল আর কয়েকটা স্টেশনারি দোকান ছাড়া খুব বেশি কাঠামো নেই এদিকটায়। রাস্তার ওধারের নতুন চুনকাম করা দেয়ালটায় নানান উক্তি-বাণী লিখে চুনকামের নিকুচি করা হয়েছে। সময় কাটাতে আমরা আগ্রহ নিয়ে দেয়ালের বাণী চিরন্তনীগুলো পড়া শুরু করলাম।

মিষ্টির দোকানে রকমারি পশরা
মিষ্টির দোকানে রকমারি পশরা

‘ভীরুরা মরার আগে বারে বারে মরে। সাহসীরা মৃত্যুর স্বাদ একবারই গ্রহণ করে’—শেক্‌সপিয়ার। বাণীর পাশেই ইলেকট্রিক কেটলির বিজ্ঞাপন আঁকা, ‘আজই কিনুন অমুক কেটলি। তিন মিনিটেই গরম পানি’। কালো চকচকে পেটমোটা কেটলির আধাআধি খালি। বাকি পানি বোধ হয় শেক্‌সপিয়ারের সাহসীদের ওপর ঢেলে তাদের আলুসেদ্ধ করে মারা হয়েছিল। তিন মিনিটেই গরম পানি কোনো ছেলেখেলা না।
পরের বাণী আরও ইন্টারেস্টিং। ‘সত্যকে ভালোবাসো, কিন্তু ভুলকে ক্ষমা করো।’ —ভলতেয়ার। ভলতেয়ারের পাশেই যমদূতের মতো দাঁড়িয়ে ইলেকট্রিক কেটলিটা। ভুলকে ক্ষমা না করলে তার জন্য আছে তিন মিনিটেই গরম পানি। ফরাসি নবজাগরণের সাহিত্যিক ভলতেয়ার যদি ঘুণাক্ষরেও জানতেন যে শ–খানেক বছর পরে বাংলাদেশে তাঁর বিখ্যাত উক্তিতে এভাবে ফুটন্ত গরম পানি ঠেলে দেওয়া হবে, তাহলে লেখালেখি বাদ দিয়ে পরিতোষ বাবুর মিষ্টির দোকানের ময়রা বনে যেতেন নিশ্চিত।
আলভী চলে এসেছে অটোরিকশা খুঁজে নিয়ে। মিষ্টি হাতে ভাই-আপুও তৈরি। বাড়ি বাড়ি সেগুলো বিলিয়ে বিকেল গড়িয়ে এল। ফেরার পথে নিউমার্কেটে থামা হলো।

নিউমার্কেটে মানেই নস্টালজিয়া। ছোটবেলায় বাবা-মার হাত ধরে কত ঘুরে বেড়ানো হয়েছে ঢাকার নিউমার্কেটে। মাথা ঝাঁকিয়ে ঝুমু আপুও সায় দিল, খুলনার এই সাজানো–গোছানো নিউমার্কেটে তারও কত স্মৃতি আছে বাবার সঙ্গে। আজকে সেই বাবারা কেউ নেই। রয়ে গেছে কন্যারা। নিউমার্কেটে আসলে সেই কন্যাদের সবার আগে তাদের বাবাদের কথা মনে পড়ে।

বড় চত্বরটা ঘিরে দোকানের সারি। লোকে কিনছে কম, আড্ডা দিচ্ছে বেশি। নিউমার্কেটের সফট আইসক্রিম নাকি বেশ বিখ্যাত। সত্যতা যাচাইয়ের জন্য সবার হাতে হাতে উঠে এল আইসক্রিমে কোন। দরাজ হাতে দশে নয় দিয়ে দেওয়া যায় অনায়াসে। সূর্য ঘনিয়ে সন্ধ্যা তখন। আইসক্রিম ফুরালে ডুবন্ত সূর্যটাকে শূন্য কোনে পুরে ফেলা হলো।

পড়ন্ত বিকেলে খুলনা নিউমার্কেটে। বাঁ থেকে আলভী, ঝুমু আপু, রেন আর লেখিকা। সামনে বড়জন রন আর ছোট তাফসু মিয়া
পড়ন্ত বিকেলে খুলনা নিউমার্কেটে। বাঁ থেকে আলভী, ঝুমু আপু, রেন আর লেখিকা। সামনে বড়জন রন আর ছোট তাফসু মিয়া

রন-তাফসু মিয়াকে বেলুন কিনে দেওয়া হয়েছে। তারা ইচ্ছে করে সেগুলো ফাটিয়ে বিকট শব্দে পিনিক লাগিয়ে দিচ্ছে। আমাদের খিদেটাও ফুলেফেঁপে বেলুনের আকার নিয়েছে। আইসক্রিমটা ছিল মিষ্টি স্টার্টারমাত্র। গোটাকতক ছবি খিঁচে ঢিমেতালে ফেরার পথ ধরলাম।

