ক্যান্ডির অলিগলি থেকে নুয়েরা এলিয়া
শেয়ার করুন
ফলো করুন

ক্যান্ডিকে বলা হয় শ্রীলঙ্কার সাংস্কৃতিক রাজধানী। আবার রাজধানী কলম্বোর পরে দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। ক্যান্ডিতে আমাদের আবাস ছিল মাউন্টেন ভিউ নামের এক হোমস্টেতে। বাংলাদেশি টাকায় মাত্র ৭৫০ টাকায় সব রকমের সুবিধাসম্পন্ন রুম। সেই সঙ্গে বারান্দার দরজা খুললেই দেখা মিলবে পাহাড়ের সারি ও পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে গড়ে ওঠা ঘরবাড়ি। হোমস্টের মালিক আমাদের আপ্যায়ন করলেন শ্রীলঙ্কার বিখ্যাত চা দিয়ে।

ক্যান্ডি হোম স্টে থেকে ভোর
ক্যান্ডি হোম স্টে থেকে ভোর

সেই চা খেয়েই ১০টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লাম আমরা। দিলশানের সঙ্গে আগেই ঠিক করা ছিল, পরদিন সকাল সাড়ে সাতটায় শুরু হবে আমাদের যাত্রা। পরদিন ঠিক সকাল ৭টা ২০ মিনিটে দিলশানের কল, সে পৌঁছে গেছে আমাদের নিতে। আমরাও সবকিছু রেডি করে বের হয়ে গেলাম। যাওয়ার আগপর্যন্ত বাংলোর মালিক আমাদের এতবার ধন্যবাদ দিলেন, তাঁর বাড়িতে থাকার জন্য; মনে হচ্ছিল, আসলেই কোনো আত্মীয়ের বাড়ি ছেড়ে আসছি!

বিজ্ঞাপন

আমাদের আজকের পরিকল্পনা ছিল ক্যান্ডির বিভিন্ন প্রান্তের কিছু জায়গা ঘুরে নুয়েরা এলিয়ার দিকে রওনা হওয়া। প্রথমেই গেলাম ক্যান্ডি লেকভিউ পয়েন্টে, যেখান থেকে বিখ্যাত ক্যান্ডি লেকসহ পুরো শহরটা দেখা যায় একনজর। তবে ভিউ দেখে তো আর পেট ভরবে না! দিলশানকে আগে থেকেই বলা ছিল, যত রকমের লোকাল খাবার এক্সপেরিয়েন্স করা যায়, আমরা করতে চাই।

ক্যান্ডির পথে স্যুভেনির শপ
ক্যান্ডির পথে স্যুভেনির শপ
ক্যান্ডির বিখ্যাত কুইনস হোটেলের সামনে
ক্যান্ডির বিখ্যাত কুইনস হোটেলের সামনে

এক দিন আমাদের সঙ্গে ঘুরে দিলশানও বুঝে গেছে আমাদের চাওয়া। সে আমাদের নিয়ে গেল ক্যান্ডির কৃষি বিভাগের একটা উদ্যোগে। শহরের ঠিক মাঝখানেই একটা ফুড কোর্ট, যেখানে কৃষি বিভাগের তত্ত্বাবধানে শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী খাবার বিক্রি হয়। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে ডাল-কারি, কোথাও স্ট্রিং হপারস (চালের গুঁড়া দিয়ে বানানো এক রকমের নুডুলস, যেটা আবার খাওয়া হয় বিভিন্ন সবজি দিয়ে)। চালের রুটির মতো আপ্পাম, কাঁচা কাঁঠালের চপ আর মাশরুম সমুচা দিয়ে নাশতা সারলাম আমরা। সব শেষে একদম ফ্রেশ প্যাশন ফ্রুট জুস।

বিজ্ঞাপন

জম্পেশ নাশতা শেষে ক্যান্ডি লেকের আশপাশ ঘুরে দেখলাম হেঁটে হেঁটেই। লেকের বিভিন্ন দিক ঘেঁষে বসে আছেন বিভিন্ন হকার। অনেকে আবার সকালের মিষ্টি রোদ পোহাচ্ছেন আয়েশ করে। যাঁর সঙ্গেই চোখাচোখি, সে–ই হাসিমুখে স্বাগত জানাচ্ছেন দেশে আসা অতিথিকে। বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে আমাদের প্রথম গন্তব্য ক্যান্ডির বিখ্যাত ভৈরবাকান্দা বৌদ্ধমন্দিরে। প্রায় ৮০ ফুট উঁচু বুদ্ধের মূর্তি ধরে উপরে উঠলেই ক্যান্ডি স্টেডিয়ামসহ শহরটার নানা অংশ দেখা যায় খুব সুন্দরভাবে। তবে রোদের কারণে সেখানে বেশিক্ষণ থাকা গেল না।

