আন্তর্জাতিক যোগ ব্যায়াম দিবস: ৩টি সহজ যোগাসনে সুস্থ জীবন
শেয়ার করুন
ফলো করুন

আজ আন্তর্জাতিক যোগ ব্যায়াম দিবস। প্রতিবছর ২১ জুন বিশ্বজুড়ে এই দিনটি পালন করা হয়। মানুষের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য যোগাভ্যাসের কতটা প্রয়োজন, সেই সম্পর্কে সবার মাঝে সচেতনতা বাড়াতে দিনটি পালন করা হয়।

যোগ শব্দের সাধারণ অর্থ ইউনিয়ন বা মিলন। এ মিলন কার সঙ্গে কার? আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের। মানুষের দেহ, মন ও এনার্জি বা শক্তি—তিনটি জিনিসের সমন্বয়ে আমাদের শরীর চলে। এর কোনো একটি যদি ঠিকঠাক কাজ না করে, তাহলে আমাদের শরীর ঠিকভাবে কাজ করবে না। আর ইয়োগা ঠিক এ কাজটাই করে থাকে এ তিনটির সমন্বয় করে। নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ–নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষেরই সুস্থ থাকার জন্য কিছু না কিছু যোগব্যায়াম করা দরকার। বলতে হয়, ‘সুষম খাদ্য খাওয়া, যোগাসন করা, সঠিক লাইফস্টাইল, স্ট্রেস মুক্ত জীবনযাপন করা।’ কারণ, কোনো ধরনের ওষুধ ছাড়া যোগচর্চাই পারে আমাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে।

টেনশন বা স্ট্রেস থেকে মানুষের যে কত রোগ হতে পারে এবং আয়ু কমে যেতে পারে, আধুনিক বিজ্ঞানীরা তা অনেকভাবে দেখিয়েছেন। ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগ থেকে শুরু করে প্রায় সব রোগের গোড়ায় রয়েছে মানসিক চাপ। যোগাচার্যদের মতে যোগাসনের মাধ্যমে সবচেয়ে কার্যকর উপায়ে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আর এই জন্যই দিনে দিনে যোগের গ্রহণযোগ্যতা সবার মধে৵ বেড়েই চলছে।তবে যোগাসন যেহেতু শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার বিষয়, তাই এ বিষয়ে অনেক সতর্কতা থাকা জরুরি। আপনি যখনই কোনো যোগাসন করতে চাইবেন, তখন আপনাকে আগে অবশ্যই জেনে নিতে হবে এটি আপনার জন্য উপযোগী কি না, বা আপনি সঠিক নিয়মে করছেন কি না। তাই যোগের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় প্রশিক্ষক বা কোচের। তবে যোগে এমন অনেক আসন আছে যা সবাই করতে পারে। যেগুলো করতে আপনাকে খুব অভিজ্ঞ হতে হবে না। সাধারণ কিছু নিয়ম মেনে করলেই আপনি এই আসনের অনেক উপকারিতা পেতে পারেন। আসুন আজ তেমনই দুটি আসন সম্পর্কে জেনে নেই।

বিজ্ঞাপন

জানুশিরাসন

যে আসনে অবস্থানের সময় জানু অর্থাত্‍ হাঁটুর ওপর শির অর্থাত্‍ মাথা রাখতে হয়, সেই আসনকে বলা হয় জানুশিরাসন। আসুন জেনে নিই কীভাবে করবেন জানুশিরাসন।

পদ্ধতি: সামনের দিকে পা ছড়িয়ে সোজা হয়ে বসুন। ডান পায়ের হাঁটু ভেঙে গোড়ালি দুই পায়ের সংযোগস্থলে রাখুন। ডান পায়ের পাতার নিচের দিকটা বাঁ ঊরুর সঙ্গে লেগে থাকবে। বাঁ পা পূর্বাবস্থায় সামনের দিকে ছড়িয়ে থাকবে এবং হাঁটুর নিচের দিকটা মেঝের সঙ্গে লেগে থাকবে। এবার দুই হাত দিয়ে বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুল ধরুন। এখন কোমর থেকে শরীরের উপরাংশ নিচু করে কপাল বাঁ পায়ের হাঁটুতে এবং দুই কনুই বাঁ পায়ের দুই পাশে মেঝেতে রাখুন। বাঁ হাঁটু যেন না ভাঙে। শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক রেখে ২০ সেকেন্ড থেকে ৩০ সেকেন্ড এই অবস্থায় থাকুন।
 
