কামরূপের রহস্যময় কামাখ্যা মন্দির
শেয়ার করুন
ফলো করুন

কামরূপ কামাখ্যা। এখানকার অরণ্য আর নির্জন পথে নাকি ঘুরে বেড়ায় মন্দ আত্মারা। কোনো পুরুষ সেখানে একবার গেলে নাকি ফিরে আসে না। যৌবনবতী নারীদের রাজত্ব এখানে। তারাই পুরুষদের জাদু করে ক্রীতদাস করে রাখে। এমন অনেক লুকোনো রহস্য, রোমাঞ্চ আর গল্পগাথায় শৈশবজুড়ে থাকা এই জাদুনগরীর প্রতি হাতছানি ছিল সব সময়!

সুযোগটা মিলল ভারত সরকারের আমন্ত্রণে গণমাধ্যম প্রতিনিধিদলের অংশ হয়ে দেশটি ভ্রমণে। যদিও গুয়াহাটি সফরের সূচিতে ছিল না, কামাখ্যা মন্দির দর্শন। তবে মনের মধ্যে সুপ্ত বাসনাটা পুষে রেখেছিলাম।

মন্দিরের প্রধান ফটকের সামনে লেখক
মন্দিরের প্রধান ফটকের সামনে লেখক

সেটাই উগরে দিলাম গুয়াহাটি বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে আসা আসামের মেয়ে হিমাদ্রির কাছে। আসাম সরকারের জনসংযোগ দপ্তরের এই তথ্য কর্মকর্তা হাসিমুখে জানিয়ে রাখলেন, ‘টাইট’ শিডিউলের মধ্যে তিনি যেকোনোভাবে একটা ব্যবস্থা করে রাখবেন। আশ্বাসে উধাও আমার তামিলনাড়ুর কিম্বাতুরে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে পাঁচ ঘণ্টার উড়ানের ক্লান্তি।

বিজ্ঞাপন

ততক্ষণে গুয়াহাটির লোকপ্রিয় গোপীনাথ বরদোলই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসাম সরকারের জনসংযোগ দপ্তরের উষ্ণ আতিথেয়তায় সিক্ত আমরা। সামনে-পেছনে কড়া নিরাপত্তায় আমাদের বাস ছুটল হোটেলের উদ্দেশে। পাঁচ তারকা হোটেলে যখন পৌঁছালাম, তখন ঘিরে ধরেছে ক্লান্তি। তবু রক্তের ভেতর শুনতে পাচ্ছিলাম চেনা রোমাঞ্চের সুর।

পাহাড়ি পথ বেয়ে আমাদের যাত্রা
পাহাড়ি পথ বেয়ে আমাদের যাত্রা

মন্দির দর্শনে নাকি দিবাগত রাত সাড়ে তিনটা থেকে লাইন ধরতে হয়। মন্দিরের দ্বার খোলে সকাল সাড়ে আটটায়। তবে হিমাদ্রি জানিয়ে রেখেছেন, আমরা তাঁদের অতিথি। বিশেষ অনুমতি নিয়ে রাখা হবে আমাদের জন্য। হিমাদ্রির এই আশ্বাসে তর সয়নি দলের অন্যতম সদস্য শিপন হাবিবের। ডিনারেই শিপন তাগিদ দিল, আজ রাতেই যেতে চাই। আমি যাব কি না। টানা ভ্রমণক্লান্তি, সঙ্গে হিমাদ্রির আশ্বাস—সব মিলিয়ে পরেই যাব সিদ্ধান্ত নিলাম।

পরদিন টানা শিডিউল। আইআইটি, গুয়াহাটি, ওখানকার টিভি স্টেশন, সচিবালয়, মুখ্য সচিব ও পরিকল্পনামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে সকাল থেকে রাত। এর মধ্যেই হিমাদ্রি জানিয়ে রাখলেন, পরদিন সকাল সাড়ে সাতটায় হোটেল থেকে আমাদের যাত্রা মন্দিরের উদ্দেশে। ১০টার মধ্যেই কামাখ্যা দেবীর মুখদর্শন শেষে ফিরিয়ে আনা হবে হোটেলে। দুপুরেই যে আমাদের কলকাতার ফ্লাইট!

