রাঙামাটি শহরে যখন ঢুকি, তখন বেলা ১১টা। আবহাওয়া হালকা গরম থাকলেও রোদের তেমন তেজ নেই। আমাদের গন্তব্য ডিভাইন লেক আইল্যান্ডে হলেও যথেষ্ট সময় থাকায় আরণ্যক হলিডে রিসোর্টে ঢুকে পড়ি। আমাদের ১২ জনের পর্যটক দল ঘণ্টাখানেক ঘুরেই সবার খিদে পেয়ে যায়। পার্ক থেকে বের হয়ে শহরের একটি রেস্তোরাঁয় নাশতা করে নিই। তখন ঘড়ির কাঁটা ১২টা পেরিয়েছে। সময় হাতে থাকায় খাওয়াদাওয়া শেষে রিসোর্টের বোট সার্ভিসকে কল দিয়ে সবাই গাড়িতে উঠে পড়ি।
আসামবস্তি ব্রিজের পাশ থেকেই আমাদের তুলে নেবে রিসোর্টের ইঞ্জিনচালিত নৌকা। বোট ছাড়া ওই রিসোর্টে যাওয়ার কোনো স্থলপথ নেই। আমরা আসামবস্তি পৌঁছে দেখি লেকে কোনো বোট নেই। রিসোর্টে আবার কল দেওয়া হলে, তারা জানায় বোট আসামবস্তি যেতে ২০ থেকে ২৫ মিনিট সময় লাগতে পারে। রোদে লেকের পাড়ে না দাঁড়িয়ে ততক্ষণে কোথাও বসা যায় কি না চিন্তা করতেই ব্রিজের পাশে চোখে পড়ে বাঁশ-কাঠের তৈরি দৃষ্টিনন্দন হাবিল রেস্টুরেন্টে। সবাই তখন ওই রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়ি। উপজাতীয় খাবারের পাশাপাশি বাঙালি খাবারও পাওয়া যায় ওখানে। আমাদের একজন বলল, চলো সবাই চাপিলা মাছের ফ্রাই খাব। গরম গরম চাপিলা ফ্রাইয়ের স্বাদ নিতে গিয়ে কখন যে সময় গড়িয়ে সময় দেড়টা পার হলো, কেউ টেরও পেলাম না।
রেস্তোরাঁ থেকে চোখে পড়ল আসামবস্তির দিকে দ্রুত আসছে একটি বোট। রেস্তোরাঁর বিল মিটিয়ে সবাই লেকের পাড়ে ছুটলাম। কাছে গিয়ে বাধল বিপত্তি। লেকে পানি কম থাকায় রিসোর্ট থেকে আমাদের নিতে আসা বোটটি লেকের পাড়ে ভিড়তেই পারছে না। বোটের চালক ও সহকারী লেকের পানিতে নেমেও বোটটাকে পাড়ে ভেড়াতে পারছে না। রোদে প্রচণ্ড গরম অনুভব করছি সবাই। বোট পাড়ে ভিড়বে ভিড়বে আশা করে ঘণ্টাখানেক সময় গড়াল। বোটের জন্য অপেক্ষা করতে করতে রোদে সবাই কাহিল হয়ে পড়েছে। রিসোর্টে খবর দিয়ে বিকল্প বোট এনে যাত্রা করলাম। নৌকায় চড়ে লেক ঘুরিয়ে আমাদের নিয়ে যাওয়া হবে রিসোর্টে। বোটে চড়তেই বাতাস আর লেকের চারপাশের সৌন্দর্য দেখে ঘণ্টাখানেকের কষ্ট ভুলে গেলাম সবাই।
যখন ডিভাইন লেক আইল্যান্ডে পৌঁছাই তখন দুপুর গড়িয়েছে। রিসোর্টের সিঁড়ি বেয়েউঠতে চোখে পড়ে রিসোর্টের ডাইনিং এরিয়া। চারপাশে খোলামেলা এ জায়গায় খাওয়ার পাশাপাশি আড্ডা দেওয়ার জন্যও দারুণ। লাঞ্চ, ইভনিং স্ন্যাকস ও ডিনারের জন্য আগে অর্ডার দিতে হয়। আমরা সবাই তখন বেশ ক্ষুধার্ত। তবে রিসোর্টের রেস্তোরাঁয় আগে থেকে খাবারের অর্ডার দেওয়া ছিল বলে টেবিলে সাজাতে তেমন সময় লাগেনি।
ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে ঢোকার আগে হাত ধোয়ার বেসিনের চারপাশে ঘিরে ছোট পুকুর। স্বচ্ছ পানিতে খেলা করছে ছোট মাছ। মিনি পুকুরে মাছের লাফালাফি যে কাউকে মুগ্ধ করবে। ফ্রেশ হয়ে সবাই ডাইনিং টেবিলে বসে পড়লাম। চাপিলা ফিশ ফ্রাই, দেশি মুরগি, লেকের বড় মাছের ঝোল, সাদা ভাত, সবজি, বেগুনভর্তা ও ডালে হলো আমাদের মধ্যাহ্নভোজ। প্যাকেজের বাইরে আমরা অবশ্য অতিরিক্ত পদ নিয়েছিলাম। খাবারের দাম কিছুটা বেশি হলেও খাবারের স্বাদ চমৎকার।
‘ডিভাইন লেক আইল্যান্ড রিসোর্ট যার চারপাশে শুধু পানি আর পানি। প্রকৃতিকে অবিকল রেখে আধুনিকতার ছোঁয়ায় গড়ে উঠেছে এই স্থাপনা। খাবার সেরে ডাইনিং এরিয়া থেকে বের হলাম সবাই। লেকের মাঝখানে ছোট্ট দ্বীপ চোখে পড়ল।
এখানে আছে আলাদা সিটিং এরিয়া, ব্যাম্বো কটেজ, ব্যাম্বো ডুপ্লেক্স কটেজ, এসি কটেজ। এখানে রয়েছে লেকের পানিতে রাত কাটানোর বিশালাকার প্রমোদতরি। আলাদা আলাদা এসি কক্ষ রয়েছে ওই নৌকায়, আছে নানান সুবিধাও। প্রতি রাত হিসেবে প্রমোদতরি ভাড়া নেওয়া যায়।
রিসোর্টে চোখজোড়ানো চমৎকার পরিবেশে লেকের চারপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। রিসোর্ট ঘিরে রয়েছে নানা প্রজাতির অসংখ্য ফলজ ও বনজ গাছ। এই রিসোর্টে দেখা পাবেন নানান প্রজারিত পাখি ও সরীসৃপ। ইচ্ছা করলে করা যাবে কায়াকিংও। প্রতি ঘণ্টা হিসেবে ভাড়া পাওয়া দুজন বা তিনজনের যেকোনো কায়াকিং বোট; তাই এই বেটা নিয়ে ভেসে পড়া যায় লেকের স্বচ্ছ পানিতে।
তবে ওই দিন আমরা কায়াকিং না করলেও সিটিং এরিয়ায় জম্পেশ আড্ডা আর দোলনা চড়ে চমৎকার বিকেলটা উপভোগ করি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগেই ইঞ্জিনের নৌকায় ফিরি আমাদের গন্তব্যে।
ছবি: লেখক