সুপারফুড পরাগ বড়ি
শেয়ার করুন
ফলো করুন

মৌমাছির সঙ্গে মানুষের মধুর সম্পর্ক প্রায় আট হাজার বছরের। সেই নব্যপ্রস্তরযুগ থেকে। তখন থেকেই মানুষ মধু ও মোমের জন্য এই ক্ষুদ্র প্রাণীর ওপর নির্ভরশীল। ষোড়শ শতকের আগে চিনি সহজলভ্য ছিল না, সেকালে খাবারদাবার মিষ্টি করতে প্রায় সব ক্ষেত্রেই মধুর ব্যবহার ছিল ব্যাপক। তবে কেবল মধু, রাজকীয় জেলি, মোম ও প্রপলিসের জন্য প্রাচীন গ্রিক পুরাণে মৌমাছিকে ‘ঈশ্বরের দূত’ আখ্যা দেওয়া হয়নি। মানুষ আরেকটি চমৎকার পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ সম্পূরক খাবার মৌমাছির কল্যাণে পেয়ে থাকে, তাহলো ‘পরাগ বড়ি’।

মৌমাছির তৈরি পরাগ বড়ি হচ্ছে ফুলের পরাগ, পানি, মৌ-রস, এনজাইম, মধু ও মোমের প্রাকৃতিক মিশ্রণ
মৌমাছির তৈরি পরাগ বড়ি হচ্ছে ফুলের পরাগ, পানি, মৌ-রস, এনজাইম, মধু ও মোমের প্রাকৃতিক মিশ্রণ
ছবি: লেখক

ফুলে ফুলে মৌ-রস সংগ্রহের সময় মৌমাছি পরাগায়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে থাকে। তখন এর সারা শরীরে ফুলের পরাগরেণু জড়িয়ে যায়। মৌমাছি তা এক জায়গায় জড়ো করে একটি ক্ষুদ্র দলা বা বড়ি বানিয়ে জমা করে। এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বড়িগুলো হচ্ছে মৌমাছি সংগৃহীত ‘পরাগ বড়ি’। ফুলের পরাগরেণু, মৌ-রস, পানি, এনজাইম, মধু ও মোমের প্রাকৃতিক মিশ্রণ হচ্ছে পরাগ বড়ি। প্রোটিনসহ পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ এমন পরাগরেণুর বড়ি মৌমাছিরা তাদের লার্ভার খাবার হিসেবে ব্যবহার করে।

বিজ্ঞাপন

শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য পুষ্টিবিদেরা আমাদের প্রতিদিনের খাবারের সঙ্গে অল্প পরিমাণে পরাগ বড়ি খেতে বলেন। কারণ, এতে আছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, আঁশ ও বেশ কিছু অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিডের প্রোটিন। আছে শর্করা, লিপিড, প্রোবায়োটিক, প্রচুর ভিটামিন এ, বি (বি১, বি২, বি৩, বি৫, বি৬, বি৭, বি৮,বি৯, বি১২ বা ফলিক অ্যাসিড) সি, ই, প্রোভিটামিন এ, ফাইটোস্টেরল, খনিজ ও ট্রেস উপাদান (ক্যালসিয়াম, আয়রন, ক্লোরিন, কপার, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সেলেনিয়াম)। এ কারণেই অনেকেই পরাগ বড়িকে ‘সুপারফুড’ আখ্যা দিতে দ্বিধা করছেন না।

বিজ্ঞাপন

কেন খাবেন?

মৌমাছি পরাগরেণু এক জায়গায় জড়ো করে একটি দলা বা বড়ি বানিয়ে জমা করে
মৌমাছি পরাগরেণু এক জায়গায় জড়ো করে একটি দলা বা বড়ি বানিয়ে জমা করে
ছবি: লেখকের সংগৃহীত

অ্যালার্জি থেকে মুক্তি পেতে
অনেকেই মৌসুমি অ্যালার্জিতে বেশ ভোগেন। বিভিন্ন পরাগরেণু এমন অ্যালার্জির জন্য দায়ী। সে ক্ষেত্রে পরাগ বড়ি খেলে তা শরীরের প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করবে এবং তখন এমন অ্যালার্জি হ্রাস পাবে বা নিয়ন্ত্রণে আসবে। (সূত্র: জার্নাল অব মেডিকেল সায়েন্স, ২০০৮)।

হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি কমায়
রক্তে ক্ষতিকর (এলডিএল) কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে হৃদ্‌রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। বিজ্ঞানীরা পশুর ওপর প্রয়োগ করে আশাপ্রদ ফল পেয়েছেন। (সূত্র: নিউট্রিয়েন্টস ২০১৭; মলিকুলস ২০১৮)।

