ঢাকার খুব কাছেই এক দিনে গিয়ে চলে আসা যায় এমন ট্যুরিস্ট স্পটগুলো এখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অল্প সময়ে পরিবার বন্ধু ও প্রিয়জনদের সঙ্গে নিয়ে চলে যেতে পারেন ঢাকার কাছে নারায়ণগঞ্জের দক্ষিণ-পূর্বে বঙ্গদেশের প্রাচীনতম রাজধানী সোনারগাঁয়ে। এখানে দেখার মতো রয়েছে দারুণ সব স্থাপনা। ঢাকার খুব কাছে হেরিটেজ ট্যুরিজমের জন্য এর চেয়ে ভালো জায়গা আর হতে পারে না।
প্রাচীনকালে এর নাম ছিল সুবর্ণগ্রাম। ঈশা খাঁ ছিলেন এ অঞ্চলের শাসক। তাঁর স্ত্রী সোনাবিবির নামানুসারে এর নাম সোনারগাঁ রাখা হয়। সোনারগাঁ বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ জেলার একটি উপজেলা। ঢাকা থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এর অবস্থান। একসময় সোনারগাঁ ছিল মসলিন কাপড় তৈরির প্রসিদ্ধ স্থান। সোনারগাঁয়ে তৈরি মসলিনের বিশ্বজোড়া খ্যাতি ও কদর ছিল, যে ঐতিহ্য এখন আবার ফিরে আসছে নতুন রূপে।
এখানে রয়েছে সোনারগাঁ লোকশিল্প জাদুঘর। বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের বহু নিদর্শন এই জাদুঘরে দেখতে পাবেন আপনি। যে বাড়িতে জাদুঘর করা হয়েছে, তার আদি নাম বড় সরদারবাড়ি। এই সোনারগাঁ লোকশিল্প জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা দেশের কিংবদন্তি শিল্পী, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। এটা ছিল তৎকালীন বাংলার শাসক ঈশা খাঁর বাড়ি। বলা যেতে পারে, এটি মুসলিম ঐতিহ্যের এক অনন্য স্থাপনা। বাংলার স্থাপত্যশৈলীর সব নিদর্শন যেন একসঙ্গে গাঁথা এই বাড়িতে।
বহুল আলোচিত এই বাড়িটির আয়তন ২৭ হাজার ৪০০ বর্গফুট। ৬০০ বছরের পুরোনো এই ভবনটির সংস্কার করে এর প্রাচীন রূপ ফিরিয়ে আনা হয়। ১৯৯৬ সালে জাদুঘরটি নতুনভাবে স্থাপন করা হয় শিল্পাচার্যের নামে। বিশাল এলাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত এখানকার লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের ভেতরে আছে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, কারুপল্লি আর বিশাল এক লেক। প্রতি শুক্রবার থেকে বুধবার, সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্য়ন্ত দর্শনার্থীদের জন্য তা খোলা থাকে। তবে শুক্রবার দুপুর ১২টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত জুমার নামাজের জন্য জাদুঘর বন্ধ থাকে। এবার এখানে কোথায় ঘুরে কী দেখবেন—তা দেখে নেওয়া যাক।
এক হাজার বছরের পুরোনো প্রাচীন এই শহর হারানো নগরী হিসেবে পরিচিত। রাস্তার দুই পাশে সুলতানি, মোগল আর পরে ব্রিটিশ সভ্যতার স্থাপত্য নিদর্শনসমৃদ্ধ প্রাচীন ও ভগ্নপ্রায় বিভিন্ন স্থাপনা রয়েছে এখানে। প্রশাসনিক প্রয়োজন ও ব্যবসা–বাণিজ্যের কারণে বিদেশি বণিকেরা এখানে এসে বসবাস করতেন। পানাম নগরে ৫২টি পুরোনো ভবন রয়েছে। অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে নির্মিত পানাম নগরীর প্রতিটি ভবনের সূক্ষ্ম কারুকাজে স্থানীয় কারিগরদের শিল্পদক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। এখানে যেকোনো সময় প্রবেশ করা যায়। প্রবেশ ফি জনপ্রতি ১৫ টাকা।
ভারতের আগ্রায় সম্রাট শাহজাহানের বেগম মমতাজ মহলের নামানুসারে তাজমহলের আদলে ২০০৮ সালে এখানে নির্মিত হয় বাংলার তাজমহল। সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এটি খোলা থাকে, জনপ্রতি ১৫০ টাকা ফি দিয়ে ঢোকা যাবে।
মেঘনা নদীর বুকে জেগে ওঠা একটি চর এটি, যার নাম মায়াদ্বীপ। একটা দারুণ নৌকা ভ্রমণ হয়ে যেতে পারে এই দ্বীপে গেলে।এ ছাড়া এখানে আরও অনেক কিছু দেখার রয়েছে। লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরের প্রবেশপথ থেকে বেরিয়ে পশ্চিম দিকে গেলেই দেখতে পাবেন প্রাচীন কীর্তি মুসলিম স্থাপত্য গোয়ালদী আলাউদ্দিন হোসেন শাহী মসজিদ। মোগলাপাড়া বাজারের পশ্চিমে পাবেন প্রাচীন সব ইমারত, ১২ আউলিয়ার মাজার, হজরত শাহ ইব্রাহিম দানেশ ও তাঁর বংশধরদের মাজার। আরও রয়েছে সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহর সমাধি, পাঁচ পীরের মসজিদ ও মাজারসহ আরও অনেক কিছু।
আপনি যেকোনো সময় ঢাকার যেকোনো প্রান্ত থেকে গুলিস্তান এসে বাসে করে সোনারগাঁয়ে যেতে পারেন। ঢাকার গুলিস্তান থেকে সোনারগাঁ যেতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগে। গুলিস্তানের বোরাক, দোয়েল বা স্বদেশ পরিবহনে সোনারগাঁয়ের মোগরাপাড়া চৌরাস্তায় নামতে পারবেন। সিএনজি বা রিকশা নিয়ে সরাসরি যেতে পারবেন লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরে। সেখান থেকে ১০ মিনিটেই যাওয়া যায় পানাম নগরীতে। নন-এসি বা এসি—যেকোনো বাসেই আপনি যেতে পারেন। এ ছাড়া আপনি রিজার্ভ গাড়ি বা বাইকেও যেতে পারবেন খুব সহজেই।
এখানে খুব ভালো মানের সব রেস্তোরাঁ রয়েছে। দেশি বা কন্টিনেন্টাল সব খাবারই পাওয়া যায় এখানে। কেউ যদি রাতে থেকে যেতে চান, তবে সেখানে ভালো মানের বেশ কিছু রিসোর্ট রয়েছে। এ ছাড়া সরকারি অতিথিদের জন্য রয়েছে জাদুঘর ও উপজেলা প্রশাসনের নিজস্ব গেস্টহাউস বাংলো।
সারা সপ্তাহের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলতে পরিবারের সবাই বা বন্ধুরা মিলে তো বটেই, একাই চলে যেতে পারেন সোনারগাঁয়ে। সেখানকার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলো কালের সাক্ষী হয়ে যেমন আমাদের গৌরবময় অতীতের কথা মনে করিয়ে দেবে, তেমনি মসলিন, জামদানি আর নকশিকাঁথাসহ কারুশিল্পের অনন্য নিদর্শনসমৃদ্ধ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট সোনারগাঁ আমাদেরকেও করবে ঋদ্ধ।