আখরোটের দেশে তিন দিন
শেয়ার করুন
ফলো করুন

আমাদের মেয়ে এলিন ও আমরা দুজন, এই তিনজন তিন দিন হাতে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম ফ্রান্সের দক্ষিণে, ডরডোন নদীর তীর ঘেঁষে ছবির মতো সুন্দর একটি গ্রামে। নাম বুতিয়ের। ফ্রান্সের দক্ষিণে হলেও, আমাদের যেতে হয়েছে উত্তরে। কারণ, আমরা থাকি আরও দক্ষিণে, গারোঁন নদীর তীরে, তুলুজে। ২০০ কিলোমিটার বা ১২৫ মাইল পথ। অনায়াসে দুই ঘণ্টা সময়ে পৌঁছে গেলাম।

তিন দিন তিনজনের থাকার জন্য গুনতে হয়েছে ১২০ ইউরো
তিন দিন তিনজনের থাকার জন্য গুনতে হয়েছে ১২০ ইউরো
ছবি: লেখক

আমাদের তিনজনের কাজ ভাগ করা ছিল। আমার স্ত্রী ইন্টারনেট ঘেঁটেঘুঁটে আমাদের থাকার জন্য পাহাড়ের ঢালে ছোট্ট একটি বাসা ভাড়া করেছেন। তিন দিন তিনজনের থাকার জন্য গুনতে হয়েছে ১২০ ইউরো। এলিনের কাজ হচ্ছে দর্শনীয় স্থান আর রেস্তোরাঁর খোঁজ দেওয়া। মাঝেমধ্যে সে বুদ্ধিও ধার দেয়। আমার কাজ হচ্ছে গাড়ি চালানো। মহাসড়কে গাড়ি চালাতে মোটেও অমনোযোগী হওয়া চলবে না এবং বেঁধে দেওয়া গতিবেগ অতিক্রম করা যাবে না। কিছু দূর পরপর রাডার বসানো আছে। ওভার স্পিড হলেই আর রক্ষা নেই, দিনের ঝকঝকে আলোতেও রাডারের ফ্লাস চোখ ধাঁধিয়ে জ্বলে উঠবে। এরপর দুদিনের মাথায় বাড়ির ঠিকানায় ঠিক ঠিকই হাজির হয়ে যাবে সরকারি সিলমোহরযুক্ত একটি চিঠি। তাতে উল্লেখ থাকবে অর্থদণ্ডের পরিমাণ। অপরাধের গুরুত্ব অনুসারে ড্রাইভিং লাইসেন্সের মোট ১২টি পয়েন্ট থেকে কতটা পয়েন্ট কেটে নেওয়া হয়েছে, চিঠিতে তা–ও ঘটা করে জানিয়ে দেওয়া হবে। এ চিঠি এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। কেউ সে চেষ্টাও করে না।  

বিজ্ঞাপন

মহাসড়ক ধরে আমাদের গাড়ি দ্রুত এগিয়ে যায়। পথের দুধারে অনুচ্চ পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সূর্যমুখীর দিগন্ত প্রসারিত ক্ষেত। গাঢ় নীল আকাশের নিচে চারদিকে শুধু পাগল করা হলুদ রঙের উচ্ছল, উজ্জ্বল আভা, এক বিস্ময়কর সৌন্দর্য। মাঝেমধ্যে আঙুরের বাগান, সারি সারি বহু পুরোনো জলপাইগাছ। দেখতে দেখতেই আমরা পৌঁছে যাই আমাদের গন্তব্যে।

ফ্রান্সের দক্ষিণে চমৎকার জীববৈচিত্র্যে ভরপুর ডরডোন নদীটির ৪৮৩ কিলোমিটার বা ৩০০ মাইল অববাহিকার পুরো অঞ্চল ইউনেসকো ঘোষিত সংরক্ষিত অঞ্চল
ফ্রান্সের দক্ষিণে চমৎকার জীববৈচিত্র্যে ভরপুর ডরডোন নদীটির ৪৮৩ কিলোমিটার বা ৩০০ মাইল অববাহিকার পুরো অঞ্চল ইউনেসকো ঘোষিত সংরক্ষিত অঞ্চল
ছবি: লেখক

