হরমোন বিষয়ে আমরা সবাই কিছু না কিছু পড়েছি, তাই আমাদের শারীরিক সুস্থতা ও সার্বিক তত্ত্বাবধানে হরমোনের গুরুত্ব বিষয়ে আমরা সবাই কমবেশি জানি। তবে আমরা অনেকেই জানি না, ওজন বৃদ্ধি বা অনিচ্ছাকৃতভাবে ওজন হ্রাস, অপর্যাপ্ত ঘুম, বমি বমি ভাব, উচ্চ রক্তচাপের মতো নানা ধরনের সমস্যার পেছনে ‘কর্টিসল’ নামক একটি হরমোনের বিশাল ভূমিকা রয়েছে।
প্রচলিতভাবে ‘স্ট্রেস হরমোন’ নামে পরিচিত কর্টিসল একটি গ্লুকোকর্টিকয়েড হরমোন। স্ট্রেস কিংবা দুশ্চিন্তায় থাকলে আমাদের শরীর প্রচুর পরিমাণে এই হরমোন নিঃসরণ করে। ফলে একে সাধারণত স্ট্রেস হরমোন বলা হয়। তবে আরও নানা কারণে এই হরমোন উদ্দীপিত হতে পারে। কর্টিসল আমাদের দেহের প্রায় সব টিস্যুর সঙ্গে জড়িত। অর্থাৎ আমাদের দেহের প্রায় সব টিস্যুর কার্যকলাপেই ভূমিকা রাখতে পারে এই কর্টিসল। কিডনির ওপর অবস্থিত এড্রেনাল গ্রন্থি থেকে নিঃসরিত এই হরমোন আমাদের দেহকে প্রদাহ বা ইনফ্লেমেশন থেকে রক্ষা করে। একই সঙ্গে আমাদের পেশি, যকৃত, হাড় ও চর্বির বিপাকক্রিয়া (মেটাবলিজম) নিয়ন্ত্রণ করে। কোন পরিস্থিতিতে দেহের কোন টিস্যুর কীভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা উচিত, তা–ও নিয়ন্ত্রণ করে এই কর্টিসল।
আমাদের আরও অনেক শারীরবৃত্তীয় কাজে কর্টিসলের ভূমিকা রয়েছে। যেমন—
* স্ট্রেস কিংবা দুশ্চিন্তার সময়ে আপনার দেহের প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা
* দেহের মেটাবলিজম নিয়ন্ত্রণ করা এবং শর্করা, আমিষ ও স্নেহজাতীয় খাবার দেহের কোন কাজে ব্যবহার হবে, তা ঠিক করে দেওয়া
* কোনো ধরনের আঘাত কিংবা প্রদাহ কমিয়ে আনা
* রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা
* রক্তে চিনি বা গ্লুকোজের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখা
* স্লিপ সাইকেল বা নিদ্রা চক্র নিয়ন্ত্রণ করা
দিনের বিভিন্ন সময়ে দেহে কর্টিসলের পরিমাণ ওঠানামা করে। দিনের শুরুতে সাধারণত কর্টিসলের পরিমাণ বেশি থাকে এবং দিনের শেষ ভাগে সবচেয়ে কম। বেশির ভাগ গবেষণায় উঠে এসেছে যে স্বাভাবিক অবস্থায় সকাল ৬টা থেকে ৮টা পর্যন্ত প্রতি ডেসিলিটার রক্তে ১০-২০ মাইক্রোগ্রাম কর্টিসলের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়, যা বিকেল ৪টার পরে ৩-১০ মাইক্রোগ্রামে নেমে আসে। ফলে দিনের শেষ ভাগে আমরা ক্লান্ত অনুভব করি। রক্তে কর্টিসলের মাত্রা অতিরিক্ত কম বা বেশি হলে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
রক্তে কর্টিসলের মাত্রা কম বা বেশি হলে যে ধরনের সমস্যা হতে পারে
রক্তে কর্টিসলের অতিরিক্ত বেশি বা কম পরিমাণে থাকা, দুটোই নানা সমস্যার জন্ম দেয়। তবে অনেকেই যেহেতু কর্টিসল সম্বন্ধে জানেন না, হুট করে কোনো স্পষ্ট কারণ ছাড়াই বিভিন্ন শারীরিক পরিবর্তন দেখে হতাশ হয়ে পড়েন। তাই কর্টিসলের ওঠানামায় কী কী সমস্যা দেখা দেয়, তা জেনে রাখা ভালো।
রক্তে কর্টিসলের মাত্রা বেশি থাকলে—
* হুট করে ওজন বেড়ে যায়, বিশেষ করে তলপেটে ও মুখে
* ঘাড়ে চর্বি জমে যায়
* তলপেটে হালকা বেগুনি রঙের স্ট্রেচ মার্ক দেখা যায়
* বাহু ও ঊরু দুর্বল হয়ে পড়ে
* রক্তে চিনির পরিমাণ বেড়ে যায়, যা ধীরে ধীরে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে রূপ নিতে পারে
* উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়
* অনাকাঙ্ক্ষিত জায়গায় অতিমাত্রায় চুল গজায়
