যাওয়ার মাত্র ২০ দিন আগে একদম ঝোঁকের বসেই টিকিটটা কেটে ফেললাম! কী করব, কোথায় থাকব, মূল্যস্ফীতি ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার পর দেশটার কী অবস্থা, তা নিয়েও বেশ দ্বিধা ছিল। সবকিছু এক পাশে রেখে পরিকল্পনা করা শুরু করলাম। ইন্টারনেট আর ব্লগ দেখে আট দিনের প্ল্যান গোছাতে যেয়ে মনটা একটু খারাপ হলো। ৬৫ হাজার ৬১২ বর্গকিলোমিটারের দেশটার আনাচকানাচে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ইতিহাস আর বৈচিত্র্যের সম্মিলন! তথাপি আট দিনে সাতটা শহর দেখার পরিকল্পনা গোছালাম।
পরিকল্পনামাফিক আমাদের ফ্লাইট ছিল দুপুর ১২টা ৫০–এ, শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইনসে। সময়মতো প্লেন ছাড়ল, শ্রীলঙ্কান ‘আইয়োবোয়া’ সম্ভাষণে স্বাগত জানালেন কেবিন ক্রুরা। একটা অ্যানিমেশন মুভি দেখতে দেখতে তিন ঘণ্টার ফ্লাইট আমাদের নিয়ে পৌঁছে গেল রাবণের দেশে। দেশ থেকে ইলেক্ট্রনিক ট্রাভেল অথরাইজেশন লেটার নিয়ে যাওয়ায় ইমিগ্রেশন পার হয়ে গেলাম কোনো রকমের ঝুটঝামেলা ছাড়াই। ইমিগ্রেশন অফিসার হাসিমুখে পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে নিজের দেশে স্বাগত জানালেন আমাদের। কোভিড–পরবর্তী সময় ও সাম্প্রতিক অস্থিরতার কারণে দেশে পর্যটক বেশ কম, প্রায় শূন্য বিমানবন্দর দেখে এমন আভাসই পেলাম।
শ্রীলঙ্কা যাওয়ার আগেই পরিচিত এক ভাইয়ের সূত্রে খোঁজ পেয়েছিলাম ট্যুরিস্ট গাইড কাম ড্রাইভার দিলশানের। আমাদের আট দিনের যাত্রায় সে আর তার লাল টুকটুকে গাড়িটা পাশে থাকবে সর্বক্ষণ—এই কথা পাকাপাকি করে এসেছিলাম দেশ থেকেই। হাসিমুখ অভ্যর্থনায় তার গাড়িতে চেপে বসলাম। প্রথম দিনেই আমাদের গন্তব্য ১৪৫ কিলোমিটার দূরের ছোট্ট পাহাড়ি শহর সিগিরিয়া। দুরন্তগতিতে গাড়ি ছুটল মসৃণ হাইওয়ে ধরে। সিগিরিয়া পৌঁছাতে পৌঁছাতেই প্রায় রাত ৮টা।
এবারের ট্রিপে আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল একদম স্থানীয় শ্রীলঙ্কার ফিল পাওয়ার জন্য হোম স্টে করার। প্রথম দিনের গন্তব্য প্যাসন রে ভিলা, সর্বদা হাসিমুখে থাকা এক দম্পতির বাড়ি আর ছোট্ট একটা ট্রি হাউজ। গাড়ির হর্ন শুনেই বাড়ির দিদি বাংলোর গেটটা খুলে দিলেন মিষ্টি হাসি মুখে নিয়ে। প্রথম দেখাতেই বাড়িটাকে খুব আপন আপন লাগল। সেই সঙ্গে আক্কে ও আইয়া (শ্রীলঙ্কান ভাষায় আপা ও ভাইয়া) যে আপ্যায়ন করলেন, সেটা পেয়েই মনটা ভালো হয়ে গেল। তাঁদের বাড়িতে প্রথম বাংলাদেশি অতিথি ছিলাম আমরা। ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হয়েই সিগিরিয়া টাউনে যেয়ে ডিনার করলাম।
