ঈদের ছুটিতে বেড়ানো: কৃত্রিম পাহাড়ি গ্রাম 'ব্লিস ইকো ভিলেজ'
শেয়ার করুন
ফলো করুন

বান্দরবান শহরের কানাপাড়ায় অবস্থিত ব্লিস ইকো ভিলেজে আগে থেকেই বুকিং করে রেখেছিলাম। এটা কি কোনো রিসোর্ট? নাহ, যাঁরা এটা গড়ে তুলেছেন, তাঁরা একে পাহড়ের কোলে অনেক যত্নে গড়া ছোট্ট একটা গ্রাম বলতেই বেশি ভালোবাসেন। পরিকল্পনা করলাম, সারা দিন ব্লিসে থেকে বিকেলবেলায় আমার সাড়ে ছয় বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে ট্রেকিং করে যাব বান্দরবান শহরের কাছেই একটা গুপ্ত সৌন্দর্যের আধার দেখতে, যার নাম অক্টোপাস। সব মিলিয়ে দারুণ উত্তেজনাময় একটা দিন অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য।

যাঁরা এটা গড়ে তুলেছেন, তাঁরা একে পাহড়ের কোলে অনেক যত্নে গড়া ছোট্ট একটা গ্রাম বলতেই বেশি ভালোবাসেন
যাঁরা এটা গড়ে তুলেছেন, তাঁরা একে পাহড়ের কোলে অনেক যত্নে গড়া ছোট্ট একটা গ্রাম বলতেই বেশি ভালোবাসেন

ব্লিস ইকো ভিলেজে আমাদের থাকার জন্য ঠিক করা হয়েছিল ডুপ্লেক্স কটেজটা, যার নাম দেওয়া হয়েছে দ্বিতল বাড়ি। পুরো কটেজটাই বাঁশ আর কাঠ দিয়ে তৈরি। যে ব্যাপারটা একে অন্য সব রিসোর্টের কটেজগুলো থেকে আলাদা করেছে, সেটা হলো এর কাঠামো বা স্ট্রাকচার। সামনাসামনি না দেখলে বোঝা যাবে না এটা কতটা ইন্টারেস্টিং।

যে ব্যাপারটা একে অন্য সব রিসোর্টের কটেজগুলো থেকে আলাদা করেছে, সেটা হলো এর কাঠামো বা স্ট্রাকচার
যে ব্যাপারটা একে অন্য সব রিসোর্টের কটেজগুলো থেকে আলাদা করেছে, সেটা হলো এর কাঠামো বা স্ট্রাকচার
নিচতলার রুমের ভেতরেই কাঠের তৈরি প্যাঁচানো সিঁড়ি রয়েছে
নিচতলার রুমের ভেতরেই কাঠের তৈরি প্যাঁচানো সিঁড়ি রয়েছে

নিচতলায় একটা দিক পুরোটাই কাচ দিয়ে ঘেরা। সেখান থেকে অবারিত আলো-বাতাস-রোদ তো আসছেই, সঙ্গে দূরের সবুজ পাহাড়ের সারির চমৎকার ভিউ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। নিচতলার রুমের ভেতরেই কাঠের তৈরি প্যাঁচানো সিঁড়ি রয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলে সেখানেও গোটা দুয়েক রুম রয়েছে। রুমের ডিজাইনগুলো খুব অদ্ভুত। সবকিছু কেমন যেন অগোছালোভাবে গোছানো।

বিজ্ঞাপন

কটেজটার সামনেই বসে আরাম করার জন্য রয়েছে গাছ আর দড়ি দিয়ে বিশেষভাবে বানানো একটা আরাম কেদারা। আরেকটু সামনে এগোতেই দেখলাম একটা গাছের ওপর গড়ে তোলা হয়েছে ট্রি হাউস। এর নাম দেওয়া হয়েছে বৃক্ষবাড়ি। কাঠ, বাঁশ, বেত আর ছনের সমন্বয়ে গড়ে তোলা ট্রি হাউসটার কাঠামোও অদ্ভুত সুন্দর। এর ঠিক বিপরীতেই রয়েছে একটা কাপল কটেজ, যাকে বলা হচ্ছে যুগল বাড়ি।

