দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের রান্নায় অন্যতম আলোচিত মসলা-উপাদান চুইঝাল; যদিও এর ফলন বেশি হয় পঞ্চগড়ের ঠাকুরগাঁওয়ে। কিন্তু খুলনা অঞ্চলের মানুষ এটাকে ট্র্যাডিশন হিসেবে গণ্য করে থাকে। এই চুইঝালের রয়েছে অনেক খাদ্যগুণ। বিশেষ করে কিছু বিরল উপাদান রয়েছে, যা মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্য বিশেষ অবদান রাখতে পারে। খুলনা অঞ্চলে চুইঝালের কাণ্ড, শিকড় বা লতা ছোট ছোট টুকরা করে মসলা হিসেবে গরুর মাংস বা খাসির মাংস রান্নায় ব্যবহার করা হয়, যা এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী এবং খুবই জনপ্রিয় একটি পদ।
চুইঝালের শিকড়, কাণ্ড, পাতা, ফুল-ফল—সবই ভেষজ গুণসম্পন্ন। এ ছাড়া মসলা হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হয়। তবে ঝাল হিসেবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় কাণ্ড ও ডালের অংশ দিয়ে হাঁস ও গরুর মাংস রান্নায়। মূলত রান্নার জন্য চুইঝালের কাণ্ড ব্যবহার করা হয়। চুইঝালে দশমিক ৭ শতাংশ সুগন্ধি তেল থাকে।
চুইঝালে আছে আইসোফ্লাভোন, অ্যালকালয়েড, পিপালারিটিন, পিপারন, পোলার্টিন, গ্লাইকোসাইডস, মিউসিলেজ, গ্লুকোজ, ফ্রুকটোজ, সিজামিন, পিপলাস্টেরল। চুইয়ের শিকড়ে রয়েছে ১৩ দশমিক ১৫ শতাংশ পিপারিন। এর রয়েছে নানা রাসায়নিক প্রভাব, যা নানা ঔষধি গুণসম্পন্ন। যেমন অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল, অ্যান্টিলেশম্যানিয়াল, অ্যান্টিম্যালেরিয়াল, অ্যান্টিপ্যারাসাইটিক, সাইটোটক্সিক/অ্যান্টিক্যানসার, অ্যাডিপোজেনিক, হেপাটো এবং গ্যাস্ট্রো প্রতিরক্ষামূলক, অ্যান্টিডায়াবেটিক, অ্যানালজেসিক, অ্যান্টিডায়রিয়াল, ডিপ্রেশন, অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি, মূত্রবর্ধক, অ্যান্টিহাইপারটেনসিভ, অ্যান্টিপাইরেটিক, অ্যান্টি-আলসার এবং ইমিউনোমোডুলেটরি।
বিচ্ছিন্ন যৌগগুলোর মধ্যে রয়েছে চ্যাবামাইডস, পিপারিন, পিপ্লারটাইন, রেট্রোফ্র্যাক্টামাইডস এ/বি, মিথাইলেনডিওক্সিফেনাইল-নোনা-২ই, ৪ই, ৮ই-ট্রাইনোইক অ্যাসিড, এন-বুটাইল বা এন-পেন্টাইল অ্যামাইন, পাইপারলংগুমিনিন, পাইপরোনালাইন, ডিহাইড্রোপিপারিন, এন-বিউটিন ২ই ও ৪ই, অক্টাডেক্যাডিয়েনামাইড আর এন-আইসোবিউটাইল ইকোস্যাট্রিয়েনামাইড। বিভিন্ন পরীক্ষাপদ্ধতিতে গুরুত্বপূর্ণ জৈবিক উপাদান থাকায় স্বাস্থ্যের গুরুত্ব নিয়ে এর প্রভাব নথিভুক্ত করেছে।
অ্যাজমা ও ব্রঙ্কাইটিস রোগের ওষুধ হিসেবে: অ্যাজমা ও ব্রঙ্কাইটিস রোগের ওষুধ হিসেবে কাজ করে। ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকজনিত রোগপ্রতিরোধে চুইঝাল বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকজনিত রোগপ্রতিরোধে সাহায্য করে। মরিচের বিকল্প হিসেবে চুইঝালের ভেষজ গুণ থাকার কারণে অনেক রোগব্যাধির আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
চুইঝালের ভেষজ উপাদানের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে আইসোফ্লাভোন ও অ্যালকালয়েড নামের ফাইটোকেমিক্যাল রয়েছে, যা অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে এবং ক্যানসার প্রতিরোধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে ক্যানসার হওয়ার আগে শরীরে যে টিউমার হয়ে থাকে, সেই টিউমারের বৃদ্ধি প্রতিরোধ করতে পারে। চুইঝালে গুরুত্বপূর্ণ যৌগ হলো সেসামিন, যা টিউমারের বিকাশ ও অগ্রগতি কমানোর জন্য একটি কার্যকর সহায়ক থেরাপিউটিক এজেন্ট হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
দেহে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে এটি হৃদ্রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। বর্তমান সময়ে কার্ডিওভাসকুলার ডিজঅর্ডার, ইমিউন ডিজফাংশনের মতো রোগপ্রতিরোধে মানুষ প্রাকৃতিক খাদ্য উপাদানের প্রতি আগ্রহী হচ্ছে। উপরন্তু অসংখ্য রোগের চিকিৎসার জন্য ঔষধি গাছ থেকে প্রাপ্ত যৌগকে পরিপূরক খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করছে। এসবের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। আর খরচও কম।
প্রসব-পরবর্তী ব্যথা প্রশমনে ভালো কাজ করে চুইঝাল। সদ্য প্রসূতি মায়েদের শরীরের ব্যথা কমাতে চুইঝাল ম্যাজিকের মতো কাজ করে। এ ক্ষেত্রে চুইঝাল গরম পানিতে সেদ্ধ করে চায়ের মতো পান করা যায়।
পাকস্থলী ও অন্ত্রের প্রদাহ দূর করে। গ্যাস্ট্রিক ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। স্নায়বিক উত্তেজনা ও মানসিক অস্থিরতা প্রশমন করে। আমাদের শরীরের বিভিন্ন ধরনের ব্যথা দূর করে শরীর সতেজ রাখতে সহায়তা করে। এটি ঘুমের ওষুধ হিসেবে কাজ করে এবং শারীরিক দুর্বলতা কাটাতে সাহায্য করে।
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ভেষজ উপকরণ আদিতে যেভাবে ছিল, নানা কারণে তার কিছু রূপান্তর ঘটেছে। তবে চুইঝালে এখনো তেমন কিছু ঘটেনি। ফলে মাঝেমধ্যে চুইঝাল দিয়ে মাংস রান্না করে খাওয়া যেতে পারে।
অবশ্য কম লবণ ও মসলা ব্যবহার করে সঠিক উপায়ে রান্না করলে এর ঔষধি গুণ লাভ করা যাবে।