শ্রীলঙ্কান ট্র্যাডিশনাল রাইস অ্যান্ড কারি আর কত্তু (রুটিকে ছোট ছোট টুকরা করে কাটা একধরনের খাবার)। টুকটাক ঘোরাঘুরিতেই বুঝতে পারলাম, কী শান্ত আর সুন্দর একটা শহর সিগিরিয়া। যদিও সেই রাতে জলদিই ঘুমাতে গেলাম, কারণ পরদিনের পরিকল্পনাটা বেশ লম্বা। পিদুরাঙ্গালা মাউন্টেন টপ থেকে সূর্যোদয় দেখা, এরপর সেখান থেকে ফিরে ব্রেকফাস্ট করে আবার সিগিরিয়া রক। এরপর আবার রওনা দিব ডাম্বুলা হয়ে ক্যান্ডির পথে। পুরো পরিকল্পনা জপতে জপতেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন ভোর চারটায় ঘুম থেকে উঠে দেখি, আমাদের আগেই আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড দিলশান পুরোপুরি রেডি! তাকে নিয়ে সকালের মিষ্টি হাওয়া খেতে খেতে পৌঁছে গেলাম পিদুরাঙ্গালা। মিনিট ত্রিশেক হাইকিং শেষে বাঁদর মশাইয়ের অভ্যর্থনা, ঠান্ডা হাওয়া আর সূর্যোদয়ের পরের মিষ্টি আলো—এই হলো আমাদের পিদুরাঙ্গালা সামারি। প্রায় ঘণ্টাখানেক থাকলাম, মন ভরে ভিটামিন ডি পোহালাম আর ফেরত আসার সময় সামনেই দেখলাম ময়ূর আর নাম না–জানা কত পাখি ঘুরঘুর করছে চোখের সামনে! এমন সব দৃশ্য দেখতে আমরা দিনের পর দিন কত জায়গায় ঘুরঘুর করি! লঙ্কার আনাচকানাচে এই সব যেন একদমই নস্যি! এরপর ফিরে আসি আমাদের বাংলোতে।
দেখি, গৃহকর্ত্রী আমাদের জন্য পল রুটি (নারিকেল দেওয়া রুটি), পাটিসাপটা, ডাল ভুনা, নিজেদের বাগানের কলা আর রিফ্রেশিং চা সাজিয়ে বসে আছেন নাশতার জন্য। নাশতা সেরেই আমরা ছুটলাম সিগিরিয়া রকের পথে, যার আরেক নাম লায়ন রক। বিদেশিদের জন্য আলাদা লেন, বেশ সাজানো–গোছানো পুরো জায়গাটা। সার্কভুক্ত দেশ হিসেবে এখানে প্রবেশ ফি গুনতে হয়েছে জনপ্রতি ১৫ ডলার। অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা অবশ্য জনপ্রতি ৩০ ডলার। টিকিট কাটার ফাঁকেই আলাপ হলো একদল ভারতীয় বন্ধুর সঙ্গে। কাজের সূত্রে শ্রীলঙ্কায় থাকেন বিহার, ঝাড়খণ্ড ও কর্ণাটকের এই বন্ধুরা। তাঁরাও ছিমছাম এই দেশটার বেশ প্রশংসা করলেন।
তাঁদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা পা বাড়ালাম সামনের দিকে। প্রতিটা বাঁকে বাঁকেই স্পষ্ট নির্দেশনা আর ইতিহাস সম্পর্কে বর্ণনা দেওয়া আছে বেশ সুন্দরভাবে। আমাদের দুজনের একটা ছবি তুলে দেওয়ার ছুতো হিসেবে পরিচিত হলাম কলেজপড়ুয়া একদল বান্ধবীর সঙ্গে। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে ওরাই নিজেদের মুঠোফোনে আমাদের সঙ্গে সেলফি তুলে রাখল। আমরাও একটা স্মৃতি রেখে দিলাম নাম না–জানা মেয়েদের।
প্রায় ৬০০ ফুট উঁচু এই স্থাপত্যের আনাচকানাচে ইতিহাস আর সভ্যতার নানা নিদর্শন। যত ওপরে উঠছিলাম, তত অবাক হচ্ছিলাম। যদিও আমরা ওপরে ওঠার আগেই এমন বৃষ্টি শুরু হলো যে ক্যামেরা বের করার জো ছিল না। বৃষ্টি মাথায় করেই পুরো সিগিরিয়া আরেকবার দেখলাম লায়ন রক থেকে। এরপর দ্রুত ফিরে আসি গাড়িতে। তালিকায় আরও বেশ কিছু জায়গা আছে, সেই হিসাব কষতে কষতেই বিশ্বের এই অষ্টম আশ্চর্য থেকে বিদায় নিলাম!