বিজ্ঞাপন

সকাল সকাল তৈরি। আট দিনের ভ্রমণে আজই প্রথম পাঞ্জাবি পরলাম। প্রাতরাশ করব না করব না ভেবেও অল্প কিছু ফলাহারেই সারলাম। আমাদের দলের দেখভালের দায়িত্বে থাকা ভারতীয় পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তা পবন সাহারান হোটেলের লবিতে মুগ্ধতা জানিয়ে বললেন, ‘এটা কি তোমাদের বিশেষ কোনো পোশাক?’ বললাম, ‘হ্যাঁ। আমরা আমাদের পার্বণে এমন পোশাকই পরি।’

ঠিক ৭টা ৩০ নয়, তারও মিনিট ১৫ পর বাস ছাড়ল। আধঘণ্টায় আমরা পৌঁছে গেলাম ‘মিথ’ ঘিরে থাকা নীলাচল পাহাড়ের পাদদেশে। বড় ফটকে দিকনির্দেশনা মন্দিরের। সেই পথ পাহাড়ি আঁকাবাঁকা। বাস ছুটল আরও উঁচুতে। যেখানে থামল, সেখানে সারি সারি দোকান। তাতে পূজার ফুল, নৈবেদ্য, প্রসাদসহ ঠাসা নানা উপকরণ। আছে কামাখ্যা দেবীর মূর্তি, রুদ্রাক্ষের মালা আর নানা তৈজস।

মন্দিরের বাইরে পূজার উপকরণে ভর্তি দোকান
মন্দিরের বাইরে পূজার উপকরণে ভর্তি দোকান

বিক্রেতার প্রলুব্ধ করা কথার পসরায় মুখর চারপাশ। মজে গিয়ে ভক্তেরা কিনছেনও কেউ কেউ। কেউবা এড়িয়ে যাচ্ছেন। পাশ কাটিয়ে হেঁটে হেঁটে উঁচুতে উঠছিলাম আমরা। ভক্তদের বেশির ভাগের পরনে লাল রঙের পোশাক। নারীরা এসেছেন লাল কাপড়ে। শত শত পুণ্যার্থী।

আর চারপাশে পাণ্ডা। মানে মন্দিরের পূজারি। চুক্তিতে ভক্তদের মন্দিরে নিয়ে যান। পূজার ব্যবস্থা করেন। চাইলে বলির পাঁঠা কিংবা কবুতরও মেলে তাঁদের মধ্যস্থতায়।
মূল ফটক দিয়ে নয়, মন্দিরের পাশে বিশ্রামকক্ষ। সেখানে আমাদের স্বাগত জানালেন মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের মেয়ে রিচা শর্মা। তিনি মন্দিরের প্রশাসনিক দায়িত্বেও আছেন। সেখানেই কিছুটা জিরিয়ে নেওয়া। এর মধ্যে মন্দিরে আমাদের প্রবেশে সব ব্যবস্থা করল আসাম সরকারের জনসংযোগ দপ্তর।

সেই সুযোগে দলের চার সদস্য, আমরা প্রত্যেকে ১০০ রুপিতে সংগ্রহ করলাম পূজার নৈবেদ্য। মন্দির প্রাঙ্গণে জুতা রেখে যেতে হয়। বিশ্রামকক্ষেই আমরা যাঁর যাঁর জুতা রাখলাম। ভেতরে যাঁরা প্রার্থনা-পূজা দিতে চান, তাঁদের রেখে যেতে হয় মানিব্যাগ, মুঠোফোন, ঘড়িও। তবে আমাদের সেই ঝক্কিতে পড়তে হয়নি।