বুতিয়ের গ্রামে ঢোকার পথেই ডরডোন নদী। চমৎকার জীববৈচিত্র্যে ভরপুর নদীটির ৪৮৩ কিলোমিটার বা ৩০০ মাইল অববাহিকার পুরো অঞ্চলটি ইউনেসকো ঘোষিত সংরক্ষিত অঞ্চল। বুতিয়ের গ্রামের নির্জনতা শুধু নয়, আরও সুবিধা আছে। প্রায় অর্ধেক খরচে থাকা যায়।

বিজ্ঞাপন

এখান থেকে অনেক কাছে অনেকগুলো দেখার মতো জায়গা আছে। যেমন মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে রোকামাডুর, বানরের অভয়ারণ্য। এক বিকেল এমন অভয়ারণ্যে নির্ভয়ে বানরদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো যায়। এখানকার দক্ষ কর্মীরা বানরদের বিচিত্র জীবনের খুঁটিনাটি ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষায় বর্ণনা করে দর্শনার্থীদের কৌতূহল মেটাতে অন্তঃপ্রাণ।

বুতিয়ের গ্রামে ঢোকার পথেই ডরডোন নদী
বুতিয়ের গ্রামে ঢোকার পথেই ডরডোন নদী
ছবি: লেখক

অন্যদিকে, একই দূরত্বে পাদিরাক গ্রামে দেখা পাওয়া যাবে শয়তানের গর্ত বলে পরিচিত ৭৫ মিটার বা ২৪৬ ফুট গভীর অন্ধকূপ, পাতাল নদী হ্রদ আর বিশাল হলঘরের মতো পাতালমহল। সংরক্ষিত প্রাকৃতিক উদ্যানে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে পাহাড়ি ইগল আর মানুষের গভীর সখ্য। এ ছাড়া অঞ্চলজুড়ে আছে জাদুঘরসহ বহু চিত্তাকর্ষক আর ঐতিহাসিক স্থাপনা।

মানুষজনের দেখা নেই। সমস্ত অঞ্চলজুড়ে এক অদ্ভুত নির্জনতা
মানুষজনের দেখা নেই। সমস্ত অঞ্চলজুড়ে এক অদ্ভুত নির্জনতা
ছবি: লেখক

আমাদের থাকার জায়গার চারদিকে মাঠের পর মাঠ শুধু আখরোট অর্থাৎ ওয়ালনাটের বাগান। বিশাল অঞ্চলজুড়ে আখরোটগাছের প্রাচুর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছি। গ্রামীণ পথ ধরে মাইলের পর মাইল ছায়াঘেরা আখরোটবাগান। মানুষজনের দেখা নেই। পুরো অঞ্চলজুড়ে এক অদ্ভুত প্রশান্তিময় নির্জনতা। মাঝেমধ্যে বাগানের পাশে পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আখরোটচাষিদের সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। তাতে টেলিফোন নম্বর উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে, ‘খামার থেকে সরাসরি সুলভ মূল্যে আখরোট কিনতে চাইলে যোগাযোগ করুন।’

একটি বিজ্ঞপ্তি দেখে আমার স্ত্রী ফোন করে, এমন বাদাম কেনার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে তাঁকে জানানো হলো, ‘দুঃখিত, গত বছরের উৎপাদিত আখরোট আর অবশিষ্ট নেই, নতুন ফসলের জন্য অপেক্ষা করতে হবে কম করে আরও চার থেকে পাঁচ সপ্তাহ।’

আমাদের থাকার জায়গার চারদিকে মাঠের পর মাঠ শুধু আখরোটের অর্থাৎ ওয়ালনাটের বাগান
আমাদের থাকার জায়গার চারদিকে মাঠের পর মাঠ শুধু আখরোটের অর্থাৎ ওয়ালনাটের বাগান
ছবি: লেখক

আগস্টের শেষে, এ সময়ে গাছে গাছে সবুজ আখরোটের প্রাচুর্য। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে শাঁস পরিপুষ্ট হবে, তখনই আখরোটচাষিরা ফসল ঘরে তুলবেন। ফ্রান্সে যত্রতত্র আখরোটগাছের দেখা পাওয়া গেলেও, দক্ষিণে এর চাষ করা হয়। এ দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ৬০ শতাংশ আখরোট এই দক্ষিণেই উৎপাদন হয়।

