বিশ্বের অন্যতম মূল্যবান এবং রহস্যময় হীরকখণ্ড গোলকোন্ডা ব্লু প্রথমবারের মতো নিলামে উঠছে। ২৩.২৪ ক্যারেট ওজনের এই অপূর্ব নীল হীরাটি আগামী ১৪ মে জেনেভায় ক্রিস্টির ম্যাগনিফিকেন্ট জুয়েলসে বিরল এই হীরাটি নিলামে উঠার কথা রয়েছে। ২৫৯ বছরের প্রাচীন ইতিহাস থেকে জানা যায়, হীরাটি এক সময় ইন্দোর এবং বরোদার মহারাজাদের মালিকানাধীন ছিল।
রাজকীয় ইতিহাস আর দুর্লভ সৌন্দর্যের সাক্ষী এক টুকরো হীরা এই গোলকোন্ডা ব্লু। শতাব্দী পেরিয়ে নানা রাজপরিবার ও বিশ্বখ্যাত জহুরির হাত ধরে এসেছে এটি। এর প্রতি সকলের মুগ্ধতা আজও এতটুকু কমেনি। ভারতের গোলকোন্ডা খনি থেকে পাওয়া এই অনন্য নীল হীরাটি একসময় শোভা পেত ইন্দোরের মহারাজা যশবন্ত রাও হোলকারের ব্যক্তিগত সংগ্রহে। অতুলনীয় স্বচ্ছতা, বিরল রঙ ও ঐতিহাসিক গুরুত্বের জন্য গোলকোন্ডা ব্লু শুধু একটি মূল্যবান রত্নই নয়, বরং এটি এক জীবন্ত ইতিহাস।
প্রায় একশ বছর পর, এবার প্রথমবারের মতো এই কিংবদন্তিতুল্য হীরা জনসমক্ষে নিলামে উঠছে । ধারণা করা হচ্ছে, ২৩.২৪ ক্যারেটের মনোমুগ্ধকর নীল হীরাটির দাম ৩৫ মিলিয়ন থেকে ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধ্যে উঠতে পারে। চলুন জেনে নেওয়া যাক এই বিরল গোলকোন্ডা ব্লু হীরা সম্পর্কে।
কোথা থেকে এল এই গোলকোন্ডা ব্লু হীরা
গোলকোন্ডা নামটি এসেছে ভারতের বর্তমান তেলেঙ্গানা রাজ্যের গোলকোন্ডা এলাকা থেকে। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, এই অঞ্চল থেকেই কোহিনূর, হোপ ডায়মন্ড, দরিয়া-ই-নূরের মতো কিংবদন্তি হীরাগুলোর আবিষ্কার হয়েছিল। হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে থেকে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ভারত থেকে ইউরোপে এই হীরা নিয়ে যান। পরবর্তীতে মার্কো পোলো তাঁর ভ্রমণকাহিনীতে ভারতীয় হীরার অপরূপ সৌন্দর্যের কথা উল্লেখ করেন।
মূলত গোলকোন্ডার খনিগুলি বিখ্যাত ছিল এক ধরনের বিশেষ গুণমানের হীরার জন্য, যা ছিল অসম্ভব স্বচ্ছ, বিশুদ্ধ এবং চোখ ধাঁধানো একটি ব্যাপার। এই হীরাগুলির মধ্যে আজকের এই 'গোলকোন্ডা ব্লু' এক মহামূল্যবান নিদর্শন হয়ে আছে।
রাজকীয় হাত বদলের গল্প
গোলকোন্ডা ব্লু হীরার প্রথম উল্লেখযোগ্য মালিক ছিলেন ইন্দোরের মহারাজা যশবন্ত রাও হোলকর (দ্বিতীয়)। ১৯২৩ সালে তাঁর বাবা বিখ্যাত ফরাসি জহুরি শোমেত-এর কাছ থেকে এই হীরা সংগ্রহ করেন। প্রথমে এটি একটি দৃষ্টিনন্দন ব্রেসলেটের অংশ ছিল। পরবর্তীতে, ১৯৩৩ সালে মহারাজা ইন্দোর রাজপরিবারের গহনাগুলি নতুনভাবে সাজানোর দায়িত্ব দেন আরেক খ্যাতনামা ফরাসি জহুরি মাউবোস্যাঁকে। তখন গোলকোন্ডা ব্লু হীরাকে ইন্দোর পিয়ার হীরার সাথে যুক্ত করে তৈরি করা হয় এক দীর্ঘ রাজকীয় নেকলেস। ফরাসি চিত্রশিল্পী বার্নার্দ বোতে দ্য মনভেল এক বিখ্যাত পোর্ট্রেটে এই গহনায় সজ্জিত মহারানীকে অঙ্কন করেন, যা আজও রাজকীয় সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে গণ্য হয়।
