জহির রায়হান: যাঁর অনুপ্রেরণায় আমরা আসছে ফাল্গুনের আগেই হলাম শতগুণ
শেয়ার করুন
ফলো করুন

নাম ডেকে ডেকে তখন একজন একজন করে ছেলেমেয়েকে ঢোকানো হচ্ছিল জেলখানার ভেতরে। নাম ডাকতে ডাকতে হাঁফিয়ে উঠেছিলেন ডেপুটি জেলার। একসময় বিরক্তির স্বরে বললেন, ‘উহ্, এত ছেলেকে জায়গা দেব কোথায়! জেলখানা তো এমনিতেই ভর্তি হয়ে আছে। তখন কবি রসুল চিৎকার করে উঠল—জেলখানা আরও বাড়ান সাহেব। এত ছোট জেলখানায় হবে না। আরেকজন বলল, এতেই ঘাবড়ে গেলেন নাকি? আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হব।’ না, এই দৃশ্য ’২৪ নয়, ’৫২-এর দিনলিপি; ‘আরেক ফাল্গুন’ উপন্যাসে জহির রায়হানের বয়ানে। এখানকার সেই আর একজনই কালজয়ী লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হান। আর এখন সেই আর একজন পরিণত হয়েছে লাখো প্রতিবাদী ছাত্র–জনতায়।

এবারের গণআন্দোলনে প্রেরণা হয়েছে জহির রায়হানের উপন্যাস আরেক ফাল্গুন
এবারের গণআন্দোলনে প্রেরণা হয়েছে জহির রায়হানের উপন্যাস আরেক ফাল্গুন

বাহাত্তরের ৩০ জানুয়ারি ওই একটি কলের জবাব না দিলে হয়তো জহির রায়হান দেখতে পেতেন, ’২৪–এর তরুণেরা কেমন করে ফাল্গুনের অপেক্ষা না করে ভরা বর্ষায়ই শতগুণ হয়েছেন। তাঁরই সৃষ্ট কথামালার জোরে উজ্জীবিত হয়ে কেমন করে জয়ী হলো এ প্রজন্ম। ’৬৯–এ প্রকাশিত আরেক ফাল্গুন এখনো কেমন অনুপ্রাণিত করে নতুন প্রজন্মকে, তা দেখে সত্যিই অবাক হতে হয়। অথচ সবাই ভাবত, এই মুঠোফোন টেপা প্রজন্ম জহির রায়হানকে হয়তো চেনেই না।

বিজ্ঞাপন

আর এবারের বিপ্লব ও আন্দোলনে অবিচ্ছেদ্য হয়ে মিশে গিয়ে যে সত্যটা উঠে এল, তা হলো জহির রায়হান নামটি বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাসে সব সময় রয়ে যাবে। সেই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে যাত্রা শুরু করে ষাটের দশকে হয়ে ওঠেন তিনি পরিপূর্ণ বৃক্ষ। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনেও ছিলেন সক্রিয়। ’২৪-এর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে এক দফা আন্দোলনে তাঁর শরীরী উপস্থিতি নেই; কিন্তু জহির রায়হান আছেন; প্রবলভাবেই আছেন। চুয়ান্ন বছর পরেও আলো হাতে যেন পথ দেখিয়েছেন এই আন্দোলনে।

এবারের আন্দোলনে মিশে গিয়েছে জহির রায়হান নাম
এবারের আন্দোলনে মিশে গিয়েছে জহির রায়হান নাম

১৫ জুলাই ছাত্রদের ওপর হামলা, ১৬ তারিখ থেকে লাগাতার গুলি আর গ্রেপ্তার। এই দৃশ্যই তো ছিল ৪ আগস্ট পর্যন্ত। যখনই সুযোগ পেয়েছে, ছেলেমেয়েরা লুকিয়ে অন্যান্য গ্রাফিতির সঙ্গে লিখেছে আর চিৎকার করে বলেছে, আসছে ফাগুন, আমরা হব দ্বিগুণ।  গ্রাফিতির রঙে, রাজপথের মিছিলে এবারের ছাত্র আন্দোলনে বহুল ব্যবহৃত স্লোগান এটি। যার সারমর্ম হলো—যতই গ্রেপ্তার করো, গুলি করো, কোনো লাভ নেই। মুক্তির প্রশ্নে তরুণদের দমিয়ে রাখা যাবে না। একজন গ্রেপ্তার হলে আরেকজন দাঁড়িয়ে যাবে। ঠিক যেমন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল আরেক ফাল্গুন উপন্যাসের ছাত্র–জনতা। আবার এবারে যেমন দাঁড়িয়েছে ’২৪–এর ছাত্ররা। একজনকে গুলি করলে, একজনই মরেছে। অন্যরা সরেনি; বরং বেড়েছে।  মুক্তিকামী, প্রতিবাদী ছাত্র–জনতার কাছে তাই জহির রায়হান এখনো এতটা প্রাসঙ্গিক।