মামার বাসায় রাতের জবরদস্ত ডিনার ছাড়াও আর কিছু অপেক্ষা করছিল। এ বাড়ির আরেক সদস্য, যাকে সারা দিন দেখা যায়নি, সেই মৌসুমীকে দেখা গেল রাঙতামোড়া অনেকগুলো বাক্স নিয়ে হাজির। মৌসুমী হলো ডলি মামির ছোট বোন। বিশ্ববিদ্যালয় ডিঙিয়ে চাকরিতে ঢুকেছে। খুব সম্ভবত সে তার এ মাসের বেতনের পুরোটা জলে বিকিয়ে দিয়ে এসেছে। ঢাকার মেহমানের জন্য তার উপহারের ঝোলা থেকে জাদুর টুপির মতো একে একে বেরোতে লাগল ছোট-বড় সবার জন্য কত কী। মুহূর্তেই রন একটা খেলনা জিপ গাড়ির গর্বিত মালিক বনে গেল। আর টিনের রিকশা পেয়ে তাফসু মিয়াও আত্মহারা। ঘোষণা দিয়ে ফেলল, সে বড় হয়ে জার্মানি ছেড়ে বাংলাদেশে এসে কখানা রিকশা কিনে ভাড়া খাটাবে। কতগুলো ঝলমলে রঙিন রিকশার মহাজন হওয়াটা আপাতত তার ‘এইম ইন লাইফ’।

উপহার পর্ব শেষ হতে না হতে শুরু হলো খাদ্যপর্ব। আয়োজনের পশরা দেখে শুকনো জার্মান রুটি চিবানো এই আধপেটা প্রবাসীর ভিরমি খাবার জোগাড়। শেষ কবে এত পদ একসঙ্গে দেখেছি, মনে পড়ছে না। চিকেনের লাল রোস্ট আর সাদা কোরমা দুটোই পাতে চড়ালাম। ডিমের মালাইকারিও লাফিয়ে উঠে এল আপনা থেকেই। আর খুলনার বিখ্যাত গলদা চিংড়ি এড়িয়ে যাওয়া তো রীতিমতো ফৌজদারি অপরাধ। পোলাওয়ের ঢিবির পাশে নধর দুটো চিংড়ি বসালাম। তাই দেখে কাচ্চি বিরিয়ানির গামলাটা কেমন ভুরু কুঁচকে তাকাল। ‘আচ্ছা, খাচ্ছি, খাচ্ছি’ বলে তাকেও তুলে নিলাম এক হাতা। টমেটোর সালাদ, লেবু আর কাঁচা মরিচের তাজা ঘ্রাণে মাতাল মাতাল লাগছে। ধুর, কে যে কবে লিখছিল, ‘মামি এল লাঠি নিয়ে, পালাই পালাই’। সেই লোকটাকে ধরতে পারলে আজকে টেবিলে বসিয়ে ডলি মামির রান্না খাইয়ে তাবৎ মামি–সমাজের দুর্নাম ঘুচিয়ে দিতাম।

বাদশাহি ভোজনের সাইড এফেক্ট হিসেবে চোখের পাতা ঢুলুঢুলু করছে। কুমিরের হাঁয়ের সমান কতগুলো প্রমাণ সাইজের হাই তুলে দিনটার ইতি টানলাম আমরা। ভোরে উঠতে হবে কালকে। নদীর ঘাটে রিভার ক্রুজ অপেক্ষা করবে আমাদের জন্যে। টপাটপ লঞ্চে চড়ে বসতে হবে সময়মাফিক।

ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে ঘুমের তোড়জোড় শুরু হলো। ডলি মামি একফাঁকে এসে জানতে চাইল, ‘সকালের ব্রেকফাস্টে গরমাগরম পরোটা চলবে নাকি কখানা ফুলকো লুচি?’ জবাবে আমরা অস্ফুট একধরনের আওয়াজ তুললাম, যার মানে হ্যাঁ-ও না আবার না-ও না, কিংবা দুটোই। একবারে খালি পেটে কে কবে অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়েছে। তা ছাড়া, এ তো শুধু একপেশে ঘুরে বেড়ানো নয়। এ হলো, আধেক ভ্রমণ, আধেক ভোজন। (চলবে)

লেখক: ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার জার্মানির মিউনিখে একটি ক্লিনিক্যাল রিসার্চ সংস্থায় কর্মরত

ছবি: ডা. রোনে সুজন ক্লোদ সরকার

প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২: ১১
বিজ্ঞাপন