এ মৌসুমে নগরীতে উৎসবের শেষ নেই। কিন্তু সেই একই রকম গান, নাটক, কেনাকাটা আর খাবারের উৎসবের ভিড়ে এই অস্থির জীবনে একটু ভালো থাকার আকুতি হারিয়ে যায়। সেই আহ্বানে ঢাকা ফ্লো–এর উদ্যোগে হয়ে গেল দুই দিনব্যাপী ফেস্টিভ্যাল অব ইয়োগা অ্যান্ড ওয়েলনেস। গুলশান সোসাইটি পার্কে ১১ ও ১২ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয় এই ব্যতিক্রমী আয়োজন। ভালো থাকার এই উৎসবের উদ্বোধন করেন ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম। বিভিন্ন লাইভ ফিটনেস অ্যাকটিভিটি, ইয়োগা, জুম্বা, অ্যারোবিকস, নাচ, মেডিটেশন, সংগীত থেরাপিসহ অনেক ভিন্ন ভিন্ন আয়োজন দেখা যায় এখানে। কর্মক্ষেত্রে সুস্থতা নিয়ে ওয়েলবিইং অ্যাট ওয়ার্ক, মেন্টাল ওয়েল বিইং, আয়ুর্বেদিক মূলমন্ত্র, পরিবেশের সঙ্গে মানুষের আণবিক পর্যায়ের সম্পর্ক নিয়ে গো গ্রিন ছিল আয়োজনে। এক্সট্রিম স্পোর্টস বক্সিংয়ের আয়োজনটি বেশ মনোযোগ আকর্ষণ করেছে সবার। আর ফিটনেস–সংক্রান্ত নানা কার্যকর পরামর্শ নিয়ে ছিল বিশেষজ্ঞদের ভিন্ন ভিন্ন প্যানেল ডিসকাশন।
এমন আয়োজনে খাবার আর উদ্যোক্তাদের পণ্য থাকবেই। সব মিলে এখানে ছিল ১১৬টি স্টল। উদ্যোক্তাদের ৮৫টি স্টলে বিভিন্ন পণ্যের দেখা পাওয়া যায়। দেশীয় পরিবেশবান্ধব ব্র্যান্ড অরণ্য পণ্য প্রদর্শনের পাশাপাশি দর্শনার্থীদের জন্য নিজে হাতে টাইডাই প্রশিক্ষণের আয়োজন রেখেছিল। বোহো, বেণি বুননের টোট ব্যাগ আর বোহো ব্যাগ কেনার জিন্য ভিড় লেগেই ছিল স্টলে। ইন্দুবালা আর আউল স্টুডিওতে ছিল সনাতন ডিজাইনের গয়না আর ফিউশন জুয়েলারির পসরা আর সেই সঙ্গে কর্ক দিয়ে স্টার ট্রেক বা মারভেল থিমে ফ্রেমিং করা উপহার পণ্য। আড়ং আর্থের পণ্যের স্টল ও আয়ুর্বেদিক বিশেষ কর্নারে বেজে যাচ্ছিল শ্রুতিমধুর মিউজিক। প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে সুস্থ থাকা, সৌন্দর্যের পণ্য ও সেবার ব্যবস্থা ছিল সেখানে।
এক পাশে ছিল শিশুদের জন্য দারুণ সব অ্যাকটিভিটির আয়োজন। নিজের হাতে রং দিয়ে ছবি আঁকা, বডি পেইন্টিং উপভোগ করেছে ছোটরা। ফরবেল প্লে স্কুল ঢাকার সৌজন্যে শিশুদের জন্য মজার অ্যাকটিভিটি কর্নারে দেখা যায় অভিভাবক ও শিশুদের ভিড়। বায়োস্কোপ, ক্যান্ডিফ্লস আর পপসিকেলসসহ বিনোদনের সব আয়োজন ছিল এদিন ছোটদের জন্য। বেসক্যাম্প বাংলাদেশের সৌজন্যে অ্যাকটিভিটি কর্নারে জুমারিং, র্যাপেলিং, আরচারি ও হ্যামকিংয়ের ব্যবস্থা ছিল ছোটদের জন্য।
এখানে নান্দনিক আসবাবের প্রতিষ্ঠান ‘বহু’–এর অন্দরসজ্জায় একটি কফি লাউঞ্জ ছিল দর্শনার্থীদের জন্য এবং এর পাশেই ছিল বুক কর্নার, যেখানে এসে দর্শনার্থীরা নিজেদের মতো সময় কাটিয়েছেন। গুলশান সোসাইটি পার্কের পুরো আয়োজন ঘুরে ক্লান্তি দূর করতে এখানে এসে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য কর্নারটি করা। কথা হয় বহু–এর স্বত্বাধিকারী স্থপতি নাবিলার সঙ্গে। তিনি বলেন, নগরজীবনের মধ্যে প্রশান্তির খোঁজে এমন একটি কর্নার সবার মন ভালো করবে নিশ্চয়ই। এখানে বইয়ের মোড়ক উন্মোচনসহ শিশুদের জন্য স্টোরি টেলিং আওয়ারের আয়োজন করা হয়।