ভারত ছাড়িয়ে গোলকোন্ডার বিশ্ব ভ্রমণ
১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পর দেশীয় রাজ্যগুলির রাজশক্তি ক্ষীণ হতে শুরু করে। সেই সময়ে গোলকোন্ডা ব্লু হীরা পাড়ি দেয় যুক্তরাষ্ট্রে। কিংবদন্তি জহুরি হ্যারি উইনস্টন হীরাটি সংগ্রহ করে এক নতুন রূপ দেন। তিনি এটিকে একটি ব্রোচের আকারে পুনর্গঠিত করেন, যেখানে ছিল আরেকটি ২৩ ক্যারেটের সাদা হীরা। পরে, বরোদার মহারাজা এটিকে সংগ্রহ করেন। কিছুদিন পর হ্যারি উইনস্টনের মাধ্যমেই হীরাটি আবার বিক্রি হয় এবং অবশেষে এটি বর্তমান মালিকের হাতে পৌঁছায়। এখন, শতাব্দী পেরিয়ে এই ঐতিহাসিক হীরাটি আবারও বিশ্বের সামনে আসছে এক নতুন আধুনিক রিংয়ের রূপে।
কেন অনন্য এই গোলকোন্ডা ব্লু
বিশ্বের নানা প্রান্তে অসংখ্য হীরা পাওয়া যায়। কিন্তু গোলকোন্ডার হীরাটি কেন অনন্য? মূলত এর স্বচ্ছতা, বিশুদ্ধতা এবং উজ্জ্বল নীল রং একে বিশ্বের অন্য যেকোনো হীরার চেয়ে আলাদা করে তোলে। বিশেষ করে নীল রঙের ফ্যান্সি ভিভিড গ্রেডের হীরা অত্যন্ত বিরল। আর গোলকোন্ডা ব্লু হল তার সবচেয়ে সুন্দর উদাহরণ।
অন্যদিকে, ক্রিস্টির আন্তর্জাতিক গহনা বিভাগের প্রধান রাহুল কাদাকিয়া বলেন, রাজকীয় উত্তরাধিকার, অতুলনীয় রঙ এবং বিশাল ওজনের কারণে, গোলকোন্ডা ব্লু বিশ্বের সবচেয়ে দুর্লভ নীল হীরাগুলোর মধ্যে একটি।
বিশ্বের অন্য বিখ্যাত সব নীল হীরার পাশে গোলকোন্ডা ব্লু
বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত নীল হীরা হচ্ছে হোপ ডায়মন্ড, যার ওজন ৪৫.৫২ ক্যারেট। এটি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথসোনিয়ান জাদুঘরে প্রদর্শিত আছে। ২০১৬ সালে ওপেনহাইমার ব্লু নামে একটি ১৪.৬২ ক্যারেটের হীরা ৫৭.৫ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়ে রেকর্ড গড়েছিল। অন্যদিকে,২০২২ সালে ১৫.১০ ক্যারেটের ডি বিয়ার্সনদিকে হিরাটি হংকংয়ের সোথেবিজ নিলামে উঠে ৫৭.৪ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়। ধারণা করা হচ্ছে,এবারের গোলকোন্ডা ব্লু বিক্রির মাধ্যমে নতুন এক ইতিহাস রচিত হবে।
রাজকীয় রত্নের এই অনন্য নিদর্শন গোলকোন্ডা ব্লু' এক বিস্ময়কর ইতিহাসের বাহক। শত বছরেরও বেশি সময় ধরে যেভাবে এটি ভারতীয় রাজপরিবারের গয়নার বাক্স থেকে আন্তর্জাতিক জহুরিদের প্রদর্শনীগৃহে পৌঁছেছে, তা যেন এক জীবন্ত কিংবদন্তি। এবার জেনেভার নিলামে নতুন এক ইতিহাসের জন্ম হতে চলেছে। কার হাতে উঠবে এই দুর্লভ নীল সৌন্দর্য, কে হবে এই রাজকীয় ঐতিহ্যের নতুন অধিকারী?সেই অপেক্ষায় আছেন আজ বিশ্বের হীরাপ্রেমী, ঐতিহাসিক এবং সংগ্রাহকরা। ইতিহাসের পাতায় আরও এক নতুন অধ্যায় যোগ করতে চলেছে গোলকোন্ডা ব্লু, যেখানে সময়ের সাথে সাথে এর মুগ্ধতা কেবল বেড়েই চলবে।
তথ্যসূত্র: প্রেস্টিজ অনলাইন,বলিউড শাদিস
ছবি: ইন্সটাগ্রাম