অনেক দিন পর আবারও প্রাণের উচ্ছ্বাসে মেতে উঠতে বাংলাদেশের একমাত্র চিরহরিৎ বনভূমি রেমা-কালেঙ্গার কালেঙ্গা অংশে গেলাম সেদিন, সঙ্গে অল্প করে বর্ষারণ্য সাতছড়ি। সর্বশেষ গিয়েছিলাম ২০১৫ সালে দ্বিতীয়বার, তার আগে ২০১৪ সালে। দুবারই গিয়ে বনের প্রতি মানুষের যথেচ্ছাচারের নমুনা দেখে মন ভীষণই খারাপ হয়েছে; মেজাজ বিগড়েছে ভয়ংকর। এবার যাওয়ার আগেই ভাবছিলাম, নিশ্চয়ই আগের চেয়ে বনের হাল আরও বিপর্যস্ত হয়েছে!
সেসব স্থান নিয়ে আপনারা লেখা পড়ছেন, সেসব স্থানের সাধারণ তথ্য-উপাত্ত আপনার গুগলে প্রচুর পাবেন। আমি শুধু আমার এবারের ভ্রমণ অভিজ্ঞতাটুকু সংক্ষেপে শেয়ার করে নিচ্ছি। দেখেছি বেশি, ছবি তুলেছি কম। ছবি যাও তুলতে চেয়েছি, প্রাণী তেমন পাইনি। বাকিটা বুঝে নিন আপনারা।
ঢাকা থেকে সকালে রওনা হয়ে পথের নানান ঝক্কি পার করে, দুপুরে হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে নেমে আগে থেকে ঠিক করা সিএনজি অটোরিকশায় চেপে যখন ছুটছি, স্মৃতিরা আন্দোলিত করছে আমাকে। আর দেখছিলাম, কথিত উন্নয়নের মহোৎসব। কালেঙ্গা পর্যন্ত মাঝের এক কিলোমিটার ভাঙাচোরা বাদে বাকি রাস্তা মোটামুটি ভালো। লাসু ভাই পরিচালিত নিসর্গ কটেজে ব্যাগটা রেখেই ছুট পেটপুজোয়। সেখানেই থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। খেয়ে একটুও দেরি না করে বনে প্রবেশ; টিকিট কাউন্টার বন্ধ, আমাদের দেখে বন বিভাগের লোকজনেরও ভ্রুক্ষেপ নেই। বিজিবি ক্যাম্প পার করে ছোট মাঠে একটা বাড়ি দেখি, লেখা ‘ইকো কটেজ’। দেখে হাসি পায়! টিনের ছাউনি ছাড়া সবই ইট সিমেন্ট (রড আছে কি না জানি না)।
আমরা গাইড নিই না। আগের দুবার সুজন নামে একজন গাইড ছিলেন। ফসলের খেতে কাজ করছেন কৃষকেরা, ট্রাক্টরের বিকট আওয়াজ। কৃষির অগ্রগতিতে যান্ত্রিকীকরণের বিকল্প নেই, কিন্তু বন-জঙ্গলের পাশে কি এসব মানায়? মূল বনে প্রবেশের আগে চোখে পড়ে গ্রামগুলোয় বসতি বেড়েছে। অর্থাৎ বন হালকা হচ্ছে এবং সত্যিই তাই। হাতে গোনা কয়েক রকম পাখির ডাক শুধু। সঙ্গীদের বলছিলাম যে আগের দুবার মূল বনে প্রবেশ করতেই