শয়তানের গর্তে এক দিন
শেয়ার করুন
ফলো করুন

অনেক দিন থেকেই ইচ্ছা ছিল শয়তানের গর্তে ঢুকব। গর্তটি ফ্রান্সে, প্যারিস থেকে সোজা দক্ষিণে ৫৩০ কিলোমিটার (৩৩০ মাইল), পাদিরাক নামে একটি গ্রামে। সে এক গভীর অন্ধকূপ, বিশাল এক ভুতুড়ে গর্ত। প্রথম দেখায় মনে হবে, কোন এককালে পেল্লায় এক গ্রহাণু মহাকাশ থেকে তীব্র বেগে ছুটে এসে পৃথিবীর মাটিতে আছড়ে পড়েছে। ফলে ভূমিতে সৃষ্টি হয়েছে একটি গভীর ক্ষত, গুহামুখ।

পাদিরাকের গর্তে প্রবেশের প্রধান ভবন
পাদিরাকের গর্তে প্রবেশের প্রধান ভবন
ছবি: লেখক।

আকাশের দিকে মুখ করা গর্তের ব্যাস ৩৩ মিটার (১০৮ ফুট)। আর গভীরতা ১০৩ মিটার (৩৩৮ ফুট) অর্থাৎ একটি ২৫ তলা দালানের মধ্যে সহজেই ঢুকে যাবে। সেই গভীরতায় রয়েছে ২০ কিলোমিটার (১২ মাইল) জুড়ে প্রবাহমান স্ফটিক স্বচ্ছ ফিরোজা রঙের জলের পাতাল নদী।

শয়তানের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা বা আগ্রহ কোনোটাই আমার কোনোকালেই ছিল না। তবে স্থানীয় লোকদের মুখে মুখে একটি গল্প প্রচলিত আছে, গল্পটি মন্দ নয়।

বিজ্ঞাপন

অনেক দিন আগের কথা, পাদিরাক গ্রামে এক সেয়ানা শয়তান হানা দেয় এবং কিছু মৃত ব্যক্তির আত্মা চুরি করে। এতে করে সেখানকার এক কামেল সন্ন্যাসী খুব ক্ষিপ্ত হন। তিনি শয়তানকে পাকড়াও করার জন্য গাধার পিঠে করে তার পিছু নেন। শয়তান বেকায়দা দেখে পা দিয়ে মাটিতে খুব জোরে এক আঘাত করে। ফলে সেখানে ঢাউস একটি গর্ত হয়ে যায়। তারপর সে একটি শর্ত দেয়, যদি বুজুর্গ সন্ন্যাসী এক লাফে গর্ত পাড়ি দিতে পারে, তবেই সে মৃত ব্যক্তিদের আত্মা ফেরত দেবে। সন্ন্যাসী মোটেই দেরি না করে এক লাফে গর্ত পাড়ি দেয়। শয়তান তখন চুরি করা আত্মাদের মুক্তি দিয়ে নিজের খোঁড়া সেই অন্ধকূপের মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।

পাদিরাকের গর্ত মুখের ব্যাস ৩৩ মিটার (১০৮ ফুট)। গভীরতা ৭৫ মিটার (২৪৬ ফুট)। এরপর সুড়ঙ্গপথে আরও খানিকটা নিচে নেমে গেলে দেখা পাওয়া যাবে পাতাল নদী, হ্রদ আর বিশাল হল ঘরের মতো পাতাল মহল
পাদিরাকের গর্ত মুখের ব্যাস ৩৩ মিটার (১০৮ ফুট)। গভীরতা ৭৫ মিটার (২৪৬ ফুট)। এরপর সুড়ঙ্গপথে আরও খানিকটা নিচে নেমে গেলে দেখা পাওয়া যাবে পাতাল নদী, হ্রদ আর বিশাল হল ঘরের মতো পাতাল মহল
ছবি সূত্র: পাদিরাক পর্যটন

গল্প যেমনই হোক, হাজার বছর আগে থেকে প্রাচীন মানুষেরা এখানকার এই গর্তের কথা জানত। তবে এই বিশাল অন্ধকূপের মধ্যে কী আছে, তা দেখতে কেউ কখনো সেখানে সাহস করে নামেনি। জীবনের মায়া সবারই আছে। এর রহস্য উদ্‌ঘাটনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৮৮৯ সাল পর্যন্ত।