একটা গাছের ওপর গড়ে তোলা হয়েছে ট্রি হাউস
একটা গাছের ওপর গড়ে তোলা হয়েছে ট্রি হাউস
অলসভাবে বসে থেকে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থেকেই একটা বেলা বা দিন পার করে দেওয়া যায় চাইলে
অলসভাবে বসে থেকে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থেকেই একটা বেলা বা দিন পার করে দেওয়া যায় চাইলে

ব্লিস ইকো ভিলেজের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা হলো এর মাচাংটা। এখানে সারাক্ষণ বাতাস বইতে থাকে। গাছের পাতায় আছড়ে পড়া বাতাসের অপূর্ব মরমর শব্দ আর শীতলতা যেন প্রাণ জুড়িয়ে দিচ্ছিল।

মাচাংয়ের নিচের দিকটায় রয়েছে একটা হ্যামক
মাচাংয়ের নিচের দিকটায় রয়েছে একটা হ্যামক
দোল খাওয়ার জন্য আছে গোটা দুয়েক দোলনা

শীতল বাতাসে অলসভাবে বসে থেকে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থেকেই একটা বেলা বা দিন পার করে দেওয়া যায় চাইলে। মাচাংয়ের নিচের দিকটায় রয়েছে একটা হ্যামক। এ ছাড়া দোল খাওয়ার জন্য আছে গোটা দুয়েক দোলনা আর গাছের ডাল দিয়ে বানানো একটা বিশাল পাখির বাসা। এসব ঘুরে দেখতে দেখতেই দুপুর হয়ে গেল। ফ্রেশ হয়ে আমরা আমাদের দুপুরের আহার সেরে নিলাম।

বিজ্ঞাপন

বিকেলে মেয়ে আর তার মাকে কটেজে রেখে ছেলেকে নিয়ে বের হয়ে পড়লাম।ছেলেকে পাহাড়ে ট্রেকিংয়ের একটা ভাইব দিতে চাই। আমার পাহাড়ের প্রতি ভালোবাসার বীজ ছেলের মধ্যেও বুনে দিতে চাই। বাপ–ছেলের এই মিশনে গাইড হিসেবে যোগ দিয়েছেন ব্লিস ইকো ভিলেজের আসিফ ভাই। আমাদের গন্তব্য আসিফ ভাইদের সদ্য গড়ে তোলা ক্যাম্পসাইট অক্টোপাসে। রওনা হওয়ার সময় তিনি আমাকে খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছেন, এমন সৌন্দর্য উপভোগ করার অভিজ্ঞতা মনে থাকবে বহুদিন।

শুরুতে আসিফ ভাই আমার ছেলেকে কাঁধে তুলে নিয়ে এগোচ্ছিলেন
শুরুতে আসিফ ভাই আমার ছেলেকে কাঁধে তুলে নিয়ে এগোচ্ছিলেন

আমরা একটা অটোতে চেপে বসলাম। শুরুতে পাকা রাস্তা, তারপর ইটের রাস্তা, এরপর পাহাড়ি এবড়োখেবড়ো পথ পেরিয়ে একটা পাড়ার কাছাকাছি এসে অটো আমাদের নামিয়ে দিল। এরপরই শুরু হলো ট্রেকিং। পাহাড়ি পথ বেয়ে কখনো ওপরের দিকে উঠে চলা, আবার নিচের দিকে নেমে যাওয়া। চারপাশে যেদিকে তাকাচ্ছিলাম, থরে থরে সাজানো সবুজ পাহাড়। অপরূপ এই দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। শুরুতে আসিফ ভাই আমার ছেলেকে কাঁধে তুলে নিয়ে এগোচ্ছিলেন। আমি অসিফ ভাইকে অনুরোধ করেছি, যেহেতু ছেলেকে ট্রেকিংয়ের একটা ছোট্ট হাতেখড়ি দিতে এনেছি, ওকে যেন নামিয়ে দেন তিনি। কাঁধ থেকে নামতেই বাছুরের মতো তিড়িংবিড়িং করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিল সে। আমার ছেলে পাহাড়ি পথে টুকটুক করে হেঁটে যাচ্ছে, এ দৃশ্য দেখা আমার জন্য ছিল খুব আনন্দের।