প্রথম প্রথম দু–এক দিন হয়তো কপাল ও কনুই ঠিক জায়গায় যাবে না। সহজভাবে যতটুকু হয়, ততটুকুই করুন। দু–চার দিন অভ্যাসের পর ঠিক হয়ে যাবে। ভালোমতো অভ্যাস হয়ে গেলে প্রতিবার অভ্যাসের সময় বাড়ানো যেতে পারে, তবে কোনোমতেই যেন এক মিনিটের বেশি না হয়। এ আসন অভ্যাসের আগে বা পরে এমন একটি আসন করা উচিত যাতে মেরুদণ্ড পেছন দিকে বাঁকানো যায়। যেমন উষ্ট্রা, সেতুবন্ধ আসন।
 
উপকারিতা: আসনটি মেরুদণ্ড ও পেটের জন্য বিশেষ উপকারী। এ আসন অভ্যাস রাখলে মেরুদণ্ডের হাড়ের সংযোগস্থল নমনীয় থাকে এবং মেরুদণ্ডসংলগ্ন স্নায়ুমণ্ডলী দুই পাশের পেশা সবল ও সক্রিয় থাকে। মেরুদণ্ড সুস্থ ও নমনীয় থাকলে গ্রন্থি ও স্নায়ুতন্ত্রের কাজ স্বাভাবিক থাকে। বিশেষ করে অগ্ন্যাশয়, মূত্রাশয়, প্রজনন প্রভৃতি গ্রন্থি সতেজ ও কর্মক্ষম থাকে। বহুমূত্র রোগীর আসনটি করা অবশ্য দরকার। আসনটি হাত, পা, পেট ও বস্তিপ্রদেশের পেশি ও স্নায়ুজাল সতেজ ও সক্রিয় রাখে, জঠরাগ্নি বৃদ্ধি করে, অজীর্ণ, কোষ্ঠবদ্ধতা, বহুমূত্র, স্বপ্নদোষ, অর্শ প্রভৃতি রোগ কোনোদিন হতে দেয় না। উপরন্তু ঊরুর সংযোগস্থলের স্থিতিস্থাপকতা বজায় রাখে এবং পেট ও কোমরের অপ্রয়োজনীয় মেদ কমিয়ে দেহের গড়ন সুন্দর করে। কিশোর-কিশোরীদের লম্বা হতে সাহায্য করে। এ অভ্যাস রাখলে কোন দিন কোন বাত বা সায়োটিকা হয় না, আর থাকলেও অল্প দিনে ভালো হয়ে যায়।
 
সতর্কতা: যাদের হার্নিয়া বা অ্যাপেন্ডিসাইটিস রোগ আছে, রোগ নিরাময় না হওয়া পর্যন্ত তাদের আসনটি করা উচিত নয়। আর যাদের প্লীহা, যকৃৎ রুগ্‌ণ বা অত্যধিক বড়, তাদের অতি সতর্কতার সঙ্গে আসনটি করা উচিত০। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ না নিয়ে ঝুঁকি নেওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।

বিজ্ঞাপন

ভুজঙ্গাসন বা সর্পাসন

এই আসনে করার সময় দেহের ভঙ্গিমা অনেকটা সাপের মতো দেখায় বলে আসনটির নাম ভুজঙ্গাসন বা সর্পাসন।

পদ্ধতি: পা দুটি সোজা করে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ুন। পায়ের পাতার ওপর দিকটা যতদূর সম্ভব মুড়ে মেঝেতে রাখতে হবে। গোড়ালি একসঙ্গে রাখুন দুই হাতের তালু উপুড় করে পাঁজরের কাছে দুই পাশে মেঝেতে রাখুন। এবার পা থেকে কোমর পর্যন্ত মেঝেতে রেখে হাতের তালুর ওপর ভর দিয়ে মাথা যতদূর সম্ভব ওপরে তুলুন এবং মাথাকে সাধ্যমতো পেছন দিকে বাঁকিয়ে ওপরের দিকে তাকান। শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক রেখে ২০ সেকেন্ড থেকে ৩০ সেকেন্ড এ অবস্থায় থাকুন। এরপর আস্তে আস্তে মাথা ও বুক নামিয়ে উপুড় হয়ে পড়ুন।
 

