নদী সব সময়ই টানে। সভ্যতার শুরুটাই হয়েছে নদীর অববাহিকা থেকে। একেক ঋতুতে একেক রূপ নেয় নদী। ভরা বর্ষায় নৌকাভ্রমণ যেমন রোমাঞ্চের, তেমনি এই শীতে হাউসবোটে নদী ভ্রমণ দিতে পারে ভিন্ন রকমের ভালো লাগা। এমন সময়ে কাছের মানুষদের নিয়ে প্রশান্তিময় গন্তব্য হতে পারে ঢাকার কাছের হাউসবোটগুলো। সেই খোঁজই রইল আজ হাল ফ্যাশনের পাঠকদের জন্য।
রংগিলা বাড়ই
পদ্মা নদীতে লাক্সারি হাউসবোটে ডে ট্রিপের দারুণ আয়োজন নিয়ে আছে রংগিলা বাড়ই। শীত উদ্যাপন করতে বাড়ইয়ের নৌকাভ্রমণের ব্যবস্থা করা হয়েছে ঢাকার অদূরে দোহারে। পদ্মার সুপ্রাচীন নৌপথের নানা গল্প আছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে, নজরুলের গান কিংবা আবু ইসহাকের লেখায়। পদ্মাপারের প্রকৃতি ও জীবন সৌন্দর্যপিপাসুদের সব সময়ই কাছে টানে। ঢাকা থেকে পিক অ্যান্ড ড্রপ সার্ভিসসহ সহজ প্যাকেজে দিনে গিয়ে দিনে ফেরার প্যাকেজ আছে এখানে। আবার এক রাত পদ্মায় ভাসতে ভাসতে শীতের অনুভূতি উপভোগ করারও সুযোগ থাকবে রংগিলা বাড়ইয়ে বর্ষার আগপর্যন্ত।
পদ্মা নদীর দর্শন, চরচরান্তে ভ্রমণের সঙ্গে পদ্মার ইলিশ ও আঞ্চলিক সব ধরনের জিবে জল আনা খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। প্যাকেজের মূল্য জনপ্রতি ২ হাজার ৯৯৯ টাকা। ১২ জানুয়ারি পদ্মার পলিদ্বীপে হতে যাচ্ছে তাদের হিম উৎসব। ঢাকা থেকে মাইক্রোবাস অথবা মিনি ট্যুরিস্ট বাসে মৈনট ঘাট থেকে শুরু হয়ে চর আমিরাবাদ-মাওয়া ঘাট-পদ্মা সেতু-বাবুর চর-মৈনট ঘাট। সারা দিনের সফরের পরিকল্পনার রুটটি এ রকম হবে। খাবারে থাকছে ব্রেকফাস্ট-স্ন্যাকস-লাঞ্চ আর বিকেলে ক্যাম্পফায়ার ও বারবিকিউ। যেসব অতিথি রাতে থাকবেন, তাঁদের জন্য রাতের খাবার, সকালের নাশতা এবং পরের দিনের লাঞ্চ করে ফেরার সুযোগ থাকছে। পুরো সময় বাড়ইয়ের রান্নাঘরে প্রস্তুত হতে থাকবে দারুণ সব ট্র্যাডিশনাল খাবার, বিশেষ করে পদ্মার ইলিশ ও মুন্সিগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো থাকে তাদের মেনুতে। নৌবিহারের পাশাপাশি উপভোগ করতে পারবেন চরে ক্যাম্পফায়ার, বিচ ফুটবল ও ভলিবল। ইনডোর গেমস আর নদীতে ছিপ ফেলে মাছ ধরার সুযোগও থাকছে। নৌকায় আছে সব রকমের নিরাপত্তাব্যবস্থা। থাকছে প্রায় ৩০টি লাইফ জ্যাকেট, ১০টি বয়া, অগ্নিনির্বাপণের যন্ত্রপাতি আর ফার্স্টএইড বক্স। এ ছাড়া এই বোটে আছে ৮টি সুসজ্জিত ডিলাক্স রিভারভিউ রুম, সুবিশাল লাউঞ্জ ও টপার বেড। হোটেল পিলো আর কমফোর্টার দেওয়া হয়। প্রতিটি রুমের সঙ্গেই অ্যাটাচড টয়লেট। এ ছাড়া দুটি সিঙ্গেল বেড রয়েছে অতিথিদের জন্য। প্রতিটি রুমে লাগেজ স্পেস ডোর লক সিস্টেম, আরামদায়ক রিমোট অপারেটেড বক্স বা সিলিং ফ্যান, আধুনিক বাথরুম, প্রেশারাইজড পানির সংযোগ ও পরিষ্কার তোয়ালে আছে। জেনারেটর ও আইপিএস সুবিধা মিলবে এই বোটে। আনলিমিটেড চা আর বিশুদ্ধ পানি পাবেন। বুফে খাবার তো আছেই। এ ছাড়া দোলনা, ডেক টি-পি হাট, সুসজ্জিত বিশাল গ্রাস টার্ফ ছাদ, জুসবার ও ওপেন কিচেন আছে এখানে। যোগাযোগের জন্য কল করতে পারেন ০১৬৭৫৫৪৩২৬২ নম্বরে।