বিজ্ঞাপন

তরুণ আইনজীবী এডুয়ার্ড-আলফ্রেড মার্তেল (১৮৫৯-১৯৩৮), প্যারিসে থাকতেন। ভূগোল, ভূতত্ত্ব, গুহা-পাতালবিদ্যায় তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। তাঁর খুব ইচ্ছা হলো দুর্গম এই পাতালপুরীর রহস্য উদ্‌ঘাটন করবেন। তিনিই প্রথম ১৮৮৯ সালের ৯ জুলাই কয়েকজন খুব অভিজ্ঞ এবং রোমাঞ্চপ্রিয় সঙ্গী সঙ্গে নিয়ে দীর্ঘ রশির মই বেয়ে এই গর্তে নামেন। নিচে নেমে সুড়ঙ্গ পথে অগ্রসর হয়েই পাতাল নদীর সন্ধান পান। পরদিন চামড়ার নৌকা নিয়ে আবারও সে গর্তে নামেন এবং নৌকা করে মাত্র মাইলখানেক অগ্রসর হতে পেরেছিলেন।

এডুয়ার্ড-আলফ্রেড মার্তেল (১৮৫৯-১৯৩৮) যিনি প্রথম অভিযান চালিয়েছেন এই পাতালপুরীতে এবং তিনি প্রথম এমন প্রাকৃতিক বিস্ময়কে বহির্বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছিলেন
এডুয়ার্ড-আলফ্রেড মার্তেল (১৮৫৯-১৯৩৮) যিনি প্রথম অভিযান চালিয়েছেন এই পাতালপুরীতে এবং তিনি প্রথম এমন প্রাকৃতিক বিস্ময়কে বহির্বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছিলেন
ছবি সূত্র: পাদিরাক পর্যটন

নিকষ কালো অন্ধকারে তাঁদের সঙ্গে ছিল মোমবাতি আর একধরনের লণ্ঠন। এরপর বেশ কয়েক বছর ধরে ধাপে ধাপে তিনি বহুবার পর্যবেক্ষণ করেন, ম্যাপ তৈরি করেন। অনেক মাপজোক আর পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তিনি নিশ্চিত হন যে সতর্ক হলে এমন বিশাল পাতালের জগৎ পরিদর্শনে করা তেমন ঝুঁকিপূর্ণ নয়। তিনি অনেক দেনদরবার করার পর অবশেষে গর্তসহ পাতাল নদীর পুরো সুড়ঙ্গপথ কিনে নেন।

১০ এপ্রিল ১৮৯৯। প্রথম এ পাতালপুরী পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এরপর ১৯০৬ সালে বিজলিবাতিতে আলোকিত করা হয়। ১৯৫০ সালে টেলিভিশনে পরপর অনেক সংবাদ প্রতিবেদন প্রচারিত হলে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে উৎসুক পর্যটকরা এখানে ভিড় জমাতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে শয়তানের গর্ত ‘গুফ দ্য পাদিরাক’ হয়ে ওঠে ইউরোপের এক আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র।

একটি স্ট্যালাকটাইট, লম্বায় ৬০ মিটার। বলা হয় ১ সেমি স্ট্যালাকটাইট তৈরি হতে সময় লাগে প্রায় ১০০ বছর
একটি স্ট্যালাকটাইট, লম্বায় ৬০ মিটার। বলা হয় ১ সেমি স্ট্যালাকটাইট তৈরি হতে সময় লাগে প্রায় ১০০ বছর
ছবি সূত্র: এলিন হাসান

পর্যটন দপ্তর জানিয়েছে যে বর্তমানে প্রতিবছর গড়ে প্রায় পাঁচ লাখ পর্যটক এখানে আসেন। এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পর্যটকদের জন্য খোলা থেকে। টিকিটের জন্য সাধারণত মাথাপিছু গুনতে হয় ১৯ দশমিক ৫০ ইউরো। আশপাশে রয়েছে চমৎকার সব রেস্টুরেন্ট। ১৫ থেকে ২০ ইউরো হলে হাঁসের তেলে ভাজা হাঁসের রান এবং খানিকটা সবজি আর এক কাপ কফি দিয়ে দুপুরের খাবার হয়ে যায়।