চারপাশের গাছগুলোয় নানা জাতের কাঠবিড়ালি রীতিমতো কিলবিল করত, তাদের চিৎকার–চেঁচামেচি, বিচিত্র পাখির কূজন, পত্রপল্লবে বাতাসের শব্দ, বানর-হনুমানদের ঝগড়া-দাপাদাপি, ফড়িং-প্রজাপতি-ভ্রমরের গুঞ্জনে অবগাহন করেছি। এবার পতঙ্গ দেখেছি, মাঝে মাঝে চোখের সামনে দিয়ে উড়ে উড়ে যেন জানান দেয়, ‘আমরা আছি তো কিছু বেঁচে এখনো; কত দিন থাকব জানি না।’
দেখলাম, প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে কথিত সামাজিক বনায়নের ছড়াছড়িও বাড়ছে। বনকে কেন্দ্র করে বনের ভেতর ও বনের আশপাশের বাসিন্দাদের সম্পৃক্ত করেও অনেক কিছু করা যায়। বন ও বনকেন্দ্রিক প্রাণবৈচিত্র্যকে বাঁচিয়েও সংশ্লিষ্ট মানুষগুলোর সুস্থ স্বাভাবিক জীবন-জীবিকা নিশ্চিত করা যায়, কমিউনিটি ট্যুরিজম গড়া যায়। আমাদের দেশে এসবের প্রয়োগ খুবই কম এবং বিচ্ছিরি রকমের ধীরগতির। এসব ভাবতে ভাবতে আর নিজেদের মধ্যে আলাপ করতে করতে বনপথেই কাঠুরেদের সংখ্যাধিক্যে বিরক্ত হচ্ছিলাম। বিরক্ত আরও বেশি হচ্ছিলাম বনপথে নানা মোড়কের পলিথিন পড়ে থাকতে দেখে। হঠাৎ হঠাৎ কয়েকটা পাখি-পতঙ্গ-বানর চোখের সামনে এসে আর কাছে–দূরে ডেকে যেন অস্তিত্ব জানান দিয়ে যাচ্ছিল। খেয়াল করি, প্রায় একটানে ডেকে যাওয়া ঝিঁঝির সুরও যেন কমে গেছে।
যেতে যেতে এক জায়গায় পথ যেখানে সরু, সেখানে বনের একপাশ থেকে ধীরপায়ে সাবধানে হেঁটে যাচ্ছিল একটা পাখি। আমরাও গতি ধীর করে দিই। পাখিটা টের পেয়ে উড়াল দিয়ে বনের আরেক পাশে ঢোকে। ছায়ার মধ্যে চিনতে না পারলেও বনমোরগ বলে সন্দেহ হলো। দুই দলে ভাগ হয়ে একদল পিছু নিয়ে গহিনে ঢুকতেই চিৎকার শুনে পাখির পিছু নেওয়া বাদ। শব্দের উৎসে গিয়ে দেখি দলের একজনের দুটো পা ফসলের মাঠের আলের কাদায় আটকে গেছে। পরে শুনেছিলাম সে নাকি সুন্দর একটা রঙিন ব্যাঙ দেখে তার পিছু নিতে গিয়ে এ হাল হয়েছে। তাকে ছাড়িয়ে এনে ফিরতি পথ ধরি। একটা জায়গায় দেখি দুই হনুমান ঝগড়া করছে। পুরুষটা একটা পর্যায়ে নীরবে ওখান থেকে দূরে চলে গেল। নারীটার শরীর দেখে বোঝাই যাচ্ছিল সে গর্ভবতী। সঙ্গীদের একজন বলল, গর্ভাবস্থায় মুড সুইং হয় কিন্তু পুরুষ হনুমান সেটা বুঝতে না পারায় বকা খাচ্ছিল।বনের হাল দেখে ব্যথিত মনে সেদিনের মতো ফিরে আসি কটেজে।
