আমরা এমন এক দেশে বাস করি, যার আবহাওয়া সূর্যের আলোয় ভরা, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর; কিন্তু ইদানীং দেখা যাচ্ছে মানুষের ভিটামিন ডির ঘাটতিজনিত সমস্যা বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে ডি ঘাটতি নিয়ে শিশুদের বড় হওয়ার প্রবণতা। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে সূর্য যদি ভিটামিন ডি দিয়ে থাকে, তাহলে কেন আমাদের দেহে ডির ঘাটতি? যদিও বিজ্ঞান বলে যে শ্যামবর্ণের ত্বকে মেলানিন নামক রঞ্জক পদার্থ বেশি থাকে। মেলানিন অতিবেগুনি রশ্মিকে বাধা দেয়। আমাদের দেশে বেশির ভাগ মানুষের গায়ের রং শ্যামবর্ণের হয়। তাই রোদে থাকলেও গায়ের রঙের কারণে ভিটামিন ডি শরীরে শোষণ হওয়ার ক্ষেত্রে একটি বাধা হওয়ায় দেহে ডির ঘাটতি দেখা দিতে পারে। কিন্তু যাদের গায়ের রং উজ্জ্বল, তাদের প্রতিদিন ২০ মিনিট সূর্যের আলোয় থাকলেই শরীরের ডির ঘাটতি পূরণ হয়ে যায়।
ভিটামিন ডি হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পুষ্টি উপাদান। এটি ক্যালসিয়াম শোষণে সাহায্য করে, হাড়কে শক্তিশালী করে এবং বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। তবে অতিরিক্ত ভিটামিন ডিও ক্ষতির কারণ হতে পারে। ডি ভিটামিন আবার দুই ধরনের কোলেক্যালসিফেরল; ভিটামিন ডি৩; এরগোক্যালসিফেরল; ভিটামিন ডি২ কোলেক্যালসিফেরল বা ভিটামিন ডি৩ হলো একটি চর্বি দ্রবণীয় ভিটামিন, যা সূর্যের আলো থেকে আসে। এটি শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর ভিটামিন ডি২ (এরগোক্যালসিফেরল): এটি প্রধানত উদ্ভিদ–উৎস থেকে পাওয়া যায়। এই ঘাটতি পূরণে খাবার খেলেই হয়। বিশেষ ক্ষেত্রে সাপ্লিমেন্ট খাওয়ার প্রয়োজন হয়।
হাড়ের স্বাস্থ্য: ভিটামিন ডি ক্যালসিয়াম শোষণে সাহায্য করে, যা হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। হাড় শক্ত করে, শরীরে ফসফরাস ও ক্যালসিয়াম শোষণের জন্য প্রয়োজন ভিটামিন ডির ২টি উপাদান হাড়ের মূল গঠন তৈরি করে। ভিটামিন ডির অভাবে হাড় দুর্বল হয় এবং আস্তে আস্তে হাড় ভঙ্গুর হয়ে পড়ে, যাকে অস্টিওপরোসিস রোগও বলা হয়।
পেশির শক্তি বাড়ায়: ভিটামিন ডির অভাবে শরীরের মাংসপেশির দুর্বলতা বেড়ে যায়। বিশেষ করে মাংসপেশি বেড়ে যাওয়া ও মাংসপেশি কাঁপার মতো সমস্যাগুলো হয়ে থাকে। শরীরে ক্যালসিয়ামের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ভিটামিন ডি পেশির শক্তি বৃদ্ধি করে। শারীরিক ক্ষমতা বৃদ্ধিতেও এটি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে।
রোগ প্রতিরোধক্ষমতা: ভিটামিন ডি ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে এবং বিভিন্ন সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে।
মনোদৈহিক স্বাস্থ্য: ভিটামিন ডি ডিপ্রেশন এবং অন্যান্য মানসিক সমস্যা কমাতে সাহায্য করে।
হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমায়: ভিটামিন ডি হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। · শিশুদের জন্য উপকার: শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের হাড়ের বৃদ্ধির জন্য ভিটামিন ডি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভিটামিন ডির অভাবে শিশুদের হাড়ে বিকৃতি বা রিকেট রোগ হতে পারে।
অতিরিক্ত ভিটামিন ডি গ্রহণ করলে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে—
কিডনিতে পাথর: অতিরিক্ত ভিটামিন ডি কিডনিতে ক্যালসিয়াম জমে কিডনি পাথর তৈরি করতে পারে।
পাচনরসের সমস্যা: অতিরিক্ত ভিটামিন ডি পাচনরসের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। হজম ক্ষমতা কমে যাওয়া।
হাড়ের দুর্বলতা: অতিরিক্ত ভিটামিন ডি আসলে হাড়কে দুর্বল করে তুলতে পারে।
মনোদৈহিক সমস্যা: অতিরিক্ত ভিটামিন ডি বিভিন্ন ধরনের মনোদৈহিক সমস্যা যেমন মাথা ব্যথা, ক্লান্তি ইত্যাদি সৃষ্টি করতে পারে।
ভিটামিন ডির মূল প্রাকৃতিক উৎস হলো সূর্যের আলো। বিশেষ করে ইউভি-বি রশ্মি৷ যখন শরীরের ত্বক অনাবৃত থাকে, তখন ত্বকের কোষ ফোটোলাইসিস প্রক্রিয়ায় সূর্যালোককে ভিটামিন ডি-৩ তে পরিবর্তিত করে।
সূর্যের আলো: সূর্যের আলোয় ভিটামিন ডি তৈরি হয়।
খাবার: মাছ, ডিম, দুধ, সয়ামিল্ক, কিছু ধরনের শাকসবজি, কডলিভার অয়েল বা মাছের তেল, ভিটামিন ডির ভালো উৎস।
সূর্যের আলো থেকে ভিটামিন ডি তৈরি হওয়া একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। তবে সব সময়ের সূর্যের আলো থেকে সমান পরিমাণে ভিটামিন ডি পাওয়া যায় না। সূর্যের তাপ থেকে সর্বাধিক ভিটামিন ডি পাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কিছু সময় রয়েছে। সর্বোত্তম সময় হচ্ছে দুপুরের আগে সাধারণত সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টার মধ্যে সূর্যের আলোতে অতিবেগুনি বি রশ্মি (UVB) থাকে যা ত্বকে ভিটামিন ডি তৈরি করতে সাহায্য করে। এই সময়টাতে সূর্যের তাপ সবচেয়ে বেশি থাকে এবং ত্বকে সরাসরি সূর্যের আলো পৌঁছাতে পারে।
ভিটামিন ডি পেতে হলে অবশ্যই ত্বকে সরাসরি সূর্যের আলো লাগাতে হবে৷ সে ক্ষেত্রে পোশাক বা সানস্ক্রিন সরাসরি ত্বকে ভিটামিন ডি তৈরিতে বাধা দেয়। তাই মুখে সানস্ক্রিন মেখে বের হলেও হাত-পা বা শরীরের অন্য কোনো স্থান যেন উন্মুক্ত থাকে, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে৷
অস্টিওপরোসিস, বিষণ্ণতা, জরায়ু ক্যানসার, স্তন ক্যানসার এমনকি ডায়াবেটিস এবং মেদবৃদ্ধি প্রতিরোধে ভিটামিন ডির ভূমিকা আছে। অনেকেই আছেন যাঁরা নিজেরাও জানেন না যে তাঁরা ভিটামিন ডির অভাবে ভুগছেন। যদি নিজের মধ্যে ওপরের লক্ষণগুলো বুঝতে পারেন, তাহলে কাছাকাছি হাসপাতালে গিয়ে ভিটামিন ডির মাত্রা পরীক্ষা করে নিন।
লেখক: খাদ্য ও পথ্য বিশেষজ্ঞ; প্রধান নির্বাহী, প্রাকৃতিক নিরাময় কেন্দ্র
ছবি: পেকজেলসডটকম