কিছুদিন অভ্যাসের পর হাতের তালুর ওপর ভর না দিয়ে বুক ও মাথা ওপরে তুলতে হবে। শুধু বুক ও পিঠের উপর জোর দিয়ে মাথা ও বুক ওপরে রাখতে হবে এবং হাত দুটো কাঁধ বরাবর তুলে উঁচু করে রাখতে হবে। এভাবে আসনটি দুই বার করুন এবং প্রয়োজনমতো শবাসনে বিশ্রাম নিন।
 
উপকারিতা: আসনটিতে ঘাঁড়, গলা, মুখ, বুক, পেট, পিঠ, কোমর ও মেরুদণ্ডের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়ে বলে শরীরের ওইসব অঞ্চলের স্নায়ুতন্ত্র ও পেশি সতেজ ও সক্রিয় থাকে। মেরুদণ্ডের হাড়ের জোড় নমনীয় হয়। বাঁকা মেরুদণ্ড সোজা ও সরল হয়। আসনটির সঙ্গে মেরুদণ্ড সামনের দিকে বাঁকানো যায় এমন আসন, যেমন শশাঙ্গাসন, পদ-হস্তাসন বা ওই ধরনের কোনো আসন অভ্যাস রাখলে স্পন্ডিলাইসিস, স্লিপড ডিস্ক–জাতীয় রোগ কোনো দিন হতে পারে না। বুকের পেশি ও পাঁজরের হাড় বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং বুক সুগঠিত হয়। হৃৎপিণ্ডের পেশি এবং ফুসফুসের বায়ুকোষ ও স্নায়ুজালের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে। মেয়েদের জন্য আসনটি অবশ্য করণীয়। আসন অবস্থায় ডিম্বাশয়ে প্রচুর রক্ত সঞ্চালিত হয় বলে কোনো স্ত্রী-ব্যাধি সহজে হতে পারে না, আর থাকলেও অল্প দিন অভ্যাসে ভালো হয়ে যায়। যেসব ছেলেমেয়ের বয়স অনুযায়ী বুকের গড়ন সরু বা অপরিণত, আসনটি কিছুদিন নিয়মিত অভ্যাস করলে তাদের বুক সুগঠিত হয়ে ওঠে।

পূর্ণ-ভুজঙ্গাসন

পদ্ধতি: ভুজঙ্গাসনের প্রথম অবস্থার ভঙ্গিমায় বসুন অর্থাৎ হাত দুটো পাঁজরের দুই পাশে রেখে ভুজঙ্গাসন করুন। এবার হাতের তালুর ওপর জোর দিয়ে মাথা ও বুক যতদূর সম্ভব পেছন দিকে বাঁকিয়ে নিয়ে যান এবং ওপর দিকে তাকান। এ অবস্থায় হাত দুটো সোজা হয়ে যাবে এবং গম্বুজের কাজ করবে। এখন কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত মাটিতে রেখে হাঁটু ভেঙে পায়ের পাতা দুটো মাথার ব্রহ্মতালুতে রাখুন। শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক রেখে ২০ সেকেন্ড থেকে ৩০ সেকেন্ড এ অবস্থায় থাকুন। এরপর হাত-পা আলগা করে আস্তে আস্তে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ুন। আসনটি এভাবে দুই–তিন বার করুন এবং প্রয়োজনমতো শবাসনে বিশ্রাম নিন।


উপকারিতা: ভুজঙ্গাসনের সব গুণ আসনটিতে বর্তমান। এতে আরও তাড়াতাড়ি এবং ভালো ফল পাওয়া যায়। এ ছাড়া আসনটিতে পা, বস্তিপ্রদেশ ও নিতম্বের খুব ভালো ব্যায়াম হয়। দেহে বাত ও সায়োটিকা আক্রমণ করতে পারে না।
 
সতর্কতা:গর্ভবতী অবস্থায় এই আসন করা যাবে না।মাসিক চলাকালে না করাই ভালো।
যাদের শোল্ডার জয়েন্টে সমস্যা আছে, তাঁরা সাবধানে করুন।

ছবি: সাইফুল ইসলাম

প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৪, ০২: ৩০
বিজ্ঞাপন