রাইন নদীর এলোকেশী ৩
শেয়ার করুন
ফলো করুন

রাইনের ছোট্ট শহর সেন্ট গোয়ার্সহাউজেন। আরেক নাম লোরেলাইস্টাড বা লোরেলাই-নগর। শহরটাকে নিচে রেখে আমরা ওপরে উঠছি গাড়িসমেত। পাহাড়ি সরু পথ যেন জিলাপির প্যাঁচ। পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠতে গিয়ে কালঘাম ছুটে গেল আমাদের চালক মৌরি আপু আর রুমির। এলোকেশী লোরালাইর সন্ধান পাওয়া দেখছি চাট্টিখানি কথা নয়। এখন লোরালাই যদি দেখতে অপরূপা উর্বশী না হয়ে কুঁজো-পিঠ, মুলা-দাঁত, ঝোলা-নাক, বদখত এক ডাইনি হয়, তাহলে এদের হতাশা রাখার আর জায়গা থাকবে না।

জল্পনার জলপরী লোরেলাইর ধাতব কল্পনা
জল্পনার জলপরী লোরেলাইর ধাতব কল্পনা

জায়গাটা যত্ন করে সাজিয়ে ও গুছিয়ে রাখা। পাহাড়ের কোলে লুকানো বিরাট এক বাগান। চারপাশে লাল-সাদা গোলাপের কেয়ারি। ঝোপঝাড়ে বাহারি ছাঁট। এখানে–সেখানে ফোয়ারা। নন্দনকানন একেবারে। অথচ কোথাও কোনো নিশানা দেওয়া নেই যে লোরালাই কোথায় আছে। তবুও নুয়ে পড়া ফুলেরা কীভাবে যেন পথ চিনিয়ে নিয়ে গেল গন্তব্যে।

বিজ্ঞাপন

রাইন এলাকার আঞ্চলিক ভাষায় ‘Lureln’ মানে ‘মর্মর ধ্বনি’ আর প্রাচীন কেল্টিক শব্দ ‘Ley’ বা ‘পাথর’—এই দুই মিলে লোকমুখে ঘুরেফিরে Lorelei বা লোরালাই-তে আদল নিয়েছে। আমরা যে পাথুরে চাঁইয়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছি, তার নামই লোরেলাই। দৈর্ঘ্যে প্রায় দেড় শ মিটার আর চওড়াও তেমনি হবে। নদীর অতল ফুঁড়ে অট্টালিকার মতো অটল দাঁড়িয়ে এই লোরালাই। যে কারণে নদী এখানে আচমকাই সরু। শান্ত রাইন এই সরু পথে বাধা পেয়ে অশান্ত ঢেউ তোলে প্রবল। একটু বেহালে হাল ধরলেই জাহাজ টালমাটাল। বহু নৌকাডুবির অঘটন ঘটেছে এখানে শত শত বছর ধরে।

লোরেলাইয়ের বেশে মৌরি
লোরেলাইয়ের বেশে মৌরি

তবে লোকগাথায় নৌকাডুবির ঘটনা আরেকটু সরেস। ছিল লোরেলাই নামের এক অনিন্দ্যসুন্দরী। পাহাড়ের কিনারায় সে বসে থাকত একপিঠ সোনালি চুল মেলে। তার নীল চোখ, টিকালো নাক, পাতলা ঠোঁটে রূপ আর ধরে না। স্ফটিক ত্বকে যেন গোলাপি মুক্তার আভা। ফিনফিনে সফেদ পোশাকের ওপাশে পেলব অবয়ব বলে দেয়, সে এই পৃথিবীর কোনো মানবী নয়। যেন কল্পলোকের নারী। উদাস লোরেলাই পাথুরে চাঁইয়ে বসে দীঘল চুলে অলস বিনুনি কাটে আর আনমনে গান গায়। সেই সুর ঢেউ তোলে রাইনের ইথারে ইথারে। সুরের ঘোরে জাহাজি যুবকের মন হয় উন্মাতাল, উচাটন। মুখ তুলে পাহাড়পানে চাইতেই লোরেলাইর নীল চোখে চোখ পড়ে তরুণ নাবিকের। আর অমনি হাত থেকে নৌকার হাল খসে পড়ে, পাল যায় হেলে। ওত পেতে থাকা রাইনের চোরা ঘূর্ণিপাক তখন পাগলা খিদেয় গিলে নেয় জাহাজ, মাস্তুল, নাবিক সব। তবে লোরেলাইকে ভিলেন ভাবতে ভালো লাগছে না; বরং দুঃখী এক অভিশপ্ত মৎস্যকুমারী ভাবতে ইচ্ছা করছে। তার রূপে ও সুরে ভুলে কেউ যদি জলে ডোবে, সে দায় তো লোরেলাইর না।