বিজ্ঞাপন

শুধু আরেক ফাল্গুন নয়, তাঁর প্রতিটি কাজেই ছাপ মিলত তখনকার সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার। তাঁর ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রটিতে ব্যবহৃত গান আমার সোনার বাংলা আমাদের জাতীয় সংগীত।  এই চলচ্চিত্রে স্বৈরাচারী স্ত্রী ও নির্যাতিত স্বামী আর সংসারের সবার মাঝ দিয়ে প্রতীকীভাবে রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিজমকে তুলে ধরেছিলেন এই তুখোড় চলচ্চিত্র নির্মাতা। এই ছবির একটি স্লোগান আছে—‘একটি দেশ, একটি সংসার, একটি চাবির গোছা, একটি আন্দোলন।’ এমনই একটি আন্দোলন বায়ান্নতে আমাদের জয়ী করে। এ রকম একটি আন্দোলনের মাধ্যমেই সংসারের চাবি একজনের হাতে কুক্ষিগত হওয়া থেকে উদ্ধার করা যায়, তা তুলে ধরে উনসত্তরে মানুষকে উজ্জীবিত করেছেন তিনি। আর এই উদ্দীপনা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের ক্যানভাসেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। তাঁর সৃজনশীল কাজ এভাবেই যুগান্তরে মানুষকে প্রতিবাদ করতে উদ্বুদ্ধ করে।

জহির রায়হানকে মনে রেখেছে জেন–জিরাও
জহির রায়হানকে মনে রেখেছে জেন–জিরাও

এই আন্দোলনে জহির রায়হানের প্রাসঙ্গিকতার বিষয়ে ১৯৪৯ সালে ‘চতুষ্কোণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত এই  কবিতার কথা বলা যায়।
ওদের জানিয়ে দাও
ওরা আমাদের ভাইবোনকে কুকুর বিড়ালের মতো মেরেছে
ওদের স্টিম রোলারের নিচে
ওদের জানিয়ে দাও
ওরা যদি দেখেও না দেখে
বুঝেও না বোঝে
আগুনের গরম শলাকা দুচোখে দিয়ে ওদের জানিয়ে দাও।
মরা মানুষগুলোতে কেমন জীবন এসেছে।
চব্বিশও এর ব্যতিক্রম নয়।  ছাত্র–জনতা ওদের জানিয়ে দিয়েছে, ফাগুনের আগেই দ্বিগুণ হয়েছে। একটি আন্দোলন থেকে একটি দেশের চাবিকে নিজেদের করে নিয়েছে।

আজ ১৯আগস্ট। আমাদের দ্বিগুণ থেকে শতগুণ হওয়ায় উজ্জীবিত করেছেন যেই লেখক, আজ তাঁর জন্মদিন। ১৯৩৫ সালের এই দিনে ফেনী জেলার মজিপুর গ্রামে জন্মেছিলেন দেশের মেধাবী এই চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক। স্মৃতিকে স্মরণে রেখে বুকের মধ্যে দেশকে অনুভব করা ও ক্ষণে ক্ষণে কথায়-কর্মে তার প্রকাশ ঘটাতে পারা মানুষের সংখ্যা খুব কম; হাতে গোনা। তাঁদেরই একজন জহির রায়হান। উপমহাদেশের প্রথম রঙিন সিনেমা ‘সংগম’ এসেছিল তাঁরই হাত ধরে ১৯৬৪ সালে। একের পর এক দুর্দান্ত সাহিত্য ও সিনেমা উপহার দিয়ে গেছেন সৃষ্টির প্রেরণায় অস্থির এ মানুষটি। মুক্তিযুদ্ধের সময় তৈরি করেছেন ‘স্টপ জেনোসাইড’ ও ‘আ স্টেট ইজ বর্ন’–এর মতো প্রামাণ্যচিত্র।  

জহির রায়হানে উজ্জীবীত হয়েছে হালের তরুণরা
জহির রায়হানে উজ্জীবীত হয়েছে হালের তরুণরা

জহির রায়হানের অর্জনের ঝুলি আরও বড় হতো, যদি স্বাধীন দেশে গুম না হতেন এ ক্ষণজন্মা মানুষটি। আয়নাঘরের মতো কোনো বন্দিশালা থেকে বের হয়ে এসে যদি দেখতেন, জহির রায়হান তাঁর শেখানো মন্ত্রে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কেমন শতগুণ হয়েছে মানুষ!

ছবি: হাল ফ্যাশন, প্রথম আলো, উইকিপিডিয়া, আইএমডিবি, সামাজিক মাধ্যম

প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০২৪, ১৪: ০০
বিজ্ঞাপন