সঙ্গীদের কেউ কেউ চাইছিল ট্রেকের সময় বৃষ্টি হলে আরাম হতো, আমি প্রকৃতিকে বলছিলাম বৃষ্টি না দিতে এবং হয়ওনি। বরং ঝকঝকে রোদে নীল আকাশে সাদা মেঘের বিচিত্র অবয়ব ভেসে বেড়াচ্ছিল। কেন জানি প্রকৃতি প্রায়ই আমার কথা রাখে! তবে সন্ধ্যায় আর রাতে অল্প করে বৃষ্টি ঝরে পরিবেশটা শীতল করেছিল। পরে আবার ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘে শুক্লা চতুর্থীর একফালি চাঁদ দর্শন দিয়েছিল। যাহোক, সান্ধ্য আড্ডায় আমাদের যে কত রকম গল্প! তবে ঘুরেফিরে বন-জঙ্গলের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নানান তথ্যসমৃদ্ধ জ্ঞান বিনিময়, চিন্তাভাবনা, ভ্রমণ অভিজ্ঞতা, বন-জঙ্গলের হাল নিয়ে নিজেদের আক্ষেপ-বেদনার কথাই এসেছে বেশি। আড্ডায় গান জানা সঙ্গীরা গেয়েছে, আমরা বাকিরা বেসুরো গলা মিলিয়েছি।
পরদিন রৌদ্রকরোজ্জ্বল সকালে নাশতা খেয়েই আবার বনে ছুট। আজ অন্য পথে! বন্য প্রাণী-পাখিদের জন্য তৈরি কৃত্রিম জলাধারকে ঘিরে একটা পাক দিই, মাছরাঙাদের তড়িৎ শিকার দেখি। জরাজীর্ণ ওয়াচটাওয়ারে ঝুঁকি নিয়ে উঠতে উঠতে আশিক দিওয়ানা প্রেমিক-প্রেমিকাদের দেয়াললিখন দেখি। নেমে এসে বনপথে হাঁটতে হাঁটতে বিরাটাকৃতির একটা কালো কুচকুচে কেঁচো দেখে একজন তো ভয়েই প্রায় আধমরা। তো আমরা খুব চেষ্টা করেছি প্রাণবৈচিত্র্য উপভোগ করতে; কিন্তু ক্রমশ বন হালকা হওয়া এবং বনজীবীদের দৌরাত্ম্যে সেসব আর পারলাম কই? তবে সরকার, স্থানীয় একটা সংগঠন, দেশি-বিদেশি বেসরকারি সংস্থা, স্থানীয় জনগণকে নিয়ে নাকি বন বাঁচাতে তৎপর। বাস্তবে কতটুকু কী জানি না, জানতে হলে দীর্ঘদিন এখানে অবস্থান করতে হবে। অবশ্য স্থানীয়দের মধ্যে আদিবাসীরাও রয়েছেন, যাঁরা যতটুকু বিশ্বাস করি, বনকে বাঁচাতে চান। দুপুর গড়াতেই কটেজে ফেরার পথে এক পরিবার চশমা হনুমান দেখে দলের একজন বলে উঠল (সে ওই প্রাণী প্রথম দেখেছিল), ‘আরে গাছের ডালে কে সানগ্লাস পরে বসে আছে?’
