তুমি তো দিয়েছিলে মোরে কৃষ্ণচূড়া ফুল
শেয়ার করুন
ফলো করুন

ইট-কাঠের এই নগরীতে থোকায় থোকায় ফুটেছে অজস্র কৃষ্ণচূড়া ফুল। কংক্রিট-জঙ্গলের ল্যান্ডমার্ক পেরিয়ে দৃষ্টিসীমার একটু ওপরে কৃষ্ণচূড়ার ছলকে ওঠা কমলা-লালের খেয়ালি বিমূর্ত চিত্র থেকে সত্যি চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। রোদের ঝলকে তার এক রূপ তো ঝমঝমিয়ে একপশলা বৃষ্টি শেষে তার আরেক সৌন্দর্য। আবার রাত নামলে সড়কবাতির আলো–আঁধারিতে কৃষ্ণচূড়া তার অদ্ভুত সুন্দর রূপ মেলে ধরে।  

বিজ্ঞাপন
ডাক দিয়ে যায় পথের ধারে কৃষ্ণচূড়ায় —রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ঢাকায় সবচেয়ে বেশি কৃষ্ণচূড়াগাছ দেখা যায় সংসদ ভবন এলাকায়। এর মধ্যে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে সারবাঁধা বিশাল কৃষ্ণচূড়াগাছগুলো নজর কাড়ছে সবার। জাতীয় সংসদ ভবনসংলগ্ন আগারগাঁওয়ের দিকে চলে যাওয়া সড়কটিতেও ফুটেছে কৃষ্ণচূড়া। রাজধানীর রমনা এলাকা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, বিজয়নগর, নাটক সরণি, হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ, মিন্টো রোড, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, গুলশান, হাতিরঝিল, বনানী, বারিধারা, উত্তরাসহ শহরের বিভিন্ন স্থানে এখন কৃষ্ণচূড়ার লাল আগুন চোখ ধাঁধিয়ে যায়।

প্রাচীন কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোর বেশির ভাগই কেটে ফেলা হয়েছে
প্রাচীন কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোর বেশির ভাগই কেটে ফেলা হয়েছে
ছবি: ডা. আতিকুল হক, সহকারী রেজিস্ট্রার, চক্ষু বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ

আর আলাদা করে বলতেই হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার কৃষ্ণচূড়ার কথা। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ, ইডেন কলেজ ও গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজসংলগ্ন প্রাচীন কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোর বেশির ভাগই কেটে ফেলা হয়েছে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সুবাদে।

বিজ্ঞাপন
কৃষ্ণচূড়ার রাঙা মঞ্জুরি কর্ণে/ আমি ভুবন ভোলাতে আসি গন্ধে ও বর্ণে—কাজী নজরুল ইসলাম

কৃষ্ণচূড়ার লাল যেন আগুনের শিখা। কোনো রকম দ্বিধা বা চাপা কিছু নেই সেই লালের লেলিহান শিখায়। রাঙা বোধ হয় এই রংকেই বলে। আর সঙ্গে কেমন এলোমেলো লাল-সাদার পোঁচ, হিজিবিজি আঁকিবুঁকি—কৃষ্ণচূড়ার রূপ বলে বোঝানো দায়। সেইভাবে সুগন্ধি ফুল একে হয়তো বলা যায় না। কিন্তু বৃষ্টির পরে এলোপাতাড়ি ডাল ভেঙে পড়া অথবা পিচঢালা পথজুড়ে ঝরে পড়া রাশি রাশি ফুল মিলে অদ্ভুত এক মাদকতাময় ঘ্রাণ তৈরি হয়।

মডেল: নিশাত; ছবি: সাইফুল ইসলাম

থোকা ধরা সেই লালে আছে এক সম্মোহনী শক্তি। তাকিয়ে থেকে যেন আশ মেটে না। ঝকঝকে রোদেলা নীল আকাশের ক্যানভাসে সেই লালের ছোপ চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। আবার ঘন কালো মেঘ ঘনালে, সঙ্গে ক্বচিৎ বিজলি চমকালে তার সঙ্গে এই কৃষ্ণচূড়ার যে আশ্লেষী লাল প্রেম চলে, হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে দেবে তা নিঃসন্দেহে।