বিশ্বে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৪৫ লাখ টন আখরোট উৎপন্ন হয়। এ বাদাম উৎপাদনে শীর্ষে চীন, এরপর যুক্তরাষ্ট্র ও তৃতীয় স্থানে ইরান। দশম স্থানটির দখল নিয়ে ফ্রান্স এবং ভারত পাল্লা দেয়। ফরাসি কৃষি দপ্তরের তথ্যানুযায়ী প্রতিবছর ফ্রান্সে ৩৬ হাজার টন আখরোট উৎপন্ন হয়। ভারতে উৎপন্ন হয় ৩৩ হাজার টন।

আগস্টের শেষে, এ সময়ে গাছে গাছে সবুজ আখরোটের প্রাচুর্য
আগস্টের শেষে, এ সময়ে গাছে গাছে সবুজ আখরোটের প্রাচুর্য
ছবি: লেখক

উদ্ভিদবিদেরা মনে করেন যে আখরোট পারস্য থেকে গ্রিসে ও পরে রোমানদের কল্যাণে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। আখরোট এবং এর তেলের পুষ্টি ও ঔষধি গুণের খবর ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকেই ফরাসিদের জানা ছিল। তবে এমন বাদাম চাষের প্রসার ঘটতে শুরু করে ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে।

ছায়াঘেরা আখরোট বাগান
ছায়াঘেরা আখরোট বাগান
ছবি: লেখক

দেখতে খুব সুন্দর এ গাছ ২০ থেকে ২৫ মিটার উঁচু হয়ে থাকে। চাষের জন্য রৌদ্রোজ্জ্বল আর্দ্র ও চুনামাটিবিহীন স্থান নির্বাচন করতে হবে। জলাবদ্ধতা আর খরায় গাছটি বেঁচে থাকতে পারে না। উপযুক্ত স্থানে রোপণ করলে খুব একটা যত্নের প্রয়োজন পড়ে না। রোপণের ৮ থেকে ১০ বছরের মাথায় ফল দিতে শুরু করে। ১৫০ থেকে ১৬০ বছর পর্যন্ত ফল দেয়। প্রথম দিকে একটি গাছ বছরে ৭ থেকে ১০ কেজি ফল দিলেও বয়স্ক গাছে বছরে ৩০ কেজির বেশি ফলন হয়ে থাকে।

ফরাসিরা আখরোট খেতে খুব পছন্দ করে। স্যালাড, আইসক্রিম, কেক বানাতে, রান্নায় অঢেল আখরোট ব্যবহার করে। এ ছাড়া আখরোটের তেল এদের খুব প্রিয়। ম্যাগনেশিয়াম, ভিটামিন ই আর বি-এর সঙ্গে আয়রন, ক্যালসিয়াম, খনিজ, সূক্ষ্ম উপাদান ও আঁশসমৃদ্ধ এ বাদামে আরও রয়েছে ওমেগা-৩, যা হৃদ্‌রোগ প্রতিরোধে, স্মৃতিশক্তি ও একাগ্রতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।

স্থানীয় বাজারের সুসজ্জিত বুটিকে পাওয়া যাবে আখরোট এবং আখরোট দিয়ে তৈরি নানা মুখরোচক খাবার
স্থানীয় বাজারের সুসজ্জিত বুটিকে পাওয়া যাবে আখরোট এবং আখরোট দিয়ে তৈরি নানা মুখরোচক খাবার
ছবি: লেখক
লেখক–কন্যা এলিনের তৈরি আখরোটের কেক
লেখক–কন্যা এলিনের তৈরি আখরোটের কেক
ছবি : এলিন হাসান

চমৎকার স্বাদ, ঘ্রাণ আর পুষ্টিগুণের কারণে আখরোটের সমাদর পৃথিবীজুড়ে। স্থানীয় বাজারের সুসজ্জিত বুটিকে পাওয়া যাবে আখরোট ও আখরোট দিয়ে তৈরি নানা মুখরোচক খাবার।

একঘেয়ে রুটিনে বন্দী জীবন থেকে একচিলতে মুক্তি, কম কিসে! আখরোটের দেশে আমাদের তিনজনের তিন দিন খুব ভালো কেটেছে।

প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০২৩, ০৮: ০০
বিজ্ঞাপন