বিজ্ঞাপন

যাহোক, এদিক-ওদিক এলোমেলো কয় পা এগোতেই লোরেলাইর কুখ্যাত সেই শ্লেট-পাথরের চাঁই চোখে পড়ল। একালের হাতে বানানো হাতুড়ি-বাটালিসমেত। পর্যটক টানার কায়দা আর কি। সঙ্গে শিকল দিয়ে জুড়ে দেওয়া আছে ধাতব চিরুনি। তাতে লোরেলাইর নাম খোদাই করা। ছুড়ি-বুড়ি সব বয়সী মেয়ে-মহিলারা চাঁইয়ে বসে চিরুনি হাতে লোরেলাই সেজে সেলফি তুলতে মশগুল। হাদি ভাই আর রুমির চাপাচাপিতে মৌরি আপু আর আমাকেও লোহার চিরুনি উঁচিয়ে দাঁত ভেঙচিয়ে পোজ দিতে হলো। মুঠোফোনের পর্দায় সেই ছবি দেখে ছবিওয়ালার ঠিক সন্তষ্ট মনে হলো না। ভাবখানা যেন, ‘হুম, কোথায় টিকালো নাক, পাতলা ঠোঁট আর কোথায় মূলা-দাঁত আর ঝোলা-নাক’ (ফোঁওওশ দীর্ঘশ্বাস!)।

দুই নবীন ভ্রমনপিপাসু
দুই নবীন ভ্রমনপিপাসু

এই দুই বাঙালি ভাইকে যারপরনাই হতাশ করে মৌরি আপু আর আমি লোরেলাইর পাঁচ কেজি ওজনের বিচ্ছিরি চিরুনিটা ফেলে মূলা-দাঁত আর ঝোলা-নাকসমেত পাথুরে আসন থেকে লাফিয়ে নামলাম। লোরেলাইকে বিউটি স্ট্যান্ডার্ড মানতে নারাজ আমরা। আমাদের এক হাতে খুন্তি, তো আরেক হাতে কলম। চিরুনি কোলে লোরেলাইর মতো কবিতা সেজে বসে থাকার ফুরসত কই। ভাবনার নাটাইয়ের সুতা কেটে কোত্থেকে ছোট্ট নূর আর দুষ্টু তাফসু মিয়া দৌড়ে এসে জাপটে ধরল। শিশুদের খিলখিল হাসি শতেক মুক্তা হয়ে ছড়িয়ে পড়ল নরম সবুজ ঘাসের কার্পেটে।

কিন্তু লোরেলাইর মন্ত্রে দেখছি মুগ্ধ শুধু রুমি আর হাদি ভাই-ই না, এই দলে কড়া ধাঁচের জার্মান কবি হাইনরিখ হাইনেও আছে। তিনি নাকি বিরাট বিরহে পড়ে ‘লোরেলাই’ নামের সুদীর্ঘ এক কবিতা লিখেছিলেন। তাঁরই দুই ছত্র ব্রোঞ্জের পাতে খোদাই করে রাখা আছে এখানে। মনে মনে সাহস করে একটা চটজলদি তর্জমা দাঁড় করালাম। সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ হিসেবে বলে রাখি, হেনরিখ হাইনের অনুবাদ করতে যদি ডিম ভাজার চেয়তেও কম সময় লাগে, তাহলে খুব বেশি আশা না করাই ভালো।

জার্মান কবি হেনরিখ হাইনের বিখ্যাত কবিতা 'দ্য লোরেলাই'-এর পংক্তি
জার্মান কবি হেনরিখ হাইনের বিখ্যাত কবিতা 'দ্য লোরেলাই'-এর পংক্তি

'Ich weiß nicht, was soll es bedeuten,
Daß ich so traurig bin,
Ein Märchen ans alten Zeiten,
Das kommt mir nicht aus dem Sinn. '

‘কে জানে কি তার মানে,
কিসের ভারে মন গেছে নুয়ে,
প্রাচীন রূপকথার অলক ইশারা ছুঁয়ে,
অনন্ত ঘোর এক অস্তিত্বের সবখানে।'’

কাকের ঠ্যাং-বকের ঠ্যাং অনুবাদটা কাউকে শোনানোর সাহস পেলাম না ঠিক। তা ছাড়া কবিতা শোনানোর লোকেরা হঠাৎ ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে। লোরেলাইয়ের প্রমাণ সাইজের এক তাম্রমূর্তির দেখা মিলেছে অদূরে। মুশকিল হলো, ফিনফিনে সফেদ কাপড় তামার বুনোটে বোনা কঠিন কাজ। তাই লোরেলাইয়ের গায়ে একটা সুতাও নেই। তাতে অবশ্য রুমি আর হাদি ভাইয়ের উৎসাহে ভাটা পড়ল না। ঈশান, বায়ু, অগ্নি ও নৈঋত সব অ্যাঙ্গেল থেকেই ফটো খেঁচা চলল বেশুমার।

