ঢাকার অদূরে বিক্রমপুর (বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ) আর গাজীপুর জেলা প্রত্নসম্পদে ঠাসা দুটি অঞ্চল। এই দুই অঞ্চলের ঐতিহ্য পরিভ্রমণ শেষ হওয়ার নয়। বিগত ৯ বছরে আমি সব দেখে ফেলেছি, এ কথা বলতে পারব না। বিশেষত বিক্রমপুরের মাটির নিচে আরও একটি শহরের সন্ধান পাওয়া যাবে যদি সঠিক উপায়ে খনন করা হয়।
আমার পায়ের তলায় শর্ষেদানা, এটা আমার সব বন্ধুই জানে। দিনকয়েক আগে এক বন্ধু দাওয়াত করেছিল মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলায় পদ্মার পাড়ে নাটকের শুটিং দেখার জন্য। সঙ্গে সঙ্গেই মনে পড়েছে লৌহজং উপজেলায় কলমা গ্রামে আমার কাজের কথা। যেতেই হবে। আসলে সেদিন আমি বন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম কলমা গ্রামে যাওয়ার জন্যই। আমার এই লেখা পড়লে হয়তো তিনি মনঃক্ষুণ্ন হবেন।
সকাল আটটায় গুলিস্তান থেকে বাসে করে গিয়ে নামি লৌহজং বাজারে। সকালের নাশতা সেরে নিয়ে সোজা পদ্মার পাড়। যেখানে নাটকের শুটিং চলছিল; স্থানীয় লোকজন বললেন অল্প দূরত্বে নদী পার হলেই কলমা গ্রাম। এটা পদ্মার একটা শাখা। খেয়া পারাপারের জন্য অটোরিকশা নিয়ে শুটিং স্পট থেকে বড় মোকাম বাজারে গিয়ে খেয়া পার হয়েছি। মিনিট ত্রিশের মতো সময় লাগল শুটিং স্পট থেকে; খেয়াও পার হলাম সহজে। ওপারে গিয়ে আবারও অটোরিকশা। এবার যাচ্ছি তো যাচ্ছি। পথ ফুরায় না। কিন্তু পথ দারুণ মায়াময়। পিচঢালা সরু পথ। চারদিকে সবুজ বনানী। যেতে যেতে চোখে পড়ে উনিশ-বিশ শতকের ভাঙা দালান। আবার চলতে চলতে মেলে একটি প্রাচীন মঠ। ওই যে বলেছিলাম মুন্সিগঞ্জের ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে ইতিহাস। এত সুন্দর কেন আমার দেশ!
প্রায় এক ঘণ্টা পর এসে উপস্থিত হলই কলমা গ্রামের সেই কাঙ্ক্ষিত বাড়ির সামনে। বাড়ির সামনের মাঠেই দেখলাম কয়েকটি কিশোর ফুটবল খেলছে। নব্য ধ্রুপদি (নিও ক্ল্যাসিক্যাল) স্থাপনাটি বেশ জীর্ণ হয়ে গেছে। বয়স তো কম হলো না। ১৪০! তাতে কি। দুনিয়াজোড়া হাজার বছরের পুরোনো স্থাপত্য টিকে রয়েছে। আসলে যত্নের অভাব।
জীর্ণ ভবনটির সামনে ফুলের বাগান। আরও কাছে যেতেই চোখে পড়ে, ভবনটির একপাশে উৎকীর্ণ AGREE TO DIFFER। অন্যপাশে VARIETY IS THE… এইটুকুই লেখা। পরে কি BEAUTY লেখা ছিল? দেয়ালের সেই অংশ খসে পড়ে গেছে। এই বিউটি খসে পড়েই কি তাহলে বাড়িটাকে শ্রীহীন করেছে? কী জানি? যেন কোন পুরোনো ইমারতে সামনে দাঁড়ালে কত কিছু যে মনে হতে থাকে! এখানেও সেটা হচ্ছিল।
একটিমাত্র অট্টালিকা কলমা জমিদারবাড়িতে। মুন্সিগঞ্জের অন্যান্য জমিদারবাড়ির তুলনায় একদমই পরিচিত নয় কলমা জমিদারবাড়ি। অনেকে হয়তো এ বাড়ির নামই শোনেননি। অপরূপ কারুকাজ আর ভবনে উৎকীর্ণ বাণীগুলোর জন্য অনন্য বৈশিষ্ট্যময় এই বাড়ি। প্রবাদগুলোই বলে দেয় এই জমিদারের শিক্ষা ও রুচির গভীরতা।
সুনসান পল্লির এই ভবনের গায়ে এমন অর্থপূর্ণ ঘোষণা অভিনব ও কিছুটা আশ্চর্যেরই। ইংরেজি শিক্ষা কি ছিল তখন! এর অন্তর্নিহিত অর্থ বোঝার মতো স্থানীয়জনদের বসবাস কি ছিল এই অঞ্চলে? নানা প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে। ভবনের কাছে যেতেই দেখা হলো মাঝবয়সী একজনের সঙ্গে। নিচতলার বারান্দায় চুলো জ্বলছে। তাতে বোঝা গেল কেউ বসবাস করছেন। একেবারে পরিত্যক্ত নয় ভবন। দ্বিতল ভবনটির ওপরে যাওয়ার সিঁড়ি ভেঙে গেছে। ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার কারণে দোতলায় ওঠার পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মাঝবয়সী লোকটি নিজের নাম বললেন মো. নুর হোসেন। তিনি এখানকার স্কুলের কেয়ারটেকার।
