‘মনোরং’ শিরোনামটি দেখেই মনে হতে পারে মনের বিভিন্ন রঙের কথা। ‘মনোরং’ শব্দটিকে যদি দেখি, তাহলে আমরা এখানে দুটি শব্দ পাই। মন ও রং। এই দুয়ে মিলেই ‘মনোরং’। তাহলে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে ‘মন’ আসলে কী? চলুন আমরা প্রথমে সহজভাবে জানার চেষ্টা করি ‘মন’ কী? কেউ মনে করে, ‘মন’ হলো হৃদয়, যা অনুভব করা যায়। আবার কারও মতে, ‘মন’ শব্দটি ছোট, কিন্তু এর ব্যাপ্তি এত বেশি যে সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। আবার কারও মতে, ‘মন’ বলতে কিছু নেই, সব মস্তিষ্কের খেলা। যদি ‘মন’কে সংজ্ঞায়িত করা না যায়, তাহলে আমাদের প্রতিনিয়ত মনের যে খারাপ লাগা, ভালো লাগা, বিরক্তি, রাগ, অস্থিরতা, বিস্মিত হওয়া—এমন মনের হাজারো রূপ আছে, তা বুঝতে পারতাম না। মনের এই হাজারো রূপ আমরা অনেক সময় বুঝতে পারলেও কিছু প্রশ্নের উত্তর পাওয়া কঠিন। যেমন—
মন কী দিয়ে তৈরি?
মন মানে কি আত্মা?
মন চেনা যায় কেমন করে?
মনের অবস্থা কীভাবে প্রকাশ পায়?
মন কোথায় থাকে?
কেন আমরা দুঃখ পাই?
আবার কেন হাসি?
এ ধরনের বিভিন্ন প্রশ্ন আমাদের মনে ঘুরপাক খায়, যার উত্তর খুঁজে পাওয়া কঠিন।
বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে খুব সহজে আমরা আমাদের মনের কথাগুলো একে অপরের কাছে আদান-প্রদান করি এবং জানাতে পারি যে মন খারাপ হলে কী করা যায়, হতাশায় করণীয় কী, পরীক্ষাভীতি দূর করব কেমন করে? সম্পর্কের বোঝাপড়া দিনকে দিন কেন এত কঠিন হয়ে পড়ছে?
কিন্তু এত কিছু যে মনের মধ্যে ঘটে, সেই মন সম্পর্কে আমরা তেমন কিছুই জানি না। তাই অনেক জানা বিষয় তেমন কোনো কাজে আসে না। মানুষের বাহ্যিক অবয়ব সম্পর্কে ধারণা থাকলেও মন সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা থাকে না। এ জন্য শরীরের মতো মনকে জানতে হবে, তবেই, যে পরিবর্তন নিজের মধ্যে আনতে চাই, তা করা সহজ হবে।
সর্বোপরি বলা যায় যে মন হলো চিন্তা, অনুভব ও আচরণের সমষ্টিগত রূপ, যার অবস্থান মস্তিষ্কে। যেমন যখন মন খারাপ হয়, তখন চিন্তা করি যে আমার দ্বারা কিছু হবে না। মন খারাপ অনুভব করি, যা আবেগ নামেও পরিচিত। তারপর আবেগ বা অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে কান্না নামক আচরণ প্রকাশ করি।
‘মন’ কী, তা বোঝা গেল। কিন্তু সেই মনেরও আছে হাজারো রং। আমাদের মনের ক্যানভাসকে এই অসংখ্য রং দিয়ে রাঙানো যায়। মনকে রাঙিয়ে তুলতে আমরা অনেক কিছু করি। যেমন গান করা, নাচ করা, ঘুরতে যাওয়া, সিনেমা দেখা, আড্ডা দেওয়া, বইপড়া, খেলাধুলা ইত্যাদি।
মনোবিজ্ঞানীরা মনের যত্ন বা মনকে ভালো রাখতে নতুন একটি কৌশল বা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন, যা রং বা সৃষ্টিশীল বিভিন্ন মাধ্যম দ্বারা প্রকাশ করা যায়। যেমন পেইন্টিং, ক্র্যাফট, ভাস্কর্য, ফটোগ্রাফি, ভিডিওগ্রাফি ও কোলাজ আর্ট ইত্যাদি, যাকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় আর্ট থেরাপি বা আর্ট কৌশল বলে। আর্ট থেরাপি হলো একটি সমন্বিত মানসিক স্বাস্থ্য এবং মানবসেবামূলক কৌশল, যা সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিল্পসত্তা, সৃজনশীলতা ও মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্বের আলোকে মনোচিকিৎসায় ব্যক্তি, পরিবার ও সম্প্রদায়ের জীবনকে সমৃদ্ধ করে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই আর্ট থেরাপির কৌশলগুলো মনের যত্নে খুব গুরুত্বের সঙ্গে প্রয়োগ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে এই কৌশলের প্রচলন নেই বললেই চলে। তাই আমরা এই আর্ট থেরাপির বিভিন্ন কৌশল দিয়ে মনের যত্ন কীভাবে নেওয়া যায়, তার খুঁটিনাটি ধারাবাহিকভাবে জানব, যা মনের যত্নে একটি নতুন প্রয়াস হিসেবে বর্তমান ও ভবিষ্যতে আমাদের কাজে লাগবে বলে মনে করি।
লেখক: সহকারী চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী ও আর্ট থেরাপিস্ট