আমাদের দেশের নেত্রকোনা অঞ্চল অপার সৌন্দর্যের এক ভান্ডার। নিভৃতচারী ভ্রমণপিয়াসীদের জন্য এক দারুণ স্থান এটি। আর এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মনোমুগ্ধকর ইতিহাসের নানা গল্প। উত্তরের গারো পাহাড় থেকে নেমে আসা এক নদীর নাম ছিল ‘সমসাঙ্গ’। ওই নদীর তীরে ধীবরেরা বসবাস করতেন। তাঁদের বলা হতো ‘পাটুনি’। তখন ওই অঞ্চল শাসন করতেন গারো সম্প্রদায়ের এক দলপতি, যাঁর নাম বাইশা গারো। বিভিন্ন কারণে বাইশা গারোর ওপর ধীবরেরা সন্তুষ্ট ছিলেন না। কিন্তু শক্তি আর সাহস কম বলে তাঁকে মেনে নিতে বাধ্য ছিলেন। ১২৮০ খ্রিষ্টাব্দে বিখ্যাত সাধক সোমেশ্বর পাঠক কামরূপ কামাখ্যা তীর্থ দর্শন শেষে গারো পাহাড়ে আসেন। ওই সময় গারো পাহাড় ও তার আশপাশের এলাকা ছিল বনজঙ্গলে ঢাকা।
নানা প্রজাতির পশুপাখির কলকাকলিতে সারাক্ষণ এলাকাটি মুখর থাকত। এখানকার সৌন্দর্য আর সুমসাং নদীতীরের নীরবতা সোমেশ্বর পাঠককে মুগ্ধ করে। তাঁর মনে বিশ্বাস জন্মে, সিদ্ধিলাভের জন্য স্থানটিই উত্তম। সোমেশ্বর তাঁর অনুচরদের নিয়ে সেখানেই আস্তানা গাড়েন। ক্রমে যোগাযোগ গড়ে ওঠে ওই এলাকার জেলেদের সঙ্গে। সোমেশ্বর ছিলেন অসামান্য বিদ্বান, বুদ্ধিমান ও বলিষ্ঠ। ধীবরেরা তাঁকে দেবতা এবং ত্রাতা মনে করতে থাকেন। তাঁকে ঘিরেই গড়ে ওঠে দুর্গাপুর। সুসং দুর্গাপুর নামেই পরিচিত ভ্রমণকারীদের কাছে।
বছরের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে সোমেশ্বরী ভিন্ন ভিন্ন রূপ নিয়ে হাজির হয়, বিশেষ করে শীতের আগমনী আমেজে এই ভ্রমণ প্রশান্তি দেবে আপনাকে। সোমেশ্বর পাঠক সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন সঙ্গে করে নিয়ে আসা লক্ষ্মীনারায়ণের বিগ্রহ। আগের বাসস্থান কান্যকুব্জ থেকে স্বজনদের নিয়ে এসে বসতি গড়েন তিনি সেখানে। এতে তাঁর শক্তি আরও কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। একসময় সুযোগ বুঝে ওই এলাকার অত্যাচারী শাসনকর্তা বাইশা গারোকে পরাজিত করে সোমেশ্বর প্রতিষ্ঠা করেন সুসং রাজ্য। এরপর তিনি নজর দেন রাজ্যের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নে।
ওই এলাকার ধীবরেরা সোমেশ্বর পাঠককে সাক্ষাৎ দেবতা মনে করতেন। তাঁরা ভাবতেন, জেলেদের উন্নতির জন্যই সোমেশ্বর ঠাকুর নিজ হাতে সুসং রাজ্য গড়েছেন। তাঁরা এ-ও মনে করতেন, সুসংয়ের মানুষের পানির কষ্ট দূর করতেই প্রভু সোমেশ্বর নিজ হাতের ভৃঙ্গার থেকে পানি ঢেলে দেওয়ায় সেখান থেকে সৃষ্টি হয় সোমেশ্বরী নদী। তবে অনেকেরই ধারণা, উত্তর পাহাড়ের ঝরনাধারা সমসাং বয়ে যেত ওই এলাকার ভেতর দিয়ে। সে ঝরনাধারার গতিপথ পরিবর্তন করে সোমেশ্বর পাঠক তা নিয়ে এসেছিলেন সুসংয়ের রাজধানী দুর্গাপুরের কাছে। এ কারণেই ওই নদীর নাম হয় সোমেশ্বরী নদী।
