মেঘ, পাহাড় আর নীল জলের পদাবলি
শেয়ার করুন
ফলো করুন

পাহাড়ের ওপাশে সূর্যটা সবে ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভাঙছে। ভোরের আবছায়া চিরে তার রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে পুরো লেকে। আকাশ, লেক, দূরে থাকা বিশাল পাহাড় আর রাস্তায় ইতিউতি ঘুরে বেড়ানো রাতজাগা কুকুরগুলোও কেমন যেন এক লালরঙা আলোর চাদর জড়িয়ে আছে। শান্ত, শীতল লেকের দিকে তাকিয়ে থেকে অপার্থিব এক সৌন্দর্যের সাক্ষী হয়ে রইলাম। সবুজাভ পানিতে কোনো আলোড়ন নেই, নেই কোনো শব্দ, তবে আমার বুকের খুব গভীরের কোনো এক কুয়োতলায় যেন ছলাৎ ছলাৎ শব্দ পেলাম। শীতের শেষে লেকে পানি নেই, কিন্তু এই শান্ত লেক দেখেই আমার মনের নদীর দুই পাড় ভেসে যাচ্ছে!

লেকের বুক চিরে উঁকি দিচ্ছে সূর্যের হাসিমুখ
লেকের বুক চিরে উঁকি দিচ্ছে সূর্যের হাসিমুখ

আঁধার কালো নির্ঘুম রাতের পর এত সুন্দর সকাল দেখে আমরা নির্বাক। আমি দাঁড়িয়ে আছি লেকের পাশেই, তবে আমার ভিন্ন এক অস্তিত্বের অবয়ব তখন রক্তিম আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে দিগ্‌বিদিক।

বিজ্ঞাপন

রাঙামাটিতে আমাদের প্রথম সকালটাই ছিল এ রকম অলৌকিক। এরপর থাকার জন্য খুঁজে বের করলাম লেকের পাশের একটা হোটেল। রুমের পাশের বিরাট খোলা বারান্দা, আর সেই বারান্দা দিয়ে পুরো লেকটাই দেখা যায়। যেন পুরো পৃথিবী থমকে আছে আমার বারান্দায়।

শীতকালে শুকিয়ে যাওয়া শুভলং ঝর্নার সামনে লেখক
শীতকালে শুকিয়ে যাওয়া শুভলং ঝর্নার সামনে লেখক

নাশতা করে ঘাটে গিয়ে সারা দিনের জন্য একটা রিজার্ভ ট্রলার নিয়ে নিলাম। কাপ্তাই লেক ধরে রাঙামাটির সব স্পট ঘুরে দেখব। আমাদের শুরুটা হলো শুভলং ঝরনা থেকে। যদিও শীতের শেষে ঝরনা মৃতপ্রায়। কোনো পানিই ছিল না, তবু এর বিশালতায় মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। দূর থেকে দেখে মনে হয়, আকাশের একটা অংশ ছিদ্র হয়ে পানি পড়ে।

বিজ্ঞাপন

পরের যাত্রা ছিল সম্ভবত বরকল নামের একটি গ্রামে। চারদিকে লেক আর মাঝের এক পাহাড়ে ছোট্ট, ছিমছাম গ্রাম। এই গ্রামে নাগরিক কোলাহল এখনো স্থায়ী আবাস গড়তে পারেনি। পাহাড়ের চূড়া থেকে লেক আর দূরের পাহাড়গুলো অসাধারণ লাগছিল!
বরকল থেকে আমাদের যাওয়া পেদা টিং টিং আর চাং পাং। এগুলো মূলত রেস্টুরেন্ট, লেকের মধ্যে ছোট্ট টিলার মতো। চারপাশে লেকের পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ আর চারদিকে সবুজ আর সবুজ। এমন পরিবেশে ক্ষুধাও যেন অনেক বেড়ে যায়। তা ছাড়া সারা দিন ঘুরে ক্ষুধাও লেগেছিল প্রচুর। রাক্ষসের মতো পাহাড়ি খাবার খেলাম! তবে দাম অনুযায়ী খাবার তেমন ভালো লাগেনি।

বরকল থেকে দেখা কাপ্তাই লেক
বরকল থেকে দেখা কাপ্তাই লেক

খাওয়াদাওয়া শেষ, এবার রেস্টুরেন্টের পাশেই গাছের ছায়ায় বসে একটু আলোছায়ার খেলা দেখলাম। বিশুদ্ধ বাতাসে ভেসে আসছিল প্রকৃতির ঘ্রাণ, পাখিদের সুরে লুকিয়ে ছিল স্বাধীনতার গান। আহা, কী সুন্দর! কী সুন্দর!

