ইতিহাসের অক্সফোর্ড ফেরায় ছেলেবেলায়
শেয়ার করুন
ফলো করুন

অক্সফোর্ড শহরের আবিংটন রোডের স্পোর্টস ভিউ লজে সেদিনের সকালটা ছিল অসামান্য। চকচকে সোনারোদ আর হালকা হিম হিম সকাল টাইম মেশিনে করে আমাকে প্রাচীন অক্সফোর্ড থেকে নিয়ে গেল অঘ্রাণের শিশিরস্নাত আমার গ্রামের বাড়ির আলপথে। যে পথ ধরে আমার শৈশব হেঁটে হেঁটে পড়েছিল কৈশোরে। সেই সব দিনে অঘ্রাণ আসত বার্ষিক পরীক্ষার উত্তেজনা নিয়ে। পুকুরপাড়ের পাশ দিয়ে পাকা ধানের মাঝবরাবর সিঁথির মতো দুভাগ করে যে আলপথ চলে গেছে ফুলসাইন্দ গ্রামে, সেই পথ ধরেই আমি প্রতিদিন ভোরে যেতাম প্রাইভেট পড়তে। গণিত, ইংরেজি আর উচ্চতর গণিত পড়ে একসঙ্গে স্কুলের ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরতাম সেই বিকেলে। বসে বসে ভাবছি সেই জীবনের কথা, সহজ, সরল মায়াময় সেই সব দিনরাত্রির গল্প। যে গল্পের আকাশে হেলান দিয়ে বিশাল বপু নিয়ে ঘটোৎকচের মতো ঘুমিয়ে থাকে খাসিয়া জৈন্তার পাহাড়, বুকে সলতে ভরা মশালের মতো জাজ্বল্যমান কৈলাশটিলার গ্যাসক্ষেত্রের আগুনের পাইপ, মাঠভর্তি পাকা ধানের গন্ধ আর খালি পায়ে দূর্বাঘাসে শিশির আর ভেজা মাটির রেখা।  

বিজ্ঞাপন

মাথায় যখন চলছে এসবের আনাগোনা, ঠিক তখনি মৌনির ধাক্কায় সংবিৎ ফিরে পেলাম। সকালের নাশতার পর্ব শেষ করে ব্যাকপ্যাক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম হাজার বছরের পুরোনো অক্সফোর্ড শহরের বাকি রহস্যের সমাধানে। প্রথমেই যে প্রাচীন প্রত্নতাত্বিক ভবনটি ঘুরে দেখার সৌভাগ্য হলো, সেই ভবনটি হচ্ছে অক্সফোর্ডের প্রাচীনতম কলেজের একটি। নাম মাউডলিং কলেজ। যদিও ইংরেজিতে নামটি লেখা Magdalan কলেজ, কিন্তু উচ্চারণ করতে গেলে পড়তে হয় মাউডলিং কলেজ। সেই সঙ্গে রয়েছে লাগোয়া বিশাল চার্চ।

হাইড্রেনজা ফুলে শোভিত প্রায় পনেরোশো বছরের পুরানো মৌডলিং কলেজ
হাইড্রেনজা ফুলে শোভিত প্রায় পনেরোশো বছরের পুরানো মৌডলিং কলেজ
ছবি: লেখক
মাউডলিং কলেজের লাইব্রেরি
মাউডলিং কলেজের লাইব্রেরি
ছবি: লেখক

মাউডলিং কলেজের স্থাপত্যকীর্তি দেখতে হলে টিকিট কিনতে হয়। এমন প্রাচীন স্থাপত্যের সামনে এসে ভেতরটা না দেখে গেলে সুনীলের ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতার মতো আফসোস করতে হবে সারা জীবন। চৌধুরীদের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সুনীল দেখেছেন রাস উৎসবে সুন্দরী নারীদের নৃত্য। কিন্তু আমি এই অপরূপ রূপগাম্ভীর্যে গেটের সামনে থেকে দেখে ফিরে যেতে চাই না।

