আপনার সব বন্ধু মিলে সামনের সাপ্তাহিক ছুটিতে ট্যুর প্ল্যান করলেন। এদিকে আপনি বুঝতে পারছেন, এই ছুটিতে পরিবারকে সময় দেওয়া খুব দরকার। কীভাবে বন্ধুদের না বলবেন? আজ হয়তো আপনার সহকর্মী কোনো কাজে সহায়তা চাইছেন, যা অনেক সময়সাপেক্ষ। কিন্তু আজ নিজের কাজ শেষ করার মতো যথেষ্ট সময়ও আপনার হাতে নেই। কীভাবে সহকর্মীকে না বলবেন? আবার আপনার খালাতো বোন হয়তো সব সময় সবার সামনে আপনাকে কটাক্ষ করে কথা বলে।
আপনি সম্পর্কে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার ভয়ে কোনো প্রতিবাদ করেন না; কিন্তু এ জন্য আপনি প্রচণ্ড চাপ অনুভব করেন। আমরা সবাই প্রতিদিনের জীবনে এরকম নানা বিষয়ের মুখোমুখি হই। তবে মজার বিষয় হলো, না বলার পরিবর্তে উল্টো অন্যের হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলিয়ে আমরা নিজের জন্য মানসিক চাপ তৈরি করি।
চলুন প্রথমে জেনে নেই কেন আমরা ‘না’ বলতে পারি না।
১. আমরা অন্যদের মনে কষ্ট দিতে চাই না।
২. আমরা সবাইকে খুশি রাখতে চাই।
৩. আমরা মনে করি, নিজের কষ্ট হলেও কোনোরকম সামলে নেব।
৪. অনেক ক্ষেত্রে নিজের সক্ষমতা প্রমাণ করার জন্যও আমরা না বলি না।
৫. অপরাধবোধ অনুভব করেও অনেক সময় আমরা না বলি না।
উপরোক্ত সব ক্ষেত্রে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে, আমি নিজে ভালো না থাকলে আমার আশপাশে কাউকে ভালো রাখতে পারব না। তা ছাড়া সবাইকে একসঙ্গে খুশি রাখা অসম্ভব এবং সবাইকে খুশি রাখা আপনার একার দায়িত্বও নয়। নিজেকে অন্যের কাছে সব সময় প্রমাণ করার চাপও ভীষণ অহেতুক। আপনার ক্ষমতা সম্পর্কে আপনি অবগত বা আত্মবিশ্বাসী থাকাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
চলুন, এবার জানা যাক কীভাবে রপ্ত করবেন ‘না’ বলার কায়দা।
১. শুরুতেই আপনি যে তাঁকে ও আপনাদের সম্পর্ককে যথার্থ মূল্যায়ন করেন, সেটি তাঁকে জানান।
যেমন বলতে পারেন, তোমাকে হেল্প করতে পারলে আমি অনেক খুশি হতাম বা আমার অনেক ভালো লাগত। তারপর বুঝিয়ে বলুন নিজের অপারগতার কথা।
২. খুব দৃঢ় কিন্তু ভদ্রভাবে আপনার অপারগতার কথা তাঁকে বুঝিয়ে বলুন। কথাগুলো বলার সময় স্পষ্টভাবে চোখে চোখ রেখে, স্বাভাবিক স্বর বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। আপনার মুখভঙ্গিতে যেন কোনো রাগ বা বিরক্তি না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখুন। ভদ্র, সুন্দর ও সাবলীলভাবে না বলতে পারলে তিনিও আপনার পরিস্থিতি সহজে বুঝতে পারবেন।
৩. আপনার অপারগতা, সীমাবদ্ধতা কিংবা প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে বলুন। আপনার দিকের কাজের চাপ, সময়স্বল্পতা কিংবা সমস্যা খুলে বলুন।
৪. ক্ষমা চাওয়ার বা অজুহাত দেওয়ার দরকার নেই। এখানে অপরাধবোধ অনুভব করার কিছু নেই; কারণ, সব সময় সবকিছুতে আপনার হ্যাঁ বলার মতো অবস্থা না–ও থাকতে পারে। নিজেকে এ বিষয়টি বুঝিয়ে বলুন, তাহলেই কথা বলার অহেতুক জড়তা অনুভব করবেন না। কাউকে কোনো প্রসঙ্গে না বলতে চাইলে তাঁকে সরাসরি নিজের ব্যস্ততা ও সীমাবদ্ধতার কথা খুলে বলাই শ্রেয়।
৫. মনে করিয়ে দিন আপনি তার সাফল্য কামনা করছেন। কথার শেষে বলতে পারেন—আশা করি, তুমি কাজটি ঠিকঠাক করে ফেলবে! তোমার জন্য অসংখ্য শুভকামনা!
৬. নিশ্চিত না হলে একটু সময় নিয়ে তারপর আপনার সিদ্ধান্ত জানান। তড়িঘড়ি করে হ্যাঁ বা না বলে ফেলার চাইতে একটু সময় নিয়ে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত জানানো ভালো।
চলুন, এবার না বলার কিছু বাস্তব উদাহরণ আমরা দেখি।
১. আমি তো এখন বেশ ব্যস্ত, তাই সময় দিতে পারছি না। পরের বার নিশ্চয়ই তোমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করব।
২. দুঃখিত, এই মুহূর্তে আসলে এ কাজটা আমার জন্য করা কঠিন। অন্য কোনো সাহায্য করতে পারি কি না, আমাকে জানিও প্লিজ।
৩. এটি খুব সুন্দর এক উদ্যোগ। দুঃখজনকভাবে আমার হাতে এখন যথেষ্ট সময় নেই, তাই সেভাবে সাহায্য করতে পারছি না। তবে আশা করি, ভবিষ্যতে আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পারব। তোমার জন্য অনেক শুভকামনা!
৪. আসলে আগামীকাল বিকেলে আমি অন্য কাজে কথা দিয়ে ফেলেছি। তোমার ওখানে যেতে পারছি না বলে আমি সত্যিই দুঃখিত। পরের বার নিশ্চয়ই আমাদের দেখা হবে!
৫. আমি নিজেও অনেক খুশি হতাম তোমার জন্য কিছু করতে পারলে। কিন্তু আসলে এটা আমার সাধ্যের বাইরে।
৬. তুমি যে তোমার খুব কাছের একজন মনে করে আমার কাছে সাহায্য চেয়েছ, এতে সত্যিই আমি কৃতজ্ঞ; কিন্তু আমার আসলে এ ধরনের কাজের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তাই এ বিষয়ে একদমই সাহায্য করতে পারছি না!
আশা করছি, এই লেখা পড়ে আপনি রোজকার জীবনে না বলার অভ্যাস শুরু করতে পারবেন। মনে রাখুন, যা আপনি মন থেকে করতে চাইছেন না, যা করবার মতো সময় বা সুযোগ আপনার এখন নেই, সেই কাজগুলো ভদ্রতার কারণে, লোকলজ্জার ভয়ে বা অন্য কোনো কারণে হাতে নিলে মানসিক চাপে ভুগতে হবে আপনাকেই। জীবন হয়ে উঠবে জটিল। তাই বুঝতে শিখুন কখন, কোথায়, কীভাবে না বলতে হবে!
লেখক: সাইকোসোশ্যাল কাউন্সেলর, মনের বন্ধু
ছবি: পেকজেলস ডট কম
হিরো ইমেজ: হাল ফ্যাশন