দুপুরের আহার সেরে রাত পর্যন্ত কটেজে আড্ডা মেরেই কাটাই। রাত গভীর হলে হাঁটতে বেরোই। কয়েকবার বনের ভেতরে যাওয়ার বাসনা জাগলেও যাইনি। বনরক্ষী ও বিজিবি ফিরিয়ে দিত। আমরা গিয়ে বসলাম আমার আগের দুবারগুলো এসে থাকা নিসর্গের আরেকটা কটেজের মুখোমুখি একটা পুকুরপাড়ে। ওই কটেজটা চালাত স্বপন ভাই, চালাতে না পেরে বন্ধ করে দিয়েছেন। পুকুরপাড়ে নিশাচরদের শব্দ আর আমাদের কথাবার্তা ছাড়া চারদিক আর কোনো শব্দ নেই। একটু পর দূরে আলো দেখি আর দুজন মানুষের কথা শুনি, তারা স্থানীয় ভাষায় শ্লোক বলছিল, ওদিকে ফসলের খেত। একটা পর্যায়ে সেই দুজন, একজন কিশোর আর একজন শিশু, পুকুরপাড়ে এসে আমাদের সামনেই পা ধুয়ে ফিরে গেল। তারা আসলে ধানখেতে মাছ ধরতে গিয়েছিল। শিশুটা বড়টাকে বারবার বলছিল পোনামাছগুলোকে ছেড়ে দিতে কিন্তু কিশোরটা পাত্তাই দিচ্ছিল না। আমরাও বলেছিলাম, শোনেনি। আমরা মন দিই আমাদের আড্ডায়।
কালেঙ্গা সব ঋতুতেই সুন্দর (বন সব সময়ই তার মতো করে সুন্দর)। তবে বসন্তে, জ্যৈষ্ঠে আর হেমন্তে নাকি বনের বৈচিত্র্য বাড়ে! বসন্তকালের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সবকিছু নাকি বনে দেখা মেলে, বনের প্রাণীদের মাঝে নাকি তখন ফুলমধুর উৎসব চলে। জ্যৈষ্ঠে নাকি প্রাণীরা ফল উৎসব করে। আর হেমন্তে ধান পাকার সময় ফসলের মাঠে টংঘর বানিয়ে রাত জেগে পাহারা দেওয়া হয়, যেন বন্য শূকর এসে ধান খেয়ে না ফেলে।
পরদিন সকালে লাসু ভাইকে তার পাওনা মিটিয়ে পথ ধরি সাতছড়ির দিকে। লাসু ভাই একদিক থেকে একজন লড়াকু মানুষ।
আমরা সাতছড়ি পৌঁছানোর আগে চা-বাগান দেখি। সাজানো–গোছানো পরিপাটি এসব বাগান, এই অর্থকরী ফসল, শরীর-মন চাঙা করা এই পানীয়ের পেছনের গল্প যে কতটা নির্মম! চা–শ্রমিকদের জীবনমানের ঘোড়ার ডিমের উন্নতি হয়েছে। তাদের সংগ্রামী জীবন, তাদের প্রতি নিপীড়নের শেষ কোথায়? আসলে বেড়াতে গিয়ে বরাবরই ভালো–মন্দের একধরনের মিশ্র অনুভূতি হয় কেন জানি। সাতছড়ির ফটকে ঢুকে টিকিট কেটে বনপথে ঢুকতেই দেখি সেতুটা ভাঙা। কেন সেতু? নিচ দিয়ে ছড়া বা ছড়ি, যদিও সেটা শুকনা খটখটে। নিচে নেমে আবার উঠতে হয় ওপারে। সাতছড়িতে আমরা এক ঘণ্টারও কম সময় ছিলাম। তাতেই যা দেখেছি! দেখেছি বলতে, বেহাল বন। দর্শনার্থীদের বেড়ানোর প্রতি কর্তৃপক্ষের অযত্ন অবহেলা, আবার বনের প্রতিও অনাদর এবং ‘সম্মানিত দর্শনার্থী’দের প্লাস্টিকপ্রীতি। আরে বাবা! যদি বনকে বুনো রাখতে চান তো তাই রাখেন। নয়তো না। কোনোটাই তো হচ্ছে না ঠিকঠাক। আমি আর আমার সঙ্গীরা পুরোমাত্রায় বনকে বুনো পরিবেশেই দেখতে চাই।
আমরা ফিরি, ফিরতে হয়। প্রতিবার বিশেষ প্রকৃতির কাছে কোথাও গিয়ে ফেরার সময় আমার প্রচণ্ড মন খারাপ হয়। আসলে ফিরি বলতে ফিরি না। ব্যক্তিগতভাবে আমি ফিরি না। আমার ফেরা হয় না। আমি শুধু যাই আর যাই, যেথায় আমার প্রাণের সঞ্চার, সেই প্রকৃতির মাঝে।
ছবি: লেখক