নাল্লিগেলা মন্দির
নাল্লিগেলা মন্দির
নাল্লিগেলা মন্দিরের স্তুপ
নাল্লিগেলা মন্দিরের স্তুপ

পরবর্তী গন্তব্য নেল্লিগালা মন্দির। মন্দিরটা খুব বেশি দিনের নয়। কিন্তু বুদ্ধের চুল সংরক্ষিত থাকায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সেই সঙ্গে মন্দির থেকেই দেখা যায় বিখ্যাত অ্যাডামস পিক।

মন্দির দর্শন শেষে আমরা বেরিয়ে পড়লাম নুয়েরা এলিয়ার পথে। যাওয়ার আগে দিলশান আমাদের নিয়ে গেল তার প্রিয় রেস্তোরাঁ ডুরিয়ানজিলাতে। উদ্ভট গন্ধের এই ফলের স্বাদ নিয়ে অনেকের মতপার্থক্য থাকলেও দিলশান সাফ কণ্ঠে জানাল, ডুরিয়ান তার সবচেয়ে প্রিয় ফল। আর ডুরিয়ানজিলা হলো সেই ফল দিয়ে বানানো নানা আইটেমের রেস্তোরাঁ। পিৎজা থেকে শুরু করে দই—কী নেই সেখানে! যদিও আমরা খুব বেশি এক্সপেরিমেন্ট করার সাহস পাইনি। ডুরিয়ান আইসক্রিম নিয়েছিলাম। টেস্ট ভালোই লেগেছিল। এরপর লঙ্কান সিল্কের শোরুম ঘুরে কিনলাম লঙ্কান সিল্কের তিনখানা শাল। পুরো দোকান ঘুরে বুঝলাম, আমাদের দেশের মতো সমৃদ্ধ নয় তাদের পোশাকশিল্প। দামটাও একটু বেশি মনে হলো।

ডুরিয়ান আইসক্রিম
ডুরিয়ান আইসক্রিম
ন্যুরে এলিয়া যাবার পথে
ন্যুরে এলিয়া যাবার পথে

দিলশানের মতে, তার কাছে শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে সুন্দর রাস্তা ক্যান্ডি থেকে নুয়েরা এলিয়ায় যাওয়ার পথ। মধ্যে আবার পড়বে শ্রীলঙ্কার অন্যতম সুন্দর ঝরনা রামবোডা ফলস। ক্যান্ডি পার হয়ে মিনিট ত্রিশেক যেতেই রাস্তার দুই ধারে দেখা মিলল বিশাল সব চা–বাগানের। আমাদের দেশে টিলায় চা–বাগান দেখার অভিজ্ঞতা আছে অনেক, কিন্তু এত উঁচু সব পাহাড়ে চা–বাগানের এমন সমারোহ চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো। আর রাস্তায় কিছুক্ষণ পরপর সারপ্রাইজের মতো ছিল জানা-অজানা সব ঝরনা। কোনো ঝরনা একদম গাড়ি থেকে কয়েক কদম নামলেই দেখা যায়। কিছু আবার বহু দূরে, কিন্তু দেখে চোখের শান্তি হয় শতভাগ!

দুপুরের খাবার খেতে নামলাম এক রেস্তোরাঁয়। শ্রীলঙ্কার একটা বিষয় খুব ভালো লাগল এত দিনে। সেটা হলো রাস্তার পাশের দোকান থেকে শুরু করে যেকোনো জায়গায় গেলেই ভাষা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না কোথাও। সবাই কমবেশি ইংরেজি বোঝেন আর বলতে পারেন। হোটেলের কর্মীই সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন কোনটা কী খাবার। এরপর আবার বেশ আপ্যায়ন করে সাজিয়ে পরিবেশনও করলেন। দারুণ মজার সেই রাইস অ্যান্ড কারি আমাদের ট্রিপে খাওয়া অন্যতম মজার পদ।

রামবোডা ঝরণা
রামবোডা ঝরণা
সামান দেবতার মুর্তির সামনে। এই মুর্তির একদম সামনাসামনি দাঁড়ানো মানা।
সামান দেবতার মুর্তির সামনে। এই মুর্তির একদম সামনাসামনি দাঁড়ানো মানা।