যকৃতের যত্নে
যকৃতের সুরক্ষায় খুব ভালো কাজ করে। বিশেষ করে, যাঁরা মাদক ও অ্যালকোহল আসক্ত হয়ে যকৃতের ক্ষতি করেছেন, তাঁদের যকৃত সারিয়ে তুলতে পরাগ বড়ি বেশ কার্যকর। (সূত্র: এভিডেন্স-বেসড কমপ্লিমেন্টারি অ্যান্ড অলটারনেটিভ মেডিসিন, ২০১৩)

শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য পুষ্টিবিদেরা আমাদের প্রতিদিনের খাবারের সঙ্গে অল্প পরিমাণে পরাগ বড়ি খেতে বলেন
শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য পুষ্টিবিদেরা আমাদের প্রতিদিনের খাবারের সঙ্গে অল্প পরিমাণে পরাগ বড়ি খেতে বলেন
ছবি: পেকজেলসডটকম

হাড়ের স্বাস্থ্য ভালো রাখে
ক্যালসিয়ামের অভাবজনিত একটা রোগ অস্টিওপোরোসিস নিরাময়ে মৌমাছির এই পরাগ বড়ি বেশ ফলপ্রদ। গবেষক-চিকিৎসকেরা ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে ক্যালসিয়াম ও ফসফেটের মাত্রা বাড়িয়ে হাড়ের ক্ষয় হ্রাসে সুফল পেয়েছেন।

ত্বকের উজ্জ্বলতা ও ওজন কমাতে
ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়, ত্বকের উজ্জ্বলতা ও লাবণ্য বাড়িয়ে তারুণ্য ধরে রাখে। ক্ষুধানাশক ও অতিরিক্ত খাওয়ার ইচ্ছাকে কমিয়ে দেয়। এতে থাকা আঁশ কোষ্ঠ পরিষ্কার করে অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। ব্রণ, বাত, হাঁপানি, একজিমা ইত্যাদিতে পরাগ বড়িকে অব্যর্থ বলা না গেলেও, নির্দ্বিধায় উপকারী বলা চলে এবং এ ছাড়া ক্লান্তি দূর করে, দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে, বিষণ্নতা দূর করে, মনকে প্রফুল্ল রাখে। পানি, চা, ফলের রসের সঙ্গে মিশিয়ে বা এমনি খালি খাওয়া যেতে পারে। স্বাদ হালকা মিষ্টি বা একটু টক-মিষ্টি হতে পারে। আসলে স্বাদনির্ভর করে পরাগরেণুর উৎসের ওপর।

গ্রিক পুরাণে মৌমাছিকে ‘ঈশ্বরের দূত’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল
গ্রিক পুরাণে মৌমাছিকে ‘ঈশ্বরের দূত’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল
ছবি: দারা স্ট্যানলি

সতর্কতা এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
পরাগ বড়ি অ্যালার্জি উপশমে কাজ করলেও তা কারও কারও জন্য অ্যালার্জির কারণ হতে পারে। তাই শুরুতে দিনে এক চা–চামচের চার ভাগের এক ভাগ খেয়ে দেখতে হবে। অ্যালার্জি বা অন্য কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না হলে প্রতিদিন একটু একটু করে পরিমাণ বাড়ানো যেতে পারে। তবে তা কখনোই দিনে দুই টেবিল চামচের বেশি না হওয়াই ভালো।

নিরাপত্তার জন্য এক বছরের কম বয়সী শিশু, গর্ভবতী ও বুকের দুধ খাওয়ান—এমন মহিলাদের মৌমাছির তৈরি পরাগরেণুর এমন বড়ি খাওয়া উচিত হবে না। যেকোনো সম্পূরক পুষ্টিগুণের খাবার খেতে চাইলে পুষ্টিবিদ বা চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত হবে।

সংরক্ষণ

তাজা পরাগ বড়ি সংরক্ষণ করতে হবে ডিপ ফ্রিজে
তাজা পরাগ বড়ি সংরক্ষণ করতে হবে ডিপ ফ্রিজে
ছবি: লেখক

সদ্য সংগৃহীত পরাগ ডিপ ফ্রিজে রাখতে হবে। আর যেসব পরাগ বিশেষ উপায়ে প্রক্রিয়াজাত করা হয়েছে, সেগুলো কৌটায় বা কাচের বয়ামে আলো আর উষ্ণতা থেকে দূরে রাখতে হবে। খুব ভালো হয় ফ্রিজে সংরক্ষণ করলে।

লেখক: ফ্রান্সপ্রবাসী

হিরো ইমেজ: পেকজেলসডটকম

প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০২৩, ০৬: ০০
বিজ্ঞাপন