বিজ্ঞাপন

টিকিট কেটেই ঢোকা হলো ১৪৫৮ সালে নির্মিত ঐতিহাসিক মাউডলিং কলেজের ভেতরে। প্রথমে ঘুরে দেখলাম কলেজের ভেতরের স্থাপত্যবৈচিত্র্য, দারুণ হাইড্রেনজা ফুলে চারপাশ ছাওয়া মাঠ আর বিশ্ববিখ্যাত পদচিহ্ন। এই কলেজেই পড়েছেন ব্রিটিশ রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড, লেখক জুলিয়ান বার্নস, লর্ড রিচার্ড অ্যাটকিন, অস্কার ওয়াইল্ডসহ আরও অনেক বিখ্যাত মানুষেরা। কলেজের ভেতর ঘুরতে ঘুরতে হারিয়ে গিয়েছিলাম আমার স্কুলবেলায়। আমাদের স্কুলের নাম ছিল ফুলসাইন্দ দ্বিপাক্ষিক উচ্চবিদ্যালয়। সেই সময়ে সবগুলো ভবনই ছিল টিনশেডের। ঝুম বৃষ্টির দিনে কী মজা। কারও কথা কেউ শুনতে পেতাম না। শুধু ঝুম ঝুম শব্দ আর প্রাণপণ দুষ্টুমির মহড়া। তবে অষ্টম এবং দশম শ্রেণির ভবনটি ছিল দোতলা। খুবই প্রাচীন নোনাধরা এই ভবনের ওপরের তলায় বিজ্ঞানাগার এবং উচ্চতর গণিতের শ্রেণিকক্ষ। প্রাচীন প্রত্নতাত্বিক স্থাপত্যের মতো ঘুপচি, নোনাধরা আর পরগাছার শিকড়ে জড়ানো দোতলার কক্ষগুলোও ছিল প্রচণ্ড নড়বড়ে।

১০০০ বছরের পুরনো মাউডলিং কলেজের ভিতরে স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে লেখক
১০০০ বছরের পুরনো মাউডলিং কলেজের ভিতরে স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে লেখক
ছবি: লেখক

শুধু মেধাবী ছাত্ররা দোতলার কক্ষে ঢোকার সুযোগ পেত। বিশেষ করে নবম-দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্ররা সগর্বে দোতলার বিজ্ঞানাগারে কাচনলে লিটমাস টেস্ট, পদার্থবিজ্ঞানের পেন্ডুলামের কৌণিক টেস্ট অথবা জীববিজ্ঞানে কুনোব্যাঙ ব্যবচ্ছেদ করে ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানীর মতো সগৌরবে মাথা উঁচু করে বিজ্ঞানাগার থেকে বেরোত তখন নিচু ক্লাসের আমরা চেয়ে চেয়ে দেখতাম আর ভাবতাম একদিন আমরাও...। মাউডলিং কলেজ পরিক্রমা শেষে লাগোয়া মাউডলিং চ্যাপেলে প্রবেশ করে চক্ষু ছানাবড়া। একেবারেই ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবের মতো নকশা হলেও রঙিন কাচ আর কাঠের শিল্পকর্মগুলো ছিল অসাধারণ।

মাউডলিং কলেজের ঠিক পাশ দিয়ে যে ছোট শাখা নদীটি বয়ে গেছে, তার নাম শেরওয়েল। নির্জন একাকী ছিমছাম ছোট নদী শেরওয়েলের পাশে বসে নিজের অজান্তেই পার করে দেওয়া যায় ক্লান্তিহীন অপেক্ষার সময়। এ রকম আরও অনেক নদী সঙ্গী হয়েছে আমার যাপিত জীবনের সঙ্গে। এর মধ্যে অন্যতম যে নদীর গল্প বহুবার করেছি বহু লেখায়। সেই নদীর নাম দেওর ভাগা। প্রতিবারই যত নদীর সঙ্গ লাভ করি, ততবারই মধুকবির সেই লাইনগুলো মনে পড়ে।

বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ দলে
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মেটে কার জলে?

ছোট নদী শেরওূয়েলের তীরে সস্ত্রীক লেখক
ছোট নদী শেরওূয়েলের তীরে সস্ত্রীক লেখক
ছবি: লেখক

ততক্ষণে সূর্য দেবতা মাথার ওপর। বেলা দ্বিপ্রহর। রসনাও জানান দিচ্ছে বিলাসী ব্যবস্থা গ্রহণ করার। অগত্যা লিওন নামের বার্গার শপে ঢুকে মধ্যাহ্নভোজন শেষে বেরিয়ে পড়লাম আবারও। এবার উদ্দেশ্য অরিওল কলেজ। অক্সফোর্ডের প্রাচীন কলেজগুলোর মধ্যে অরিওল কলেজ একটি, যার গোড়াপত্তন হয় ১৩২৪ খ্রিষ্টাব্দে, যা ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মেন কলেজ অর্থাৎ শুধু পুরুষদের কলেজ হিসেবেই পরিচিত ছিল। ১৯৮৫ সালের পর থেকে মহিলা শিক্ষার্থীদের জন্যও উন্মুক্ত হয় কলেজটি। নোবেল বিজয়ী আলেকজান্ডার টড, জেমস মেডেসহ অগুনতি ম্যাক্সওয়েল, পুলিৎজারজয়ী মহামানবেরা পড়াশোনা করেছেন এই কলেজে। করোনার প্রকোপের কারণে বন্ধ থাকায় সুনীলের কবিতার মতোই গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে দেখতে হলো অরিওল কলেজের স্থাপত্য নিদর্শন।