একজন বিখ্যাত দার্শনিক বলেছিলেন, রাঙামাটি গিয়ে ঝুলন্ত ব্রিজে ঝুলে ঝুলে ছবি না তুললে নাকি মানসম্মান থাকে না! তাই নিজেদের মানসম্মান বাঁচানোর যুদ্ধে আমরা বেরিয়ে পড়লাম ঝুলন্ত ব্রিজের উদ্দেশে। কিন্তু আফসোস, বিপরীত দলে এত সৈন্য ছিল যে আমরা যুদ্ধে আর জিততেই পারলাম না! মানে, এমন মানুষ যে আমরা ঝুলন্ত ব্রিজে ঝুলতেই পারলাম না।

কাপ্তাই লেকে রাখা বাঁশের ওপর লেখক
কাপ্তাই লেকে রাখা বাঁশের ওপর লেখক

ঝুলন্ত ব্রিজ থেকে ট্রলার দিয়েই গেলাম পলওয়েল পার্ক। সৃজনশীলতার ছোঁয়ায় রাঙ্গামাটির অন্যতম সেরা বিনোদনকেন্দ্র হয়ে ওঠা, লেকঘেরা সাজানো-গোছানো পলওয়েল পার্কে আছে বৈচিত্র্যময় ল্যান্ডস্কেপ, অভিনব নির্মাণশৈলী ও একটু বসে আরাম করার জন্য ব্যতিক্রম স্থান, ঝুলন্ত ব্রিজের ছোট্ট রেপ্লিকাসহ আরও অনেক কিছু। এ ছাড়া এই পার্কের অন্যতম জনপ্রিয় স্পটটা হলো লাভ পয়েন্ট; আরও আছে নান্দনিক ডিজাইনের পলওয়েল পার্ক কটেজ এবং সুইমিং পুল। লেকভিউ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে লেক দেখতে দেখতে আর গল্প করতে করতে ফুরিয়ে গেল আমাদের সময়।

দিনের আলো যখন সন্ধ্যার বিশালতায় ডুবে যায়, ঠিক সেই সময়টায় ফিরে আসা আমাদের এক দিনের কুটিরে। বড় বারান্দার এক কোণে ছোট্ট কয়েকটা টুল পেতে আমরা বসি। পুরো সূর্য যেন বারান্দার ওপর কতক্ষণ ঝুলে রইল, এরপর টুপ করে ডুবে গেল। আর অচেনা কোনো জগত থেকে শ্যাম্পেনের বুদ্‌বুদের মতো একরাশ বিষণ্নতা উপচে পড়ল। এই সময় কথা বলতে হয় না, নৈশব্দের ভেতর ডুবে যেতে হয়, আমরা ডুবে যাচ্ছিলাম অতল আঁধারে। দূরে লেকের মধ্যে ইতিউতি ঘুরে বেড়ানো নৌকার টিমটিমে আলো জোনাক পোকার মতো জ্বলছে আর নিভছে। রাত বাড়ছে, ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে, সকালে দরজার ফাঁক দিয়ে খবরের কাগজ রেখে চলে যাওয়া হকারের মতো।