হয়তো লোরালাইর সুরে মোহগ্রস্ত নাবিকের ফুলেল নিবেদনের প্রতীক
হয়তো লোরালাইর সুরে মোহগ্রস্ত নাবিকের ফুলেল নিবেদনের প্রতীক

লোরেলাইর ভাস্কর্য ছাড়িয়ে দুই পা হাঁটতেই নজরে এল আজব এক দৃশ্য। পথের ধারে কাঠের নৌকা পড়ে আছে। আর তাতে উপচে পড়ছে রংবেরঙের অজস্র ফুল। বোধ হয় লোরেলাইকে পূজার অর্ঘ্য দিয়ে গেছে মরে ভূত হওয়া রাইনের কোনো বোকা নাবিক। এদিকে মাঝদুপুরের কড়া রোদটা বলে দিচ্ছে আমাদেরও পূজার সময় হয়ে এসেছে। তবে এই পূজা, পেটপূজা। অগত্যা কাছের রেস্তোরাঁ বরাবর রওনা দিলাম আমরা সবাই।
খানিক বাদে যেনতেন দুটি চর্ব্যচূষ্য খেয়ে নিয়ে। চর্ব্যচূষ্য বলার কারণ, সেখানে মিলল শুধু রুটি আর সেদ্ধ আলু-টালু, বড়জোর কড়কড়ে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। এই খেয়ে ভেতো বাঙালির পেট ভরে, কিন্তু মন ভরে না। আজকে রাতে খামারবাড়ি ফিরে জম্পেশ একটা দেশি ডিনার না হলে চলছেই না দেখছি। তবে আপাতত, আলু খেয়েই টালুমালু এগোলাম পরের গন্তব্যে।

একবার ঠিক হলো ইঁদুর কেল্লা আর বিড়াল দুর্গ দেখে আসব। খুব নাম শুনছি এখানে আসা অবধি। পরে অবশ্য মত পাল্টে চলে এলাম স্টেরেনবের্গ কেল্লার ইয়া বড় ফটকে। এই কেল্লার খুব কাছেই আরেক দুর্গ লিবেনস্টাইন। দুই দুর্গ ঘুরে দেখে মনে হলো এক কালে জৌলুশের কোনো অভাব ছিল না এদের। অথচ আজ যেন দেয়ালে দেয়ালে বড় অযত্নের ছাপ। জানা গেল, এই দুই মুখোমুখি দুর্গের ইতিহাস অনেকটা ইঁদুর-বিড়াল খেলার মতোই। দুই ভাইয়ের দুই কেল্লা স্টেরেনবের্গ আর লিবেনস্টাইন। বাবার সম্পত্তি ভাগ নিয়ে তাদের লেজে-লেজে শত্রুতা।

ইঁদুর কেল্লা আর বিড়াল দূর্গের মিনিয়েচার মডেল
ইঁদুর কেল্লা আর বিড়াল দূর্গের মিনিয়েচার মডেল

রেষারেষির ফল ভালো হলো না। ১৫৬৮ সালে দুই দুর্গ ছেড়ে লোকজন চলে গেল আর কোথাও। মতের অমিলের সাক্ষী হয়ে কেল্লা দুটি একলা দাঁড়িয়ে রইল শত শত বছর। তারপর এই তো কিছুদিন হলো নোনা ধরা দেয়ালে চুনকাম পড়েছে মাত্র। বেহিসেবি গজিয়ে ওঠা লতা-গুল্ম সরিয়ে কিছু অংশে ক্যাফে, রেস্তোরাঁ ও হোটেলের জায়গা করা হয়েছে। কৌতূহলে আলোঝলমলে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নামতেই দেখা গেল অতিকায় হলরুমে বড় আয়োজন চলছে। বর-কনে স্যুট আর গাউনের জমকালো সাজে স্মিত হাসছে। ক্রিস্টাল সাঁঝবাতির আভিজাত্যে আর ওয়াইন-শ্যাম্পেইনের সুবাসে চারপাশ ম ম করছে। ভাইয়ে-ভাইয়ে কালাকালের প্যাঁচামুখ ঝগড়া হঠিয়ে বিয়ে-শাদির হুল্লোড় ভালোই লাগল দেখে। অনাহূত অতিথি না সেজে বরং পা টিপে বেরিয়ে এলাম ওখান থেকে। (চলবে)

লেখক: ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার জার্মানির মিউনিখে
একটি ক্লিনিক্যাল রিসার্চ সংস্থায় মেডিক্যাল রাইটার হিসেবে কর্মরত
ছবি: আহমেদ রুমি

প্রকাশ: ২৯ জানুয়ারি ২০২৪, ১২: ৫১
বিজ্ঞাপন