অরিওল কলেজ থেকে বেরিয়ে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে আবার শুরু হলো অক্সফোর্ড পরিক্রমণ। হাঁটতে হাঁটতে এসে থামলাম বিখ্যাত বালিওল কলেজের বারান্দায়। সেই বিখ্যাত কলেজ, যেখানে পড়াশোনা করেছেন জন এক্লিফ, যিনি প্রথম ব্যক্তি হিসেবে বাইবেল ইংলিশে অনুবাদ করেছিলেন ১৩৮৪ সালে। আরও পড়াশোনা করেছেন তিনজন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হার্বার্ট এস্কোইট, হ্যারল্ড ম্যাকমিলান, এডওয়ার্ড হিথ এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। আর বিভিন্ন বিষয়ে অবদান রাখায় নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন নয়জন।

১০০০ বছরের পুরনো অরিওল কলেজ
১০০০ বছরের পুরনো অরিওল কলেজ
ছবি: লেখক
বিখ্যাত বালিওল কলেজ
বিখ্যাত বালিওল কলেজ
ছবি: লেখক

ছায়াঘেরা অপার্থিব প্রাকৃতিক পরিবেশে অক্সফোর্ডের এই প্রাচীন কলেজটি স্থাপিত হয়েছিল ১২৬৩ সালে জন বালিওল নামের ডারহামের এক ধনাঢ্য ব্যক্তি কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। শিক্ষাসংস্কৃতির গরিমায় উদ্ভাসিত কলেজটি ১৯২০ সাল পর্যন্ত ছিল নারী-পুরুষ বিভাজনের মতো একটি কূপমণ্ডূকতার চাদরে আচ্ছাদিত। কারণ, ১৯২০ সাল পর্যন্ত কলেজটিতে নারীদের ভর্তি ছিল নিষিদ্ধ। তবে ১৯২০ সালে কলেজ কর্তৃপক্ষ নারী–পুরুষের সম–অধিকারে বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে নারী শিক্ষার্থীদের ভর্তির দ্বার উন্মোচন করে।

অনেক হয়েছে, এবার বাড়ি ফেরার পালা। এদিকে সূর্যও বসেছেন পাটে। রাতের নিয়ন আলোয় অক্সফোর্ডের প্রতিটি ভবন যেন আরও রাজকীয় হয়ে উঠল নিমেষে। প্রতিটি সিংহদ্বারের কাঠের কারুকাজমণ্ডিত বন্ধ কপাটগুলো যেন জানান দিচ্ছিল বাড়ি ফেরার বারতা। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে আসতে থাকে হাজার বছরের পুরোনো এই শহরে। শেষ গ্রীষ্মের রৌদ্রস্নাত দুপুরের পরে আবারও ফিরে আসে অবারিত বাংলার অঘ্রাণের সান্ধ্য হিম হিম আমেজ। আমরাও ধীর লয়ে ফিরছি অবিংটন রোডের লজে;

মাউডলিং কলেজের ভিতরে ১০০০ বছরের পুরনো সেন্ট মেরি চার্চ
মাউডলিং কলেজের ভিতরে ১০০০ বছরের পুরনো সেন্ট মেরি চার্চ
ছবি: লেখক

কিন্তু কোথাও গিয়ে যেন এই পরিভ্রমণ রাজকীয় শহরের বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দি ডিঙিয়ে আবারও আমাকে নিয়ে যাচ্ছিল আমার সেই আটপৌরে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দোতলায় নোনাধরা রংচটা বিজ্ঞানাগারে, শিকড়ে আচ্ছাদিত নড়বড়ে পুরোনো উচ্চতর গণিতের শ্রেণিকক্ষে। যেখানে নিজের অজান্তে শিশুমনে বপন হয়েছিল জ্ঞান, বিজ্ঞান আর শিক্ষার প্রতি অপার আনুগত্য আর মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠার বীজ।

লেখক: প্রভাষক এবং গবেষক আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড মেডিকেল ইমেইজিং, এংলিয়া রাস্কিন ইউনিভার্সিটি কেমব্রিজ।

প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২২, ০৩: ২১
বিজ্ঞাপন