সেদিনের সেই সোমেশ্বরী নদীই বর্তমান নেত্রকোনা জেলার ভেতর দিয়ে বয়ে চলেছে। নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার বিজয়পুর বাংলাদেশের একমাত্র সাদা মাটির পাহাড় নামে খ্যাত ও ভবানীপুর গ্রামের ভেতর দিয়ে এই সোমেশ্বরী নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
বছরের বেশির ভাগ সময় সোমেশ্বরীর এক পাশজুড়ে থাকে ধু ধু বালুচর, অন্য পাশেই হালকা নীলাভ জল। পাহাড়ি নদী সোমেশ্বরীর স্বচ্ছ পানিতে পা ডুবিয়ে জীবনের অবসাদ নিমেষেই দূর হয়ে যায়। শুষ্ক মৌসুমে সোমেশ্বরী নদীর পানি কমে গেলেও তার দুই কূলজুড়ে থাকে বিস্তীর্ণ সোনালি-লাল বালু, যা দেখলেই মনে হবে যেন বহু প্রাচীন যুগের কোনো সমুদ্রতটে একাকী দাঁড়িয়ে জীবনের মানে খুঁজছেন আপনি।
সোমেশ্বরী নদীর দৃশ্য এবং দুর্গাপুর অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখলেই যে-কেউ মুগ্ধ হবে। গারো পাহাড়ের বুক চিরে প্রবাহিত সোমেশ্বরী নদীর পানি এ সময়ে কমে গেলেও পর্যটকেরা সারা দিন ঘুরেফিরে সোমেশ্বরী নদী ও তার দুই পাড়ের আদিবাসী মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবনযাপন, শিল্প-সংস্কৃতিসহ অনুপম নিদর্শন উপভোগ করতে পারবেন। সারা দিন ঘোরার জন্য মোটরসাইকেল বা সিএনজি ভাড়া করে নেওয়াই সবচেয়ে ভালো।
দুর্গাপুরের তালুকদার প্লাজার সামনে থেকে মোটরসাইকেল ভাড়া নিয়ে সোমেশ্বরী নদী পার হয়ে, গোলাপি পাহাড়, গারো পাহাড়, চিনামাটির পাহাড়ের নীল পানির হ্রদ, বিজয়পুর বিজিবি ক্যাম্প, রানিখং চার্চ ইত্যাদি থেকে ঘুরে আসতে পারবেন। এ ছাড়া ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে দেখতে পাবেন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংয়ের জন্য তৈরি কিছু পিলার।
সোমেশ্বরী নদী দেখতে যেভাবে যাবেন
ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে সরাসরি দুর্গাপুরের উদ্দেশে সরকার ও জিন্নাত পরিবহনের বাস ছেড়ে যায়। ভাড়া পড়বে ২৫০ থেকে ২৮০ টাকার মধ্যে। এই বাস আপনাকে সুসং দুর্গাপুরের বাসস্ট্যান্ডে নিয়ে নামাবে। দুর্গাপুর বলা হলেও সাধারণত এসব বাস সুখনগরী পর্যন্ত যায়। সুখনগরী থেকে নৌকায় করে একটা ছোট নদী পার হয়ে রিকশা, বাস বা মোটরসাইকেলে দুর্গাপুর যেতে হয়।
কোথায় থাকবেন
দুর্গাপুরে থাকার জন্য ভালো ব্যবস্থা হলো ইয়ুথ মেন খ্রিষ্টান অ্যাসোসিয়েশন বা ওয়াইএমসিএ-এর রেস্টহাউস ও কালচারাল একাডেমি। এ ছাড়া দুর্গাপুরে সাধারণ মানের কিছু হোটেল আছে। স্বর্ণা গেস্টহাউস, হোটেল সুসং, হোটেল গুলশান ইত্যাদি। এগুলোর ভাড়া খুব কম। এলাকাভিত্তিক বিশেষ খাবার নেত্রকোনা জেলার বিখ্যাত বালিশ মিষ্টি খেতে ভুলবেন না কিন্তু।
কোথায় খাবেন
যে রেস্টহাউসে থাকবেন, সেখানেই খাবারের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। তবে বিভিন্ন মধ্যমানের রেস্টুরেন্টে ভাত, ডাল থেকে শুরু করে সব ধরনের মাছ আর মাংসই পাবেন বিরিশিরিতে।
ছবি: লেখক