‘কৃষ্ণচূড়ার ছায়ে ছায়ে/ নির্জন পূর্ণিমা রাতে/ থাকবো একলা/ এসো গো সঙ্গোপনে।’—বুলবুল আনাম

আশির দশকের শেষের দিকে জনপ্রিয় গায়ক শুভ্রদেবের কণ্ঠে এই গান ভীষণ প্রিয় ছিল সবার। পূর্ণিমা রাতের চাঁদের কিরণ হোক বা সড়কবাতির আলো, রাতের কৃষ্ণচূড়ার রূপ যেন আলো-আঁধারিতে প্রেমিকার লাল আঁচলের মতোই। আর পড়ে থাকা ফুলটি হাতে নিয়ে খোঁপা বা এলো চুলের এক পাশে গুঁজে দিতে গিয়ে হাতে পাপড়ির পেলব স্পর্শে কারও ঠোঁটের কথা মনে পড়ে গেলে তাকে দোষ দেওয়ার উপায় নেই একেবারেই। ভালোবাসার রং বুঝি এমন আগুন লালই হয়।

‘আবার ফুটেছে দ্যাখো কৃষ্ণচূড়া থরে থরে শহরের পথে/ কেমন নিবিড় হয়ে। কখনো মিছিলে, কখনো-বা/ একা হেঁটে যেতে যেতে মনে হয়—ফুল নয়, ওরা/ শহীদের ঝলকিত রক্তের বুদ্বুদ, স্মৃতিগন্ধে ভরপুর।/ একুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদের চেতনারই রং...।’—শামসুর রাহমান
মডেল: আসিফ; ছবি: সাইফুল ইসলাম

লাল তো রক্তের রং। একুশের কৃষ্ণচূড়ার বহ্নিশিখা মানেই আমাদের হার না মানা চেতনার রং। অমর একুশের অনুভবে রচিত শামসুর রাহমানের এই কবিতা অনেকেরই স্মৃতিতে ভেসে ওঠে। কেননা শহরজুড়ে আবার ফুটেছে কৃষ্ণচূড়া। ফেব্রুয়ারি নয়, যত দিন কৃষ্ণচূড়া ফোটে, তা আমাদের শহীদদের রক্তের কথা মনে করিয়ে দেয়, তাঁদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করায় শ্রদ্ধাভরে। রাজপথ রাঙানো কৃষ্ণচূড়া আমাদের উদ্দীপ্ত করে, প্রতিবাদী করে তোলে।

‘তুমি তো দিয়েছিলে মোরে কৃষ্ণচূড়া ফুল/ আমি তো বসেছিলাম নিয়ে শুধু গানের সুর, তুমি তো দিয়েছিলে মোরে কৃষ্ণচূড়া ফুল/ চলে গেছ কোথায় আমায় ফেলে…বহুদূর।’–অর্থহীন
মডেল: নিশাত, আসিফ; ছবি: সাইফুল ইসলাম

অর্থহীন ব্যান্ডের ‘এপিটাফ’ গানের এই কৃষ্ণচূড়া ফুলটির কথা ভেবে চোখ ভেজেনি এমন কেউ এই প্রজন্মে খুঁজে পাওয়া ভার। সাদাকালো জীবনে শুধু এই টকটকে লাল কৃষ্ণচূড়া আঁকড়ে ভালোবাসার মানুষটিকে বিদায় দেওয়ার উপাখ্যানটি মিলে যায় অনেকের জীবনের সঙ্গেই। প্রেম যখন রক্তাক্ত করে, তখন ক্ষতবিক্ষত হৃদয়টিকে দেখতে কি কৃষ্ণচূড়া ফুলের মতো লাগে?

প্রকাশ: ২৩ মে ২০২২, ০৮: ০৬
বিজ্ঞাপন