মনের সুখে বনবাসে
শেয়ার করুন
ফলো করুন

মাথার ওপর মাঝদুপুরের গনগনে সূর্য আর পায়ের নিচে থকথকে পিচ্ছিল আঠালো কাদা। দুজন মিলে এর মধ্যেই প্রায় ১০০ মিটার মোটরবাইক ঠেলে নিয়ে এসেছি। শুনতে খুব একটা কঠিন মনে না হলেও মোটরবাইকের ওজন দেড় শ কেজিরও বেশি এবং তার ওপর যোগ হয়েছে প্রায় ২০ কেজির লটবহর। সঙ্গে নিজেদের শরীরের নানা রকম গিয়ারের ওজন আর নিজেদের ওজন। আর এর মধ্যেই দুম করে কাদার মধ্যে প্রায় গোড়ালি পর্যন্ত দেবে গেলাম।

শহুরে যাযাবর আমরা। কিন্তু আমাদের অনেক দিন ধরেই দূরে কোথাও যাওয়া হচ্ছিল না। রাতের বেলা আবহাওয়ার পূর্বাভাসে দেখলাম, আগামী সাত দিন টানা বৃষ্টি হবে। সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়ে পরদিন সকাল পৌনে সাতটায় আমরা রওনা হলাম।

চমৎকার ঝকঝকে নীল আকাশ আর মোটামুটি সহনীয় গরম। আমরা যাচ্ছি বনবাসে, আমাদের গন্তব্য বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, আমাদের সুন্দরবন।

বিজ্ঞাপন

মোটরবাইক নিয়ে ঢাকা-খুলনা হাইওয়ে ধরে পদ্মা সেতু হয়ে মাঝেমধ্যে ঝিরিঝিরি ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির মধ্য দিয়ে আমরা পৌঁছালাম মোংলা। ঢাকা থেকে বাগেরহাট পর্যন্ত হাইওয়েকে ভয়ংকর সুন্দর বলা যায়।

সারা দেশে যাকে মংলা বন্দর বলা হয়, তা মংলায় এসে মাইলফলকে স্থানীয় ভাষার কারণে হয়ে গেছে মোংলা। যা-ই হোক, এখান থেকে লাউডোব ফেরিঘাট, তারপর পাঁচ থেকে সাত মিনিটের ছোট্ট একটা ফেরি, সেই ফেরি পার হয়ে যেতে হবে বাণীশান্তা ফেরিঘাট।

সেখান থেকে সামান্য এগোলেই দাকোপ, আর সেখানেই ঢাংমারি গ্রাম। আমরা যাচ্ছি এই গ্রামেরই একটা ইকো রিসোর্ট ‘বনবাস ইকো ভিলেজে’।

বিজ্ঞাপন

দুপুর প্রায় ১২টায় বাণীশান্তা ফেরিঘাট থেকে গুগল ম্যাপ আর স্থানীয় লোকজনের সাহায্যে আমরা এসে পৌঁছালাম শুরুতেই বলা সেই মাটির রাস্তায়। কারোরই দোষ নেই। দুপক্ষই আমাদের গন্তব্যে জলদি পৌঁছে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সেদিনই সকালে প্রচণ্ড বৃষ্টি হওয়ায় পুরো রাস্তাই থকথকে কাদা।

প্রায় ২৪০ কিলোমিটার রাস্তা রাইড করে এসে উপকূলীয় অঞ্চলের বিখ্যাত কাদার ভেতরে প্রায় ঘণ্টাখানেক যুদ্ধ করে মোটরবাইক ঠেলে পাকা রাস্তায় পৌঁছে দুজনেরই অবস্থা কাহিল।

রিসোর্টে কল করে জানানো হলে উদ্ধারকর্তা হিসেবে আবির্ভাব হলো মনজিত ভাইয়ের। তিনি আমাদের মোটরবাইক নিয়ে রওনা হলেন ভেজা ইটের রাস্তা ধরে, আর আমরা রওনা হলাম হেঁটে।

রোদের মধ্যে প্রায় দেড় কিলোমিটার হেঁটে আমরা যখন রিসোর্টের কাছাকাছি পৌঁছালাম, পথের ক্লান্তি যেন নিমেষে উধাও হয়ে গেল। ঢাংমারি খালের এপারে পানির ওপর আমাদের চমৎকার রিসোর্ট আর ওপারে গাঢ় সবুজ সুন্দরবন।

বনের নিস্তব্ধতার নিজস্ব একটা ভাষা আছে। শহুরে কান যেটাতে অভ্যস্ত হতে একটু সময় নেয়। সেই নৈঃশব্দ্য উপভোগ করতেই বনে আসা। দিনরাত নাম জানা না-জানা নানা রকম পাখির ডাক, ঝিঁঝিঁ, ব্যাঙ, তক্ষক আর অচেনা প্রাণীর অদ্ভুত ডাক।

লাইট পলিউশনবিহীন রাতের আকাশে কোটি কোটি তারার মেলা আর ভোরে চোখ খুললেই যত দূর চোখ যায়, শুধু সবুজ। বন বিভাগ থেকে বনে ঢোকা বারণ, তাই এবার বাঘ মামার পায়ের ছাপের সঙ্গেও দেখা হয়নি।

ফেরার সময় বাণীশান্তা ফেরিঘাটে এসে ঘণ্টাখানেক ধরে বসে আছি। ফেরির দেখা নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেল ঘাটে যথেষ্ট পরিমাণে গাড়ি-ঘোড়া না জমলে নাকি ফেরি ছাড়া হয় না। ঘণ্টাখানেক বসে থাকার পর ফেরি এপাড়ে এল ঠিকই, কিন্তু সেই একই কারণে ফেরি ওপাড়ে যাবে না।

এরপর আরও প্রায় ঘণ্টাদুয়েক বৃষ্টির মধ্যে বসে থেকেও গাড়ি-ঘোড়া না পেয়ে অগত্যা আমাদের মোটরবাইক নিয়ে আর পুরো ফেরি রিজার্ভ করেই রওনা হলাম আবার লাউডোব ফেরিঘাটের দিকে।

সুন্দরবনের ধার ঘেঁষে সুন্দর দুটি দিন কাটিয়ে, খুলনা শহরে প্রিয় দম্পতি ছোট ভাইবোন মিলি আর খালিদের আতিথেয়তায় বিখ্যাত কামরুলের চুইঝাল আর শতবর্ষী ইন্দ্রমোহনের দারুণ সন্দেশ খেয়ে আমরা রওনা হলাম ঢাকার পথে। সেই গল্প নাহয় আরেক দিনের জন্য তোলা থাকল।

হেলমেটের ভেতরে হাইওয়ের বাতাসের শব্দ নেশা ধরিয়ে দেয়। সেই শব্দের নেশায়, নৈঃশব্দ্যের নেশায় শহরের কোলাহল ছেড়ে মাঝেমধ্যে কিছুদিনের জন্য নিজের মতো করে হারিয়ে যাওয়ায় বোধ হয় কোনো ক্ষতি নেই। হোক না বনবাসে।

প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২৩, ১১: ৪৯
বিজ্ঞাপন