এই জমিদারদের প্রতিষ্ঠিত একটি স্কুল রয়েছে। নাম ‘কলমা এল কে উচ্চবিদ্যালয়’। বাড়ির পাশেই স্কুল। জমিদারবাড়ির মূল ভবন পেরিয়ে গেলে স্কুলের মূল ভবন চোখে পড়ে। অট্টালিকাটি ১৯৮৯ পর্যন্ত ব্যবহার হচ্ছিল পাশের এল কে স্কুলের শিক্ষকদের নিবাস হিসেবে। এখন সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত।
স্কুল ভবনের দিকে যেতেই শিক্ষকদের কক্ষ পেলাম। নিজের পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলাম। সবাই সাদরে আমন্ত্রণ জানালেন। আমি আসলে জানতে চাইছিলাম এই জমিদারবাড়ি আর স্কুল প্রতিষ্ঠার পেছনের গল্প। কলমা এল কে উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক পরিমল চন্দ্র ও মো. শাহীন মিয়া আমাকে পুরো ইতিহাস শোনালেন।
স্কুলের নির্মাণকাল ১৯০১ সালে। তারও আগে এই বাড়ির নির্মাণ। স্কুলের নামের ‘এল কে’ অর্থাৎ লক্ষ্মীকান্ত। পুরো নাম শ্রীলক্ষ্মীকান্ত দাশচৌধুরী। তাঁর হাতেই এই স্থানে প্রতিষ্ঠা জমিদারির। তবে এই অট্টালিকার নির্মাণ হয় তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজকুমারের হাতে। তিনি দুই হিস্যায় জমিদারি ভাগ করে দিয়েছিলেন দুই পুত্র রাজকুমার ও তারাকান্তের মধ্যে। স্কুলের প্রতিষ্ঠা হয় পরের প্রজন্মের হাত ধরে। রাজকুমারের চার পুত্র। দেয়ালে উৎকীর্ণ তাঁদের নাম—সেবক: জ্ঞানেন্দ্র কামিনী, ভূপতি, দক্ষিণা। ভবনের গায়ে বাণী লিপিবদ্ধকারী রাজকুমার দাশগুপ্তর চার সন্তা—জ্ঞানেন্দ্র চন্দ্র, কামিনী রঞ্জন, ভূপতি চন্দ্র, দক্ষিণা রঞ্জন। চারজনই ছিলেন বিদ্যানুরাগী ।
স্কুল প্রতিষ্ঠার আগেই মৃত্যুবরণ করেন লক্ষ্মীকান্ত। তাহলে সহজে অনুমেয় যে জমিদারবাড়িটির নির্মাণ স্কুল প্রতিষ্ঠার এক পুরুষ আগে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে অর্থাৎ, ১৮৯০ সালে। শিক্ষক পরিমল চন্দ্র এ রকম তথ্যই দিলেন।
স্থানীয় পুরোনো বাসিন্দাদের কাছে বাড়িটি পরিচিত ভূঁইয়া বাড়ি নামে। তবে আঞ্চলিকভাবে বলে ‘ভিয়া বাড়ি’। পরে পদবি পরিবর্তন (দাশ চৌধুরী, দাশগুপ্ত) হয়। এই বংশের আদি পরিচিতি ছিল ভূঁইয়া। শুধু বিক্রমপুর নয়, সমগ্র বঙ্গে খ্যাতি ছিল এই জমিদার বংশের। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ‘বিক্রমপুরের প্রাচীন ইতিহাস’ বইতে। সেখানে বলা আছে, ‘উত্তর বিক্রমপুরের কলমার ভূঁইয়া বংশ বিশেষ প্রতাপান্বিত ছিলেন। ভূঁইয়া বাবুদের মহান উদ্দেশ্যের কথায় সেকালে বঙ্গদেশ মুখরিত থাকিত।’ এই জমিদারবাড়ির ইতিহাস এত অল্প নয়। কলমায় এই বংশের গোড়াপত্তন করেন নিধিরাম দেওয়ান। তিনি ছিলেন মুর্শিদাবাদের নবাব দরবারের বৈদ্য। সেই সুবাদে তিনি উপাধি পেয়েছিলেন ‘দেওয়ান’। নবাব সিরাজউদ্দৌল্লাহর পতনের পর ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়ে পড়েন। ঘুরতে ঘুরতে এসে ঠাঁই হয় কলমি বিলের পাড়ে।