শীতলক্ষ্যা পাড়ের বিলাসবহুল বোট সার্ভিস
দুবাইয়ের মতো ইয়ট সার্ভিস ঢাকায় আছে, তা ভাবতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে চালু হয়েছে ক্যাটামেরন বোট বা ইয়ট সার্ভিস। কুড়িল বিশ্বরোড থেকে মাত্র ৩০ মিনিট দূরত্বে রয়েছে এই বোটগুলো। বিলাসবহুল প্রমোদতরিকে বলা হয় ইয়ট। এটি মূলত সমুদ্রে যাত্রা করে, কিন্তু এখন ঢাকায় আপনি পাবেন সেই সুযোগ নদীপথে। ঢাকার ৩০০ ফুটের শেষ প্রান্ত কাঞ্চন ব্রিজের কাছেই অস্ট্রিচ হারবার। এখানে বিভিন্ন দামের বিলাসবহুল বোট পাওয়া যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ও বিলাসবহুল ইয়ট হচ্ছে ক্যাটামেরন, যেখানে ঘণ্টাপ্রতি খরচ হবে ৩৬০ টাকা। ২০ থেকে ৩০ জন ধারণক্ষমতার এই বোটে ২টি কেবিন, ৩টি ওয়াশরুম, ডাইনিং, ছাদে বসার ব্যবস্থাসহ রয়েছে সব ধরনের সুবিধা।
এখানে ক্যাটারিং সার্ভিস আছে। কুক রান্না করে দেন ফরমাশমতো। এখানে ক্যাটামেরন ছাড়াও বিভিন্ন মান ও দামের বোট রয়েছে, যা চাহিদা ও পছন্দ অনুযায়ী নেওয়া যাবে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে এখানে অবস্থিত ১০০ বছরের পুরোনো ব্রিটিশ আমলের অস্ট্রিচ রকেট পেডেল স্টিমার। বহু ইতিহাসের সাক্ষী এই বোট। এখানে একটি রেস্টুরেন্ট করার কাজ চলছে। অস্ট্রিচ হারবারে রয়েছে বাচ্চাদের জন্য কিডস জোন। অন্য বোটে রয়েছে রেস্টুরেন্ট। নৌকাভ্রমণ না করলেও বিকেলবেলা পরিবারের সবাইকে নিয়ে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে হতে পারে চায়ের আড্ডা। আর নৌকাভ্রমণ করলে শীতলক্ষ্যার জীবনযাপন আপনাকে নিঃসন্দেহে মুগ্ধ করবে । এখান থেকে নৌকাযোগে যেতে পারেন জামদানিপল্লি কিংবা মুরাপাড়া জমিদারবাড়ি।
মৈনাক ঘাটের স্পিডবোট
ঢাকা থেকে মাত্র দেড় ঘণ্টার দূরত্বে নবাবগঞ্জের কাছে দোহারে অবস্থিত মৈনাক ঘাট। এখানে রয়েছে স্পিডবোটে করে রোমাঞ্চকর ভ্রমণের ব্যবস্থা। পদ্মার অপার সৌন্দর্য মুগ্ধ করবে আপনাকে। আশপাশেই আছে রেস্টুরেন্ট। খেতে পারবেন ইলিশ ভাজা। বর্ষাকালে কিছুটা ঝুঁকি থাকলেও শীতে পানি অনেক নেমে যায়। ফলে নদী শান্ত থাকে এবং ঝুঁকি কম থাকে। তবে লাইফ জ্যাকেট পরে বোটে ওঠা নিরাপদ।
বেরাইদ বোট ঘাট, নাওড়া রোড
গুলশান নতুন বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের উল্টো দিকে অটোরিকশায় সরাসরি চলে যেতে হবে বেরাইদ বোট ঘাটে। সেখানে রয়েছে দারুণ সব নৌকা। গুদারাঘাট থেকে মাত্র পাঁচ টাকায় চলে যাওয়া যায় ওপারে। ফেরার সময় আর কোনো টাকা দিতে হবে না। ওপারে রয়েছে খললা পর্যন্ত চলে যাওয়া সুন্দর একটা রাস্তা, যা বাইকারদের জন্য দারুণ রাইডের হাতছানি দেয়। বোটে বাইক নিয়ে ওপারে যাওয়া যায়। সেখানে দারুণ একটা ব্রিজও রয়েছে। ঘাটের পাড়ে রয়েছে বেশ কিছু রেস্টুরেন্ট, যেখানে ভালো মানের খাবার মিলবে। বেরাইদ বোট ঘাট থেকে এসি বাসে করে ফেরা যাবে নতুন বাজারে। এই রাস্তায় নির্মাণকাজ চলছে বলে প্রচুর ধূলাবালি। তাই অবশ্যই মাস্ক পরে যাওয়া উচিত।
ছবি: লেখক