ক্যান্ডিতে যাওয়ার পথেই ডাম্বুলাতে প্রথম খেলাম কিং কোকোনাট! আর লাঞ্চে খেলাম ট্র্যাডিশনাল শ্রীলঙ্কান ডিশ লাম্প্রাইস (হলুদে ভাজা ভাত, সঙ্গে মুরগির মাংস, আচার, আলু আর মাছের কাটলেট) আর রাইস-কারি। খেয়েদেয়ে প্রথম গন্তব্য কান্ডালামা লেক। গাড়ি যেখানে নামিয়ে দিল, সেখান থেকে লেক আর লেকের শেষ প্রান্তের পাহাড়ের সারি দেখা যায়। দিলশান আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল স্লিপিং ওয়ারিয়রের। খেয়াল করে দেখলাম, আসলেই পাহাড়ের সারিটাকে একসঙ্গে দেখলে চোখ, নাক, মুখ ভেসে ওঠে।
জায়গাটা আরও ভালোভাবে দেখতে লেকের অন্যদিকে যেতে ইচ্ছা করল। দিলশান প্রথমে মানা করলেও পরে আমাদের আগ্রহ দেখে বলল, চাইলে যেতে পারি। কোমরসমান পানি পার হয়ে অন্য পাশে গেলাম। অন্য পাশের ভিউ দেখে বুঝলাম, এভাবে জামাকাপড় ভিজিয়ে আসাটাও সার্থক। লেকের দিগন্তঘেরা পাহাড়ের সারি। লেকের এদিক–সেদিক অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম, ছবি দেখলাম। শ্রীলঙ্কায় কত জায়গা দেখে যে মনে হয়েছে এক বিকেল কাটিয়ে দেওয়ার মতো! কিন্তু সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে না পারার কষ্ট নিয়েই আবার ফিরতে হয়েছে।
দিনের শেষ ভাগে আমাদের গন্তব্য ছিল ডাম্বুলা কেভ টেম্পল আর গোল্ডেন টেম্পল। গোল্ডেন টেম্পলে যেয়ে দেখলাম, বানর কী সুনিপুণভাবে শাপলা ফুল ছিঁড়ে খেতে পারে!
মিনিট দশেক হাইকিংয়ের পর কেভ টেম্পলে পৌঁছাতে হয়, যেখানে বুদ্ধের মূর্তির সংখ্যাটা ছিল মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো। ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ এই মন্দিরের চারপাশে দেখলেই পাহাড়সারি চোখে পড়ে, সারাক্ষণ এমন জায়গায় বসে থাকলেও ক্লান্তি বা বিরক্তি আসবেনা কারও মধ্যেই। সারা দিন মেঘ–বৃষ্টির সঙ্গে দারুণ তিনটা জায়গা দেখেই ক্যান্ডির পথে এগোলাম আমরা! দিন শেষে নিজেরাও অবাক হলাম মাত্র এক দিনেই এত কিছু দেখে ফেললাম, বাকি দিনগুলো না জানি কী অপেক্ষা করছে! প্রায় রাত ৯টার দিকে ক্যান্ডির হোম স্টেতে পৌঁছাই। বাড়ির কর্তার আদর-আপ্যায়নে আসলে কি টাকা দিয়ে থাকতে এলাম, না কারও বাসায় বেড়াতে এলাম—এই চিন্তা করতে করতেই তলিয়ে গেলাম গভীর ঘুমে।ডাম্বুলা কেভের ভেতরের বারান্দা