নবাব দরবারে নিধিরাম দেওয়ানের পরিচিতি ছিল রাজা রাজবল্লভের সঙ্গে। সেই সূত্রে রাজবল্লভের অনুগ্রহে তিনি বসতি স্থাপন করেন এই কলমায়, যার নাম হয়েছে কলমি বিলের কলমি থেকে। এখনো কলমায় আছে তাঁর স্থাপিত দেবালয়, যার নাম কলমা কালীবাড়ি। নিধিরামের উত্তরসূরি লক্ষ্মীকান্ত বরিশালের মাটিডাঙ্গা মঠবাড়িয়ার রাজস্ব আদায়কারী হিসেবে নিয়োগ পান। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের (১৭৯৩ সালে) পর তিনি বিক্রমপুরের কলমা অঞ্চলে পত্তন করেন নতুন জমিদারি।
লক্ষ্মীকান্তের জমিদারি দুটি হিস্যায় ভাগ করে দেওয়া হয় দুই পুত্রের মধ্যে। বড় হিস্যা রাজকুমারের চার পুত্রের হাতেই সেই সময় উল্লেখযোগ্য জনহিতকর কাজ হয় বেশ কিছু। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এলাকায় ইংরেজি শিক্ষার গোড়াপত্তনকারী এই কলমা এল কে স্কুল। এ ছাড়া আছে কলমা বাজার, রাস্তাঘাট, সেতু, ডাকঘর, টেলিগ্রাম অফিস, রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম ইত্যাদি।
পক্ষান্তরে ছোট হিস্যার (তারাকান্ত) বংশধরের সংশ্লিষ্টতা ছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে। তারাকান্তের তৃতীয় পুত্র যোগেন্দ্র চন্দ্র দাশগুপ্ত ছিলেন বিপ্লবী দলের সভ্য। তাঁর এবং এই বাড়ির উল্লেখ আছে মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর ‘জেলে ত্রিশ বছর ও পাক-ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম’ গ্রন্থে।
‘ঢাকা জিলা বিক্রমপুরের অন্তর্গত কলমার প্রসিদ্ধ জমিদারবাড়ি অনুশীলন সমিতির একটি আশ্রয়কেন্দ্র ছিল। এই বাড়ির যোগেন্দ্রচন্দ্র দাশগুপ্ত (যোগা ভূঁইয়া) অনুশীলন সমিতির সভ্য ছিলেন এবং বৈপ্লবিক কাজে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করিয়াছিলেন।’ বর্তমানে এই জমিদারির কোনো বংশধর বাংলাদেশে নেই বলে জানালেন স্কুলের শিক্ষকেরা। এল কে বিদ্যালয় কলমা গ্রামের একটি শতবর্ষী স্কুল; কিন্তু এই জনহিতকর পরিবারের অট্টালিকাটি সংরক্ষণ করা অতি জরুরি বলে আমি মনে করি।
দেয়ালের প্রবাদগুলো সম্পর্কে একটি কথা না বললেই নয়। ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার রক্ষা নিয়ে বহুল প্রচলিত বাণীটি হচ্ছে, ‘I disapprove of what you say, but I will defend to the death your right to say it।’ অনেকেই এটিকে জানেন ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের বাণী হিসেবে; কিন্তু এটি Evelyn Beatrice Hall নামের একজন ইংরেজ লেখিকার। তাঁর বিশেষ পরিচিতি ভলতেয়ারের জীবনীলেখিকা হিসেবে। তিনি লিখতেন S.G. Tallentyre ছদ্মনামে। তাঁর লেখা 'The Life of Voltaire’ ও ‘The Friends of Voltaire’ প্রকাশ পায় যথাক্রমে ১৯০৩ ও ১৯০৬ সালে।
আগেই বলেছি এই বাড়ির নির্মাণকাল ভলতেয়ারের কথিত সেই বাণী প্রকাশের (১৯০৩) ৩০ হতে ৪০ বছর আগে! কী করে সম্ভব এটি! তবে আমি এখনো তৃষ্ণার্ত সেই উত্তরের জন্য।
কলমা গ্রাম ছেড়ে যখন এলাম তখন পদ্মার জলে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। আকাশে লালিমায় পদ্মার জল আর মেঠোপথ রঙিন হয়ে আছে। কিন্তু আমার মন পড়ে রয়েছে কলমা জমিদারবাড়ির দেয়ালে।
ফেরার পথে এল কে বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আমাকে উপহার দিয়েছেন ‘মানুষ গড়ার কারখানা, কলমা লক্ষ্মীকান্ত উচ্চবিদ্যালয়’ নামের একটি বই। লিখেছেন মনোয়ার মাহবুব-উল-আলম । ১৯৬৩ সালে তিনি এই বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকরিজীবন শুরু করেন। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৮৯ সালে।
ছবি: লেখক