মানুষ বাঁচতে চায়। আর সেই বাঁচা যেন হয় সুস্থতায়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে মানুষের গড় আয়ু। রোগ হলে হাতের নাগালের মধ্যেই রয়েছে চিকিৎসা। এমনকি ক্যানসারের মতো জটিল রোগ নিরাময়েরও সুযোগ তৈরি হয়েছে, হচ্ছে যুগান্তকারী সব গবেষণাও। তবে প্রেসক্রিপশন আর পাতার পর পাতা ওষুধ থেকে দূরে থেকেও আয়ু বাড়ানো যেতে পারে।
সম্প্রতি আমেরিকান সোসাইটি ফর নিউট্রিশনের বার্ষিক বৈঠকে উপস্থাপিত এক গবেষণায় এমনই একটি সাড়াজাগানো তথ্য সামনে এসেছে। সিএনএন হেলথ আর সিএনবিসি এই নিয়ে করেছে প্রতিবেদন। এ গবেষণার ফলাফল বলছে, ৪০ বছর বয়সের আগে আপনার প্রতিদিনকার জীবনে ৮টি অভ্যাস অনুশীলন করলে পুরুষদের ২৪ বছর আর নারীদের ২১ বছর পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে আয়ু। এমনকি বিজ্ঞানীরা এ–ও দাবী করছেন যে এই আট অভ্যাসের মধ্য থেকে যদি অন্তত দুয়েকটি অভ্যাসও গড়ে তোলা যায়, তাতেও জীবনকাল তিন-চার বছর বৃদ্ধি পেতে পারে। এবারে সেই আট অভ্যাস সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক ভালোভাবে।
ব্যায়ামের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বলা শুরু করলে তা শেষ হবে না। শারীরিকভাবে সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকতে ব্যায়ামের বিকল্প নেই। অল্প বয়স থেকেই প্রতিদিন নিয়ম করে ব্যায়াম, সাইকেল চালানো, সাঁতার, দৌড়ানো কিংবা হাঁটার মতো সাধারণ শরীরচর্চার অভ্যাস করতে হবে। অনেকেই জিমে যেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না কিংবা অন্য কোনো ধরনের শরীরচর্চা করার সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে বাসার ছাদে কিংবা বাড়ির সামনের রাস্তায় হাঁটতে পারেন। নিদেনপক্ষে, স্কুল, কলেজ, অফিস, বাজার থেকে আসার পথটুকু হেঁটে চলে আসতে পারেন। প্রাথমিকভাবে কিছুটা কষ্ট হলেও, ধীরে ধীরে অভ্যাসে পরিণত হবে।
সিগারেটের প্যাকেটে থাকা ভয়ংকর ছবি দেখে সহজেই ধূমপানের স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। ধূমপান শুধু যে ধূমপায়ীর ক্ষতি করে, তা নয়, ধূমপায়ীর আশপাশে থাকা মানুষও ক্ষতির সম্মুখীন হন। ধূমপানের ফলে ফুসফুসের ক্যানসার, হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্টের ঝুঁকি বাড়ে এবং প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপরেও ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। যাঁরা ইতিমধ্যে ধূমপানের অভ্যাস তৈরি করে ফেলেছেন এবং অভ্যাস ছাড়তে পারছেন না, তাঁরা আস্তে আস্তে ধূমপান ছাড়ার চেষ্টা করুন। নিকোটিন প্যাচ ব্যবহার করা ধূমপান ত্যাগের একটি কার্যকর উপায়। এ ছাড়া প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা এবং মাঝেমধ্যে আদা ও চুইংগাম চিবানো ধূমপান করার প্রবণতা সাময়িকভাবে কমিয়ে দেয়।