অপরূপ আর্জেন্টিনা ব্রিজ
অপরূপ আর্জেন্টিনা ব্রিজ

পরের দিন সকালে উঠেই রওনা দিলাম কাপ্তাইয়ের দিকে। পথিমধ্যে দেখে নিলাম বরগাং রিসোর্ট আর বের‍্যায়াইন্না রেস্টুরেন্ট। আসামবস্তির রাস্তা দিয়ে, আর্জেন্টিনা ব্রিজ পেরিয়ে সবুজ পাহাড় আর লেকের নীল জলরাশি দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম কাপ্তাইয়ে আমাদের প্রথম গন্তব্য নেভি ক্যাম্পে। এত সুন্দর একটা জায়গা, যেভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা আছে—প্রথম যারা দেখবে, তাদের চক্ষু চড়কগাছ হবেই। আমাদের চক্ষু রীতিমতো বটগাছ হয়ে গেল। এই কোন পাহাড়ে উঠছি, তো এই কোন লেকঘেঁষা সমতল ধরে হাঁটছি, আবার বিশাল বড় কনটেইনার দিয়ে বানানো সাঁকো দিয়ে রীতিমতো লেকের ওপর দিয়ে হেঁটে এলাম। এখানে যেমন অ্যাডভেঞ্চার আছে, তেমন আছে রিল্যাক্স করার উপকরণও। আর এই জায়গার বাতাসে যেন কোন মাদকতা ছড়ানো ছিল, বুক ভরে দম নিতে শান্তি লাগছিল খুব।

এরপর বাজারে এসে লেকের তাজা মাছ দিয়ে চলল আমাদের ভূরিভোজ। সঙ্গে পাহাড়ি মুরগিও ছিল, তবে হাড়ে কামড় দিয়ে বুঝলাম, এটা হয়তো পাহাড়ি তবে দেশের পাহাড় না, পাকিস্তানের পাহাড়!

খাওয়া শেষে ঢাকায় ফেরার টিকিটটাও করে নিলাম, টিকিট আর সময় ফিক্সড থাকলে নিশ্চিন্তে ঘোরা যাবে।

ভর সন্ধ্যায় কায়াকিং
ভর সন্ধ্যায় কায়াকিং

এখানে যেমন মুখরোচক খাবার মেলে, তেমনই এখানে তাঁবু করে রাতে থাকাও যায়—এ এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। পরে সুযোগ পেলে কাপ্তাই লেকের পাশে কোটি কোটি নক্ষত্রের নিচে কাটানো এক মায়াময় রাতের গল্প শোনাব। প্রশান্তি পার্কে কায়াকিংয়ের সুযোগও আছে। কায়াকিং আমার সব সময়ই প্রিয়, দেরি না করে দ্রুত নেমে গেলাম কায়াক বোট নিয়ে। পাহাড়ের ওপাশে সূর্য লুকাচ্ছে তার নিয়মে, এ পাশে চিকচিক করা পানির মধ্যে আমাদের দুইটা কায়াকিং বোট, সন্ধ্যা হবো হবো বাতাসে পাতলা কুয়াশার আস্তরণ। এমন সন্ধ্যার মুহূর্তগুলোকে পুষে রাখা গেলে কতই না ভালো হতো!

এবার ফেরার পালা। সব সময় কেন ফিরতে হয়? সন্ধ্যার বিষণ্নতা কেন বুক চুইয়ে আমার গভীরে ঢুকে যায়? নতুন ভোরের আলোটা কেন চিরাচরিত হতে হবে? আয়নার গায়ে নতুন প্রেমে পড়া তরুণীর যত্নে লাগিয়ে রাখা কপালের টিপের মতো এই সময়গুলোকে কেন পুষে রাখা যায় না? জানি না, উত্তর কোথাও খুঁজে পাইনি। এর উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই হয়তো একটা জীবন চলে যাবে।

পাহাড়ের চূড়া থেকে অসাধারণ কাপ্তাই লেক
পাহাড়ের চূড়া থেকে অসাধারণ কাপ্তাই লেক

দেয়ালে অবহেলায় ঝুলতে থাকা ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে একটা একটা করে ঝরে যাওয়া পাতার মতো একটা একটা দিন কেটে যাবে। আমরা মানবজাতি এর উত্তর খুঁজেই যাব দিনের পর দিন; যেমন আমাদের বাসটা তীব্র হেডলাইট জ্বেলে খুঁজে নিচ্ছে তার ফেরার পথটুকু। পেছনে পড়ে থাকছে রাঙামাটির সেই খোলা বারান্দা, সাপের মতো আঁকাবাঁকা পথ, জুম ঘরের একলা মাচাং, লেকের বুকে জোনাকির মতো জ্বলতে থাকা ছিপ নৌকা!
ছবি: লেখক

প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২২, ০৫: ০০
বিজ্ঞাপন