অপর দিকে রক্তে কর্টিসলের মাত্রা কম থাকলে—
* বমি বমি ভাব দেখা দেয়
* অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ওজন হ্রাস পায়
* রুচি নষ্ট হয়ে যায়
* নিম্ন রক্তচাপ দেখা দেয়
অনেক সময় সমাধান এতটাই সহজ ও সাধারণ হয় যে আমাদের চোখের সামনে থাকা সত্ত্বেও আমরা তা দেখতে পাই না। এ ক্ষেত্রেও তাই। সুস্থ জীবনযাপন করতে চাইলে স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তোলাটা সবচেয়ে জরুরি। আর ইদানীংকার যুগে স্বাস্থ্যকর অভ্যাসগুলোই আমরা হারাতে বসেছি। অথচ কিছু সাধারণ অভ্যাস, যা আমরা বছরের পর বছর ধরে পালন করে আসছি, তাই আমাদের বর্তমান যুগের বেশির ভাগ স্বাস্থ্য–সম্বন্ধীয় সমস্যার সমাধান এবং প্রতিকার করতে পারে।
আমাদের দেহের স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী সকালে কর্টিসলের মাত্রা বেশি থাকে, যা আমাদের দৈনন্দিন কাজগুলো সারার জন্য পর্যাপ্ত শক্তি দেয়। তবে দিন যত শেষের দিকে গড়ায়, রক্তে কর্টিসলের পরিমাণও কমতে থাকে, যা আমাদের দেহের জন্য একটি সংকেত হিসেবে কাজ করে যে এখন বিশ্রামের সময় হয়েছে। যথাসময়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম দেহের স্বাভাবিক কর্টিসলের পরিমাণ বজায় রাখার জন্য তাই জরুরি। কিন্তু অপর্যাপ্ত ও অসময়ে ঘুম এই হরমোনের স্বাভাবিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।
কর্টিসলের ভারসাম্য রক্ষায় বাধা পড়ার অন্যতম দুটি কারণ হচ্ছে অপর্যাপ্ত ঘুম ও অতিমাত্রায় দুশ্চিন্তা। নিয়মিত শরীরচর্চার মাধ্যমে পর্যাপ্ত ঘুম ও ফুরফুরে মেজাজ, দুটোই নিশ্চিত করা সম্ভব।
দুশ্চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হলেও, কিছু সাধারণ বিষয় মাথায় রাখলে তা অর্জন করা সম্ভব। তবে এ জন্য দরকার সচেতনভাবে চেষ্টা করা। যোগাসন, বিভিন্ন ধরনের ব্যায়াম, এসব ব্যাপারে সাহায্য করে। এ ছাড়া দীর্ঘ শ্বাসপ্রশ্বাসও একটি ভালো উপায় দুশ্চিন্তা এড়ানোর। সচেতনভাবে দীর্ঘশ্বাস নেওয়া ও ছাড়া আমাদের প্যারাসিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেমকে উদ্দীপিত করে, যা আমাদের রক্তে কর্টিসল লেভেল কমিয়ে আনে। তাই হঠাৎ কোনো বিষয়ে দুশ্চিন্তা করতে শুরু করলে সচেতনভাবে দীর্ঘ শ্বাসপ্রশ্বাস নিন। এতে করে কিছুক্ষণের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে আসতে পারবেন।
হাসলে আমাদের দেহ থেকে এন্ডোরফিন নিঃসরিত হয়, যা কর্টিসলের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। তাই পছন্দের কাজ বেশি করা উচিত। তা হতে পারে খেলাধুলা, বই পড়া, আড্ডা দেওয়া ইত্যাদি যেকোনো কিছু। চেষ্টা করুন হেলদি সম্পর্কগুলোতে সময় দেওয়ার এবং আনহেলদি সম্পর্ক এড়িয়ে চলার। সম্পর্ক ভালো নয়, এমন মানুষদের এড়িয়ে চললে মানসিকভাবে হালকা থাকবেন। অপর দিকে কাছের মানুষদের সঙ্গে সময় কাটালে তা আপনাকে আনন্দ দেবে, ফলে কর্টিসলের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
এরপরও যদি উপসর্গগুলো দেখা যায়, তবে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করুন। কারণ, রক্তে কর্টিসল অতিমাত্রায় বেড়ে গেলে কুশিং সিনড্রোমের মতো রোগ দেখা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে তা নিয়ন্ত্রণে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি।
ছবি: পেকজেলসডটকম