দুশ্চিন্তার ফলে আমাদের দেহে কর্টিসল নামক হরমোন নিঃসৃত হয়। এর ফলে ওজনাধিক্যের মতো সমস্যা দেখা যায়। দুশ্চিন্তার ফলে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার ফলে উচ্চ রক্তচাপ, দ্রুত বুড়িয়ে যাওয়া ও অল্প বয়সে মৃত্যু ঘটে। তাই নিজের পছন্দের নানা কাজে ব্যস্ত থাকার মাধ্যমে মন ভালো রাখার চেষ্টা করতে হবে। প্রয়োজনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ করার অন্যতম কারণ হচ্ছে খাদ্যে যথেষ্ট পরিমাণ পুষ্টির অভাব। তাই স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিপূর্ণ পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাসে যোগ করতে হবে। শর্করা, আমিষ, স্নেহের মতো মূল পুষ্টি উপাদানগুলো ছাড়াও ভিটামিন, মিনারেলসহ সব ধরনের ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্টও প্রতিদিনের খাবারে যোগ করতে হবে। রঙিন শাকসবজি, বিভিন্ন ধরনের ফলমূলে প্রচুর পরিমাণে ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্ট পাওয়া যায়। তাই চেষ্টা করতে হবে নিয়মিত মৌসুমি ফল ও শাকসবজি খাওয়ার।
ভালো কোনো খাবার সামনে থাকলে, টিভি বা মোবাইল দেখতে দেখতে খাবার গ্রহণ করলে কিংবা আবেগের কারণে আমরা প্রায়ই প্রয়োজনের বেশি খেয়ে ফেলি। নানা মানসিক কারণেও অতিভোজন করে থাকেন অনেকে। তবে তা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই খারাপ। ওজনাধিক্য তো আছেই, একই সঙ্গে হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস, রক্তে কোলেস্টেরল বৃদ্ধি—ইত্যাদি নানা রোগের পেছনের কারণ হিসেবে কাজ করে অতিভোজন। তাই খাবারের সঙ্গে একটি সুস্থ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। যাঁরা টিভি বা মোবাইল দেখতে দেখতে মনের অজান্তে বেশি খেয়ে ফেলেন, তাঁরা চেষ্টা করবেন প্লেটে কম খাবার তুলে নিতে এবং দ্বিতীয়বার আর খাবার না নিতে। অতিভোজন কমাতে পোর্শন কন্ট্রোল সম্পর্কে জ্ঞান থাকা জরুরি।
সারা দিনের কর্মব্যস্ততার পর অন্তত সাত-আট ঘণ্টার ঘুম আমাদের সুস্থতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যদিও এখনকার যুগে অনেকেই কম ঘুমিয়ে কাজ করতে পারাকে বেশ গর্বের সঙ্গে জাহির করেন, তবে অদূর ভবিষ্যতে তা শারীরিক ও মানসিক—দুইভাবেই ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তাই ‘নাইট আউল’ হওয়ার ট্রেন্ডকে পেছনে ফেলে ‘আর্লি টু বেড’-এ ফিরে যাওয়ার সময় এসে গেছে বলেই মনে হয়। প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় ঠিক করুন এবং সেই সময়েই ঘুমাতে যান। এতে করে আপনার দেহ নতুন রুটিনে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। ঘুমাতে যাওয়ার আগে কোনো ধরনের ইলেকট্রনিক গ্যাজেট ব্যবহার না করাই ভালো।
মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। বিশ্বস্ত কিছু মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলুন। এতে করে আপনার জীবনে ঘটে যাওয়া ভালো বা খারাপ ঘটনাগুলো কারও সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে পারবেন। এর ফলে আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর চাপ কমবে। এ ছাড়া যদি কয়েকজন মিলে একসঙ্গে কোনো কাজ করা হয়, তবে কাজের প্রতি আগ্রহ বজায় থাকে। এতে কাজগুলো করে আনন্দও মেলে।
আমাদের মধ্যে অল্প ব্যথাতেই পেইনকিলার বা ব্যাথানাশক ওষুধ গ্রহণ করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এতে সাময়িক আরাম পাওয়া গেলেও দীর্ঘদিন এগুলো ব্যবহারের ফলে কিডনিতে সমস্যা দেখা দিতে পারে। এমনকি কিডনি বিকল হওয়ার ঘটনাও দেখতে পাওয়া যায়। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন। নতুবা হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কাই বেশি থাকে।
ছবি: পেকজেলসডটকম ও হাল ফ্যাশন