খাওয়াদাওয়া শেষে আবার যাত্রা শুরু। পথে যেতে যেতে ঝরনা দেখার জন্য থামলাম বেশ কয়েক জায়গায়। এরপর এক জায়গায় থেমে দিলশান আমাদের পথ দেখিয়ে দিল। সেই রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে হবে বিখ্যাত রামবোডা ফলসে। ১০০ রুপি দিয়ে টিকেট কেটে যাত্রা শুরু করলাম। প্রায় ৩০ মিনিট সিঁড়ি ধরে উপরে উঠছি, আর পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ঝরনার গান। তবে সিঁড়ি শেষ না হওয়া পর্যন্ত রাস্তারও শেষ নেই। এভাবেই আধা ঘণ্টা পর আমরা পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে।

বিশাল এক ঝরনা, সেখান থেকে প্রবাহিত পানি কোথায় শেষ হয়েছে, তার হদিস নেই। এর মধ্যে ঝরনার ওপর বসেই পেলাম রংধনু, মেঘ আর রোদের লুকোচুরি খেলা। এবার ফেরার পালা। বিকেল পাঁচটার আগেই পৌঁছাতে হবে ডামরু টি এস্টেটের কারখানায়। না হয় চা বানানোর প্রক্রিয়া দেখা হবে না। সেই ভাবনা ভাবতে ভাবতেই দ্রুত পা চালিয়ে দিলশানের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম গাড়ির কাছে।

সুবিশাল ডামরু টি এস্টেট
সুবিশাল ডামরু টি এস্টেট
চায়ের রকমফের
চায়ের রকমফের

বিকেল সারে চারটা নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম ডামরু টি এস্টেটে। শ্রীলঙ্কার অন্যতম পুরোনো এই টি এস্টেটে সারা দিনই পর্যটক আসতে থাকেন। টি এস্টেটের একজন কর্মী আমাদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন দুটি পাতা-একটি কুঁড়ি থেকে কীভাবে বিভিন্ন রকম চা তৈরি হয়। একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছু বর্ণনা করলেন। এরপর আবার এক কাপ ফ্রেশ ব্ল্যাক টি–ও অফার করলেন। আমরা সঙ্গে নিলাম টি কেক। গরম গরম চা আর কেক খেয়ে বিদায় নিলাম ডামরু টি এস্টেট থেকে।

পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে গাড়ি চলছে, চারিদিকে চা–বাগান আর বিশাল জঙ্গল! এত সুন্দর রাস্তা দেখে প্রতিটা বাঁকেই মনে হচ্ছিল, নেমে ছবি তুলি! এই বাঁকে বাঁকে ঘুরতে ঘুরতেই পৌঁছে গেলাম হিমশীতল শহর নুয়েরা এলিয়াতে। যদিও আমাদের ঠিক করা এবারের বাংলোটা ছিল মূল নুয়েরা এলিয়া থেকে কিছুটা আগে, একদম চা–বাগানের মধ্যখানে। শর্মিলী আন্টি, বাংলোর মালিক হাসিমুখেই অভ্যর্থনা জানালেন আমাদের বৃষ্টিভেজা সেই সন্ধ্যায়। নুয়েরা এলিয়ায় এসেই আমরা আকস্মিক ঠান্ডায় অবাক হয়েছিলাম। ঠান্ডার প্রস্তুতি ছিল ঠিকই, কিন্তু এমন ঠান্ডা থাকবে, সেটা বুঝতে পারিনি আগে।

ডামরু টি এস্টেটের চা-কেক
ডামরু টি এস্টেটের চা-কেক

যাহোক, দিলশানকে সেদিনের মতো বিদায় দিয়ে আমরা শর্মিলী আন্টির সঙ্গে গল্প করতে লাগলাম তাঁর বানানো অ্যাভোকাডো জুস খেতে খেতে। সেই আড্ডা সন্ধ্যা থেকে গড়ালো রাতের খাবার পর্যন্ত। শর্মিলী আন্টির বাড়িতেও আমরাই প্রথম বাংলাদেশি অতিথি। একটা সময় সাইপ্রাসে কাজ করতেন তিনি, সেখানে অনেক বাংলাদেশি বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় ছিল তাঁর। সেই গল্প শুনতে শুনতেই কখন অনেকখানি সময় পার হয়ে গেল, আর আরেকটা দিনের সমাপ্তি হলো, টেরই পেলাম না। কনকনে ঠান্ডায় কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাতে গেলাম সেদিনের মতো।

ছবি: শিখা ও সাফাত

প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০২২, ০৮: ৩৪
বিজ্ঞাপন