অ্যাকটিভ ওয়্যারের আউটলেট তুরাগ, শি অ্যাকটিভ, নিউট্রেশন ডিপো আর দৌড়-এ দেখা যায় স্বাস্থ্যসচেতন মানুষের ভিড়। অ্যাপেক্সের আউটলেটে স্প্রিন্টের ওয়াকিং, রেগুলার ওয়্যার ও রানিং সুজ ছিল। লাইফস্টাইলের সঙ্গে সংযুক্ত সব পণ্য, পোষা প্রাণীদের জন্য পণ্য, প্ল্যান্ট অ্যাটায়ারের গাছ, ঘর সাজানোর সামগ্রীসহ সবকিছুর আয়োজন ছিল সেখানে।
মিষ্টিপ্রেমীদের জন্য সঞ্চয়িতায় দেখা গেল বাদামের লাড্ডু। এ ছাড়া ছিল কাঁচা হলুদের সালাদ। গ্রামচা-এর চায়ের দোকানে ছিল লম্বা লাইন। গানেশ্রী-এর ভিন্ন স্বাদের ডেজার্ট, যাত্রাবিরতির নারকেলের শরবত, ভাজাভুজি, স্ল্যাপার্সের জুসের স্টলে সারাক্ষণ ছিল ভিড়। ছয় ধরনের লেমনেড রিসাইকেলড কাচের বোতলে পরিবেশন করা হয়েছে এখানে। চাইলে যেটা বাসায় নিয়ে গিয়ে মানিপ্ল্যান্ট লাগানো যায়। আর ফিরিয়ে দিলে আবার রিসাইকেল করা হয়। হুমায়রা আলীর আহ্লাদি নামের একটি আচারের দোকান বেশ নজর কাড়ল, যারা যত্ন করে আচার বানিয়ে থাকে। পিৎজা ডি ওয়ালিতে দেখা গেল লাল আটার পিৎজা। ভিগানদের জন্য দারুণ সব আয়োজন দেখা যায় উৎসবজুড়ে।
মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ছিল বেশ কিছু কর্নার ও স্টল। হেলথ ইনস্যুরেন্স নিয়ে ছিল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল ফিটনেস সেশন, ইয়োগা, জুম্বা, অ্যারোবিকস, সেলফ ডিফেন্স ও নাচের আয়োজন। সব ধরনের ভালো থাকার উপায় নিয়ে মুখর ছিল সেশনগুলো।
দ্বিতীয় দিন শুরু হয় পাঁচ কিলোমিটার হারমনি রান দিয়ে। সহযোগিতায় ছিল পাঠাও। সেশনে ছিল প্রাচীন ইয়োগা, মর্নিং জেন মেডিটেশন , সিঙ্গিং সার্কেল, সোয়েট ইট আউট জুম্বা, কারডিও ব্লাস্ট ফিটনেস, হিলিং রিদম ড্যান্স, সুফি আধ্যাত্মিক নৃত্য আর মেডিটেশন। প্যানেল ডিসকাশনে দ্বিতীয় দিন মানসিক স্বাস্থ্য, আয়ুর্বেদিক, বক্সিং, ফিটনেস নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা হয়।
অ্যাম্পথিয়েটারে কনসার্টের মাধ্যমে আয়োজন শেষ হয়; যেখানে গান করেন আরমিন মুসা, বিটবক্স, শান্তসহ অনেকে। আকর্ষণীয় মেডিটেশন কর্নার ছিল প্রশান্তির জায়গা। আয়োজন শেষে ঢাকা ফ্লো–এর প্রতিষ্ঠাতা সাজিয়া ওমর ও আয়োজক তাহসিন চৌধুরী জানান, এ রকম একটা আয়োজনের পরিকল্পনা বহুদিনের। মানুষ সুস্থ থাকলে জীবন সুন্দর হবে। পড়ন্ত বয়সে এসে নিজেই নিজেকে সামলে নেবে, সমাজ সুন্দর হবে, মানুষের মধ্যে হৃদ্যতা বাড়বে, মন সুন্দর হবে—এমন প্রত্যয় নিয়ে ঢাকা ফ্লো–এর এই ভালো থাকার উৎসবের আয়োজন করা। নিঃসন্দেহে ঢাকা ফ্লো–এর এই উদ্যোগ বছরের অন্যতম সেরা উৎসব হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।