নীলাচল পর্বতের গায়ে খোদাই পুরাণগাথা
নীলাচল পর্বতের গায়ে খোদাই পুরাণগাথা

মূল মন্দিরে লাইন ধরে প্রবেশ করলাম সবাই। থেমে থেমে ঘণ্টা বাজছিল। ধূপ, রক্তজবা, মোমবাতি ও প্রদীপের গন্ধে মোহিত এক ভিন্ন জগৎ। চারপাশে বাঁধানো চাতাল। কতশত বছরের প্রাচীন দেয়াল। তাতে দেবদেবীসহ নানা রকমের মূর্তি ও কারুকার্য। মন্দিরে চারটি কক্ষ। একটি গর্ভগৃহ এবং তিনটি মণ্ডপ। যেগুলোর স্থানীয় নাম চলন্ত, পঞ্চরত্ন ও নাটমন্দির। ছবি তোলা নিষেধ। সাবধান বাণীতে লেখা, ছবি তুললে ২ হাজার ১০০ রুপি জরিমানা। ভেতরে জরিমানার পরিমাণ বেড়ে পাঁচ হাজার রুপি।

গর্ভগৃহটি পঞ্চরথ স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি। অন্যগুলোর স্থাপত্য তেজপুরের সূর্যমন্দিরের মতো। ওগুলোতে খাজুরাহো মন্দিরের আদলে খোদাইচিত্র। গর্ভগৃহে প্রবেশের আগেই আসনে কামাখ্যা দেবীর মূর্তি। পুরোহিতের উচ্চারিত মন্ত্র পাঠ করলাম আমরা। এরপর গর্ভগৃহ। এটি গুহার মতো। ছোট ও অন্ধকারাচ্ছন্ন। সরু খাড়া সিঁড়ি পেরিয়ে সেখানে পৌঁছে রক্তজবা পুরোহিতের হাতে দিলাম। ফুলে ভরা পাথরখণ্ড। এটিই দেবি সতীর জননেন্দ্রিয়। ফুলগুলো তাতে ছুঁইয়ে গলায় পরিয়ে দিলেন পুরোহিত। আর ভূগর্ভস্থ জলে বাকি নৈবেদ্য ছুঁইয়ে নিজের কাছে রাখলাম। এটিই কামাখ্যা দেবীর আশীর্বাদ।
বেরোনোর করিডরে আরও কিছু দেবীর মূর্তি। প্রতিটির সঙ্গে রয়েছেন পুরোহিত। তাঁরা দেবীর পায়ে পূজা দিতে অনুরোধ করছেন। সঙ্গে বলছেন, ‘তোমার পুণ্য হবে, দেবীর পায়ে অর্থ দাও।’

মন্দির থেকে বেরিয়ে এবার প্রদীপ আর ধূপকাঠি জ্বালানোর পালা। শত শত পুণ্যার্থী ব্যস্ত তাতে। আমরাও শামিল হলাম। পাশে পাণ্ডাদের দেখা গেল ভক্তদের নিয়ে বলির আয়োজনে।

৫২৫ ফুট উঁচুতে এই কামাখ্যা মন্দির। প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ হাজার ভক্ত-পুণ্যার্থী ভিড় করেন। ছুটির দিনে তা আরও বাড়ে। বিশ্বাস, মা কামাখ্যার মন্দির থেকে কেউ খালি হাতে ফেরেন না।

নীলাচল পর্বত থেকে পাখির চোখে গোহাটি শহর
নীলাচল পর্বত থেকে পাখির চোখে গোহাটি শহর

প্রতিবছর গ্রীষ্মকালে বসে অম্বুবাচি মেলা। সে সময় কামাখ্যা দেবীর ঋতুমতী হওয়ার ঘটনাকে উদ্‌যাপন করা হয়। এই সময় মূল গর্ভগৃহের প্রস্রবণের জল আয়রন অক্সাইডের প্রভাবে লাল হয়ে থাকে। ফলে এটি ঋতুস্রাবের মতো দেখায়। প্রতিবছর অম্বুবাচি মেলা উপলক্ষে লাখো পুণ্যার্থী আসেন মন্দিরে।

পুরাণমতে, কামাখ্যা মন্দিরে দেবী সতীর গর্ভ এবং যোনি পড়ে ছিল। সে কারণেই দেবী কামাখ্যাকে উর্বরতার দেবী বা রক্তক্ষরণকারী দেবী বলা হয়।