এতসব গল্প শোনার পর, খুব ইচ্ছা হলো এমন গর্তে ঢুকব। ফ্রান্স এবং ইউরোপের অন্য দেশগুলোতে জুলাই-অগাস্ট, এই দুই মাস গরমের ছুটি থাকে। এ সময়ে সব দর্শনীয় স্থানগুলোতে প্রচুর ভিড় হয়। ভিড় এড়াবার জন্য সেপ্টেম্বরের প্রথম দিনটি বেছে নিই। সেদিন খুব সুন্দর আবহাওয়া ছিল, খানিকটা মেঘলা আকাশ, তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে। কয়েক সপ্তাহ দাবদাহের পরে এমন চমৎকার তাপমাত্রায় গাড়ি চালাতে ক্লান্তি দূরের কথা, আনন্দই বেশি হয়। তা ছাড়া মহাসড়কের প্রশস্ত পথে মোটেও ভিড় নেই। আমাদের শহর, দক্ষিণ ফ্রান্সের তুলুজ থেকে সোজা উত্তরে ১০০ মাইল পথ যেতে আড়াই ঘণ্টা সময় যথেষ্ট। এতে করে মাঝখানে একটু থেমে এক কাপ কালো কফিতে চাঙা হওয়ার সময়ও পাওয়া যায়।

বছরজুড়ে ভূগর্ভের তাপমাত্রা থাকে ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর পানির ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস
বছরজুড়ে ভূগর্ভের তাপমাত্রা থাকে ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর পানির ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস
ছবি: লেখক

সকাল সাড়ে আটটায় রওয়ানা করে, বেলা ১১টায় পাতালপুরীর প্রবেশমুখে পৌঁছে গেলাম। অনলাইনে আগে থেকে টিকিট কেনা ছিল, তাই টিকিটের জন্য আর লাইনে দাঁড়াতে হয়নি। আমরা ১১টা ৩০ মিনিটের জন্য টিকিট কিনেছিলাম। সময়মতো ডাক এল গর্তে নামার। আগে থেকে বলে দেওয়া হলো সুড়ঙ্গপথ এবং পাতাল নদী দেখতে মোট দেড় ঘণ্টা সময় লাগবে। আরও জানিয়ে দেওয়া হলো, মাটির অতটা নিচে সারা বছর ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এবং ৯৮ শতাংশ আদ্রতা থাকে। আর সেখানকার ভূগর্ভস্থ পানির তাপমাত্রা থাকে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর কোনো হেরফের হয় না। ফলে নিচে নামার আগেই আমাদের দলের সবাই গরম কাপড় গায়ে চড়িয়ে নিলাম।

২৫ থেকে ৩০ জনের এক এক একটি দল করে ভাগে ভাগে নিচে নামানো হয়। প্রথমেই হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো ফোনের মতো যান্ত্রিক অডিও গাইড। ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ, জার্মান, জাপানি আর আরবি, এই ছয় ভাষার মধ্যে থেকে একটি পছন্দ করে নিতে হয়। কেউ কেউ সিঁড়ি ধরে নিচে নামছে। কেউ কেউ লিফটে করে। ১০৩ মিটার বা ৩৩৮ ফুট নিচে নামতে তিনটি লিফটের পাশাপাশি সিঁড়িও আছে। নিচে নেমে সুড়ঙ্গ পথে খানিকটা হেঁটে গিয়ে নৌকায় উঠেতে হয়।

ছোট ছোট নৌকায় করে ছোট ছোট দলে ৫০০ মিটার নদীপথে সাধারণ পর্যটকেরা যেতে পারেন
ছোট ছোট নৌকায় করে ছোট ছোট দলে ৫০০ মিটার নদীপথে সাধারণ পর্যটকেরা যেতে পারেন
ছবি সূত্র: লেখকের সংগৃহীত

একজন দক্ষ মাঝি পাতাল নদীতে নৌকা ভাসাবার পর চমৎকার ফরাসি আর ইংরেজিতে বর্ণনা করে আমাদের বেশ কিছু তথ্য জানিয়ে দিলেন। বেশ কয়েকটি ছোট ছোট ডিঙির মতো নৌকায় করে ছোট ছোট দলে ৫০০ মিটার নদীপথে সাধারণ পর্যটকেরা যেতে পারেন। এরপর সিঁড়ি ধরে ২০ মিটার (৬৬ ফুট)  ওপরে উঠে একটি বেশ ঘোরা পথে ঘুরে আবার নৌকা ঘাটে ফিরে আসার ব্যবস্থা আছে। ভূগর্ভস্থ নদীটির সর্বোচ্চ গভীরতা ৬ মিটার (২০ ফুট), বেশ কয়েকটি হ্রদ পার হয়ে ২০ কিমি (১২ মাইল) পর্যন্ত চলে গেছে।

