পোড়া ক্ষতের প্রাথমিক চিকিৎসার যে ধাপগুলো বাঁচাতে পারে প্রাণ
শেয়ার করুন
ফলো করুন

হাল ফ্যাশন ডেস্ক

অগ্নিকাণ্ডের সময় পোড়া ক্ষতের মাত্রা নিরূপণ ও প্রাথমিক চিকিৎসার সঠিক প্রয়োগ বাঁচিয়ে দিতে পারে নিজের ও আরও অনেকের প্রাণ। অথচ আমরা সে অর্থে জানিই না পোড়া ক্ষতে প্রাথমিক পর্যায়ে কীভাবে কী করতে হবে। তাৎক্ষণিকভাবে এ ক্ষেত্রে করণীয় বিষয়গুলো নিয়ে হাল ফ্যাশনের তরফ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছে সার্জারি বিশেষজ্ঞ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেনের কাছে। এই অভিজ্ঞ চিকিৎসক এ ব্যাপারে বেশ কিছু জরুরি পরামর্শ দিয়েছেন আমাদের পাঠকদের জন্য।

বার্ন বা পোড়া ক্ষত বলতে সাধারণত নিম্নলিখিত জিনিসগুলোর সংস্পর্শে আসার ফলে শরীরের বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ টিস্যু বা কলা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অবস্থা বোঝা

১. আগুনের শিখা
২. ফুটন্ত গরম পানি বা স্টিম (বাষ্প)
৩. ক্ষয় সাধনকারী রাসায়নিক পদার্থ (যেমন অ্যাসিড)
৪. বৈদ্যুতিক প্রবাহ
৫. রেডিয়েশন (সানবার্নও এর মধ্যে পড়ে)

পোড়া ক্ষতের প্রাথমিক চিকিৎসার প্রথম ধাপটিই হচ্ছে এর মাত্রা নিরূপণ করা। প্রথমেই খেয়াল করে দেখতে হবে যে ক্ষতটি মাইনর বার্ন বা মৃদু নাকি মেজর বার্ন বা গুরুতর। এর ওপরই নির্ভর করে প্রাথমিক চিকিৎসার পরবর্তী ধাপগুলো।  

বিজ্ঞাপন

মেজর বার্ন বা গুরুতর পোড়া ক্ষত

কিছু প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য দেখে দ্রুত মেজর বার্ন চেনা যায়।

১. ক্ষত গভীর হলে
২. ত্বক শুকনো, ব্যবহার্য চামড়ার সামগ্রীর মতো হয়ে গেলে
৩. ৩ ইঞ্চির বেশি বড় জায়গাজুড়ে ক্ষত হলে
৪. মুখমণ্ডল, হাত, পা, নিতম্ব, জেনিটাল অঙ্গ বা হাড়ের প্রধান জোড়গুলো, যেমন হাঁটু, কনুইজুড়ে পুড়ে গেলে
৫. পুড়ে ‘চারিং’ হয়ে গেলে অর্থাৎ কালো, বাদামি বা সাদা ছোপ ছোপ পড়ে গেলে

মাইনর বার্ন বা মৃদু পোড়া ক্ষত

মৃদু ক্ষত মানে কিন্তু অসাবধানতা বা অবহেলা করার মতো অবস্থা নয়। যথাযথ চিকিৎসার স্বার্থে কিছু লক্ষণ দেখে মাত্রা নির্ধারণ করা জরুরি বলেই একে মৃদু ক্ষত আখ্যা দেওয়া৷ এর বৈশিষ্ট্যগুলো হলো—

১.তিন ইঞ্চির বেশি কম ব্যাসের জায়গাজুড়ে ক্ষত
২. সান বার্নের মতো লাল হয়ে যাওয়া ত্বক
৩. ত্বকে ফোসকা পড়া
৪. ব্যথা বা জ্বলুনির অনুভূতি

বিজ্ঞাপন

মেজর বার্নের প্রাথমিক চিকিৎসা

যত দ্রুত সম্ভব ইমার্জেন্সি হাসপাতাল সেবা লাভের আগপর্যন্ত কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা করাই একমাত্র উপায় এ ক্ষেত্রে।

১. পুড়ে আহত ব্যক্তিকে সবার আগে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে হবে, যেখানে তিনি মুক্তভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারেন। তাপের উৎস থেকে দূরে, যথা সম্ভব শীতল স্থানে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।
২. বৈদ্যুতিক বার্ন হলে অবশ্যই সুইচ অফ করে তবেই স্পর্শ করা যাবে আহত ব্যক্তিকে।
৩. প্রথমেই পর্যবেক্ষণ করতে হবে যে আহত ব্যক্তি শ্বাস নিচ্ছেন কি না। যদি না নেন, তবে পদ্ধতি জানা থাকলে বা এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ থাকলে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে।