সত্য যুগে দক্ষরাজের স্ত্রী বারিণীর গর্ভে জন্ম নেন সতীদেবী। ইচ্ছার বিরুদ্ধে সতীদেবী ‘যোগী’ মহাদেবকে বিবাহ করায় ক্ষুব্ধ হন বাবা দক্ষ। মহাদেবের ওপর প্রতিশোধ নিতে আয়োজন করেন বৃহস্পতি নামের এক যজ্ঞ। তাতে মহাদেব ও দেবী সতী ছাড়া প্রায় সব দেব-দেবীকে নিমন্ত্রণ করেন। মহাদেবের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সতী মহাদেবের অনুসারীদের সঙ্গে নিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন। কিন্তু তাঁকে যথাযোগ্য সম্মান দেন না দক্ষ। তার ওপর অপমান করেন। অভিমানী সতী স্বামীর প্রতি পিতার এ অপমান সহ্য করতে না পেরে যোগবলে আত্মাহুতি দেন।

শোকাহত মহাদেব রাগান্বিত হয়ে দক্ষর যজ্ঞ ভন্ডুল করেন এবং সতীদেবীর মরদেহ কাঁধে নিয়ে বিশ্বব্যাপী তাণ্ডবনৃত্য শুরু করেন। ফলে বিশ্বময় প্রলয় শুরু হয়। দেবতারা অনুরোধ করেন মহাদেবকে এই নৃত্য থামানোর জন্য। কিন্তু মহাদেবের নৃত্য না থামালে বিষ্ণুদেব তাঁর সুদর্শন চক্র দ্বারা সতীদেবীর মরদেহ ছেদন করে মহাদেবকে নিরস্ত করেন। এতে সতীদেবীর দেহখণ্ডগুলো ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পড়ে, যা পবিত্র পীঠস্থান শক্তিপীঠ বা সতীপীঠ নামে পরিচিতি। কামাখ্যা সেই শক্তিপীঠের অন্যতম। বলা হয়, সতীদেবীর জননেন্দ্রিয় কামরূপের এই পর্বতে পড়লে তা নীল বর্ণ ধারণ করে। সে জন্য এই পর্বতের নাম হয়ে যায় নীলাচল।

এই মন্দির চত্বরে ১০ মহাবিদ্যার মন্দির রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে মহাকালী, তারা, ষোড়শী বা ললিতাম্বা ত্রিপুরাসুন্দরী, ভুবনেশ্বরী বা জগদ্ধাত্রী, কামাখ্যা, শৈলকন্যা, ব্রহ্মচারিণী বা তপস্যারিণী, মঙ্গলচণ্ডী, কুষ্মাণ্ডা, মহাগৌরী, চামুণ্ডা, কৌশিকী, দাক্ষায়ণী-সতী, চন্দ্রঘণ্টা, স্কন্দমাতা, কালরাত্রি, কাত্যায়নী, সিদ্ধিদাত্রী, শাকম্ভরী, হৈমবতী, শীতলা, সংকটনাশিনী, বনচণ্ডী, দেবী দুর্গা, মহাভৈরবী, ধূমাবতী, ছিন্নমস্তা, বগলামুখী, মাতঙ্গী, দেবী কমলা—এই ৩০ দেবীর মন্দির। এর মধ্যে ত্রিপুরাসুন্দরী, মাতঙ্গী ও কমলা দেবী প্রধান মন্দিরে পূজিত হন। অন্য দেবীদের জন্য পৃথক মন্দির আছে। হিন্দুদের, বিশেষত তন্ত্রসাধকদের কাছে এই মন্দির একটি পবিত্র তীর্থ।

তবে আমাদের এই পুণ্য যাত্রায় তান্ত্রিকদের দেখা না মিললেও অনেক সন্ন্যাসীর দেখা মিলেছে। একটা সময় হয়তো এই নীলাচল পাহাড় আর অরণ্য ঘিরে তন্ত্রসাধকেরা ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। তাঁদের ঘিরেই ছড়াত নানা কল্পকথা। দূর থেকে সেই কল্পকথাতেই যত রহস্যময়তা।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
ছবি: লেখক

প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২৩, ০৮: ৩০
বিজ্ঞাপন