প্রায় আধা ঘণ্টার ট্রেকিং শেষে আমরা পৌঁছে গেলাম অক্টোপাসে। প্রথম দেখাতেই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। চারপাশে সারি সারি অগণিত পাহাড় আর মাঝখান থেকে এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে সাঙ্গু নদী। ওপর থেকে দেখলে মনে হয়ে এই সাঙ্গু যেন অক্টোপাসের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে পাহাড়গুলোকে। কী অপূর্ব দৃশ্য! এ যেন পাহাড় আর নদীর শৈল্পিক মেলবন্ধন! সঙ্গে যোগ হয়েছে গাঢ় নীল সাদা আকাশ। সব রং যেন একসঙ্গে মিলেমিশে একাকার।

আধা ঘণ্টার ট্রেকিং শেষে আমরা পৌঁছে গেলাম অক্টোপাসে
আধা ঘণ্টার ট্রেকিং শেষে আমরা পৌঁছে গেলাম অক্টোপাসে
পাহাড় আর নদীর শৈল্পিক মেলবন্ধন! সঙ্গে যোগ হয়েছে গাঢ় নীল সাদা আকাশ। সব রং যেন একসঙ্গে মিলেমিশে একাকার।
পাহাড় আর নদীর শৈল্পিক মেলবন্ধন! সঙ্গে যোগ হয়েছে গাঢ় নীল সাদা আকাশ। সব রং যেন একসঙ্গে মিলেমিশে একাকার।


হঠাৎ সেই নীল সাদা আকাশ নিমেষেই ম্যাজিকের মতো মেঘে ছেয়ে গেল। অচিরেই বৃষ্টি নামতে শুরু করল। টিপটিপ না, মুষলধারে বৃষ্টি। পাহাড়ে বৃষ্টি মানেই অন্য রকম এক প্রশান্তি। অক্টোপাসে দাঁড়িয়ে সেই বৃষ্টি উপভোগ করতে আরও বেশি অপার্থিব রকমের ভালো লাগছিল। আমি আমার এই জীবনে যতগুলো সুন্দর বিকেল কাটিয়েছি, তার মধ্যে অক্টোপাসে কাটানো রোদ-বৃষ্টি-আলো-ছায়ায় এই বিকেলটা ওপরের দিকেই থাকবে। ছেলেকে নিয়ে এই সুন্দর মুহূর্তগুলো ফ্রেমবন্দী করে রাখলাম।

পাহাড়ে বৃষ্টি মানেই অন্য রকম এক প্রশান্তি
পাহাড়ে বৃষ্টি মানেই অন্য রকম এক প্রশান্তি
 অক্টোপাস তো ছিল কল্পানতীত সুন্দর
অক্টোপাস তো ছিল কল্পানতীত সুন্দর
প্রত্যাশাকে ছাপিয়ে গেছে পুরো অভিজ্ঞতা
প্রত্যাশাকে ছাপিয়ে গেছে পুরো অভিজ্ঞতা

যতটুকু ভেবে ব্লিস ইকো ভিলেজে একটা দিন থাকার প্ল্যান করেছিলাম, সেই প্রত্যাশাকে ছাপিয়ে গেছে পুরো অভিজ্ঞতা। আর অক্টোপাস তো ছিল কল্পানতীত সুন্দর! সব মিলিয়ে, মনে রাখার মতো কিছু সময় কাটল পরিবারের সবাই মিলে বান্দরবানের অদূরে কৃত্রিম পাহাড়ি গ্রাম ব্লিস ইকো ভিলেজে।

প্রকাশ: ০৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৯: ০০
বিজ্ঞাপন