এক জায়গায় মাথার ওপরের ছাদ ৯৫ মিটার (৩১২ ফুট) উঁচুতে, বিশাল নিস্তব্ধ, নিশ্চুপ এক একটি মহল। শুধু টুপটাপ পানি পড়ার শব্দ। লাখ লাখ বছর ধরে এই টুপটাপ শব্দ একটানা হয়ে চলছে, একমুহূর্তের জন্যও থামেনি। হালকা বৈদ্যুতিক আলোয়, আলো-আঁধারিতে এক অদ্ভুদ রহস্যময় পরিবেশ। কোটি কোটি বছরের ইতিহাস লেখা আছে, এখানকার কংক্রিটের কঠিন দেয়ালে।

ছোট ছোট নৌকায় করে ছোট ছোট দলে ৫০০ মিটার নদী পথে সাধারণ পর্যটকরা যেতে পারে
ছোট ছোট নৌকায় করে ছোট ছোট দলে ৫০০ মিটার নদী পথে সাধারণ পর্যটকরা যেতে পারে
ছবি সূত্র: লেখকের সংগৃহীত

সেই ১৭ কোটি বছর আগে, যখন পৃথিবীতে ডাইনোসরেরা রাজত্ব করত, সেই জুরাসিককালে অসংখ্য হ্রদ, লেগুন আর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ নিয়ে ফ্রান্সের এ অঞ্চলটি ছিল বিশাল এক উষ্ণ পানির অগভীর সমুদ্র। এরপর সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে সাগর শুকিয়ে যায়। রেখে যায় কোটি কোটি বছরের ঝিনুক, শামুখের খোলসের বিশাল বিস্তৃত পুরো চুনোপাথরের আস্তর, সেডিমেন্ট। কালে কালে চুনোপাথরের এমন পুরো আস্তরের সঙ্গে পাথর-শিলা আর জৈব পদার্থের মিশ্রণে গড়ে ওঠে এক উর্বর ভূমি।

লাখ লাখ বছর ধরে বৃষ্টির পানি মাটি চুইয়ে চুনাপাথরের অংশ ক্ষয় করার কারণে মাটির নিচে বহু ফাঁকফোকরের সৃষ্টি হয়। পানি তার নিজস্ব পথ তৈরি করে নিয়েছে ভূগর্ভস্থ অগভীর নদীপথে। গড়ে উঠেছে বিভিন্ন আকার-আকৃতির অসংখ্য চিত্তাকর্ষক স্ট্যালাকটাইট ও স্ট্যালাগমাইট। অপূর্ব সুন্দর এক পাতালপুরীর দেশ। এক অলৌকিক জাদুর জগৎ। শুধু রূপকথায় এমন জগতের বর্ণনা পাওয়া যাবে। যতই দেখি, ততই মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছি। মনে হচ্ছিল বাস্তব ছেড়ে পরাবাস্তবে এসে পড়েছি। পৃথিবী নামক গ্রহটির নানা স্থানে ছড়িয়ে আছে নানা বিস্ময়।

১৫ থেকে ২০ ইউরো হলে হাসের তেলে ভাজা হাসের রান এবং খানিকটা সবজি আর এক কাপ কফি দিয়ে দুপুরের খাবার হয়ে যাবে
১৫ থেকে ২০ ইউরো হলে হাসের তেলে ভাজা হাসের রান এবং খানিকটা সবজি আর এক কাপ কফি দিয়ে দুপুরের খাবার হয়ে যাবে
ছবি: লেখক

কোটি কোটি বছরের রহস্য উদ্‌ঘাটন করেছেন মাত্র কয়েক দশকের জীবনের মানুষেরা। মানুষের জ্ঞানচক্ষু অনেক কিছু দেখতে পারে। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় সাহসী মানুষেরা, বিজ্ঞানী-গবেষকরা বহু বছর ধরে এক এক করে প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। বলেছেন এমন বিশাল পাতালপুরি আর পাতাল নদী মোটেই অতিপ্রাকৃতিক নয়, একদম প্রাকৃতিক। একজন ভাগ্যবান পর্যটক হিসেবে আমি শুধু বলতে পারি, স্মৃতিতে অম্লান থাকবে চিরদিন এমন শয়তানের গর্তে এক দিন।

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৯: ২৭
বিজ্ঞাপন