৪. আহত ব্যক্তির শরীর থেকে পোড়া ক্ষতের কাছাকাছি আছে এমন বেল্ট, অলংকার ইত্যাদি খুলে ফেলতে হবে। কারণ, পোড়া জায়গা দ্রুত ফুলে উঠতে থাকে।
৫. পোড়া ক্ষতটি খুলে রাখাই সমীচীন। ঢাকতে হলে পরিষ্কার ব্যান্ডেজ পরিষ্কার পানিতে ভিজিয়ে তা ব্যবহার করতে হবে এ ক্ষেত্রে।
৬. হাত বা পা পুড়ে গেলে পরিষ্কার, স্টেরাইল ও শুষ্ক ব্যান্ডেজ দিয়ে আঙুলগুলো আলাদা করে রাখতে হবে, যাতে পোড়া চামড়া পরস্পর লেগে না যায়।
৭. পোড়া স্থান থেকে কাপড় খুলে ফেলতে হবে। কিন্তু পোড়া ত্বকে কাপড় আটকে গেলে তা কোনোক্রমেই টানাটানি করা যাবে না।
৮. পোড়া ত্বক যতটা সম্ভব শীতল রাখার চেষ্টা করতে হবে। ঠান্ডা পরিষ্কার পানি ব্যবহার করা যায়। তবে শরীরের বড় অংশজুড়ে থার্ড ডিগ্রি গভীর বার্নের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া পানি ব্যবহার করা উচিত নয়।
৯. পোড়া অংশ হৃৎপিণ্ড থেকে কিছুটা উঁচুতে তুলে রাখলে ভালো।
১০. শক সিনড্রোমের লক্ষণ আছে কি না দেখতে হবে। খুব ধীরগতির শ্বাস-প্রশ্বাস, ত্বক একেবারে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া এবং জ্ঞান হারালে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে হাসপাতালে নিতে হবে।

মাইনর বার্নের প্রাথমিক চিকিৎসা

১. মাইনর বা মৃদু পোড়া ক্ষত ঘরেই চিকিৎসা করে সারিয়ে তোলা সম্ভব।
২. প্রথমেই ক্ষতিগ্রস্ত অংশ থেকে কাপড়, ঘড়ি, গয়না ইত্যাদি সরিয়ে ফেলতে হবে।
৩. আহত স্থানটি যত দ্রুত সম্ভব ঠান্ডা পানিতে চুবাতে হবে কিন্তু বরফশীতল নয়। অন্তত পাঁচ মিনিট চুবিয়ে রাখতে হবে। এ ছাড়া ঠান্ডা পানিতে ভেজা কাপড় চেপে রাখা যেতে পারে। কিন্তু আইসপ্যাক দেওয়া যাবে না।
৪. হালকা সাবান-পানিতে দিনে দু-তিনবার পোড়া জায়গাটি আলতোভাবে ধুয়ে নিতে হবে। এরপর আলগা করে পরিষ্কার সুতি কাপড়ে মুছে বা বাতাসে শুকিয়ে পেট্রোলিয়াম জেলি দিতে হবে। টুথপেস্ট বা মাখনের মতো কিছু লাগানো যাবে না।
৪. ক্ষতস্থানে নন-স্টিক ধরনের ব্যান্ডেজ দিয়ে ঢেকে রাখলে ও সপ্তাহে তিনবার তা বদলে নিলে ভালো। ফোসকা যাতে ফেটে না যায়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।  
৫. প্রয়োজন হলে ব্যথানাশক ওষুধ ও জীবাণুরোধী মলম লাগাতে হবে কিন্তু তা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী।


৬. পর্যাপ্ত তরল গ্রহণ করতে হবে, যাতে পানিশূন্যতা না হয়। রোদে না যাওয়া ভালো। ৪৮ ঘণ্টায় কোনো উন্নতি না হলে চিকিৎসককে দেখাতে হবে ক্ষত।
যা যা কোনোভাবেই করা যাবে না
১. পোড়া ক্ষত স্পর্শ করা, উন্মুক্ত রেখে রোগ-জীবাণুর সংস্পর্শে আসতে দেওয়া
২. চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ধরনের স্প্রে বা ক্রিমজাতীয় ওষুধ বা ঘরোয়া টোটকা ব্যবহার করা যাবে না; যেমন মাখন, নারকেল তেল ইত্যাদি।
৩. গুরুতর আহত ব্যক্তিকে কিছুই খেতে দেওয়া যাবে না
৪. শ্বসনতন্ত্র পুড়ে গেছে, এমন আশঙ্কা থাকলে কোনোক্রমেই বালিশসহকারে শুতে দেওয়া যাবে না আহত ব্যক্তিকে।

ছবি: পেকজেলস ডট কম

প্রকাশ: ০১ মার্চ ২০২৪, ০৯: ৩৫
বিজ্ঞাপন