মানসিক সমস্যায়ও প্রয়োজন প্রাথমিক চিকিৎসা
শেয়ার করুন
ফলো করুন

‘ফার্স্ট এইড’ শব্দ দুটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণত ফিজিক্যাল ফার্স্ট এইডের ব্যাপারটা আমাদের মনে প্রথমে আসে। হঠাৎ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে অথবা কোনো দুর্ঘটনায় আহত হলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে ফিজিক্যাল ফার্স্ট এইড দেওয়া হয়। শরীর ও মন উভয় নিয়েই যেহেতু আমরা মানুষ, সেহেতু ফিজিক্যাল ফার্স্ট এইডের পাশাপাশি সাইকোলজিক্যাল ফার্স্ট এইডও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

হঠাৎ অসুস্থতা বা দুর্ঘটনার কারণে মানুষ যে রকম শারীরিক যন্ত্রণায় ভোগে, ঠিক তেমনি অন্য কোনো ঘটনার কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেও মানুষ তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় ভোগে। তাই শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা প্রাথমিকভাবে উপশম করার জন্য ভুক্তভোগীকে ফিজিক্যাল ফার্স্ট এইডের পাশাপাশি সাইকোলজিক্যাল ফার্স্ট এইড দেওয়াও জরুরি। কোনো ব্যক্তি হঠাৎ করে অনেক বেশি মানসিক চাপ অনুভব করলে, নেতিবাচক কোনো ঘটনা বা অভিজ্ঞতার কারণে গভীর মানসিক আঘাত পেলে, প্রাকৃতিক বা মনুষ্যসৃষ্ট কোনো দুর্যোগের কারণে কারও স্বাভাবিক জীবন এলোমেলো হয়ে গেলে অথবা কারও মধ্যে হঠাৎ করে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাজনিত লক্ষণ দেখা দিলে তাঁদের সাইকোলজিক্যাল ফার্স্ট এইড দেওয়া যেতে পারে। সাধারণত যেকোনো ধরনের বিপর্যয়মূলক ঘটনা ঘটার পরপরই সাইকোলজিক্যাল ফার্স্ট এইড দেওয়া হয়।

বিজ্ঞাপন

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ব্যক্তির মর্যাদাবোধ, সংস্কৃতি ও সামর্থ্যের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে বিপর্যস্ত ব্যক্তিকে মানসিক সহায়তা দেওয়া এবং সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে বাস্তবসম্মত সহযোগিতা প্রদান করাকেই সাইকোলজিক্যাল ফার্স্ট এইড বলে। শুধু পেশাদার ব্যক্তিরা নন, বরং সাধারণ যে কেউ সাইকোলজিক্যাল ফার্স্ট এইড দিতে পারেন, যদি এ সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান ও দক্ষতা থাকে। বন্যা, ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ডসহ অন্যান্য দুর্যোগ ও দুর্ঘটনার সময় দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের উদ্ধার, আশ্রয় দেওয়া, খাবার দেওয়া, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া এবং আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা সাহায্য করার চেষ্টা করে থাকি।

তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা এলোমেলোভাবে সাহায্য করে থাকি। তাই সাইকোলজিক্যাল ফার্স্ট এইড সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা থাকলে দুর্যোগের সময় আরও সুশৃঙ্খল ও কার্যকরভাবে বিপর্যস্ত শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, পরিবারের বয়স্ক সদস্য, প্রতিবেশী ও বন্ধুবান্ধবকে সাহায্য করা সম্ভব।

নেতিবাচক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাওয়ার কারণে ব্যক্তির মধ্যে পরবর্তী সময়ে যাতে কোনো ধরনের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা না দেয়, সেটার আগাম প্রতিরোধক ব্যবস্থা হিসেবে এবং হঠাৎ পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে সাইকোলজিক্যাল ফার্স্ট এইড দেওয়া হয়।

তবে মনে রাখতে হবে, নেতিবাচক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেলেই যে সবার সাইকোলজিক্যাল ফার্স্ট এইড দরকার হবে, বিষয়টা এমন নয়; কারণ, অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর সক্ষমতা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা একেক মানুষের একেক রকম। তাই মূলত সেবা গ্রহণকারীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করেই সাইকোলজিক্যাল ফার্স্ট এইড দেওয়া হয়। জোরপূর্বক কিংবা অনধিকারচর্চার মাধ্যমে সাইকোলজিক্যাল ফার্স্ট এইড দেওয়ার নিয়ম নেই।  

বিজ্ঞাপন

সাইকোলজিক্যাল ফার্স্ট এইড দেওয়ার ধাপ

১. সেবা দানকারীকে বিপর্যয়মূলক ঘটনা, ঘটনাস্থলের আশপাশে বিদ্যমান সেবাসমূহ এবং ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত নিরাপত্তাজনিত বিষয়গুলো সম্পর্কে প্রথমে পরিষ্কার ধারণা নিতে হবে।

২. ব্যক্তির উদ্বিগ্নতার ধরন ও কারণগুলো বোঝার চেষ্টা করতে হবে।

৩. পরিস্থিতি অনুসারে ব্যক্তির তাৎক্ষণিক চাহিদা ও প্রয়োজনগুলো নির্ধারণ করতে হবে।

৪.  গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনগুলো সবচেয়ে আগে মেটাতে যথাসাধ্য সাহায্য করতে হবে।

৫. পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাস্তবসম্মত সেবা ও সহায়তা প্রদান করতে হবে।

৬. গভীর মনোযোগ দিয়ে ব্যক্তির কথা শুনতে হবে কিন্তু কথা বলার জন্য কোনোভাবেই চাপ সৃষ্টি করা যাবে না।

৭. মানসিকভাবে আরাম দেওয়া, স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে ও শান্ত হতে সাহায্য করতে হবে।

৮. ব্যক্তির বর্তমান নিরাপত্তার পাশাপাশি পরে যাতে কোনো ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন না হন, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

৯. ব্যক্তিকে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করতে হবে, আশপাশের সেবাকেন্দ্র ও সামাজিক সাপোর্ট সিস্টেমের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে হবে।  

সাইকোলজিক্যাল ফার্স্ট এইড দেওয়ার সময় যেসব বিষয় অনুসরণ করতে হবে—

১. সেবা গ্রহণকারীর প্রতি সৎ ও বিশ্বস্ত হতে হবে।

২. ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে।

৩. যত্নশীল ও বন্ধুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি দেখাতে হবে।

৪. সেবা গ্রহণকারীর লিঙ্গ, বয়স ও সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মানসিক সহায়তা দিতে হবে।

৫. সেবা প্রদানকারীকে তাঁর নিজের বিশ্বাস, পূর্বধারণা, পক্ষপাতিত্বমূলক মনোভাব এবং মূল্যবোধ সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন হবে, যাতে তিনি এগুলো কোনোভাবেই সেবা গ্রহণকারীর ওপর চাপিয়ে না দেন।    

সাইকোলজিক্যাল ফার্স্ট এইড দেওয়ার সময় যেসব বিষয় এড়িয়ে চলতে হবে—

১. নেতিবাচক যে ঘটনা বা অভিজ্ঞতা ব্যক্তিকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করেছে, সে ঘটনা বা অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার জন্য উৎসাহিত করা যাবে না এবং বিশ্লেষণমূলক ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া যাবে না; কারণ, এর ফলে ব্যক্তি আরও বেশি বিপর্যস্ত অনুভব করতে পারেন।

২. নেতিবাচক ঘটনা বা অভিজ্ঞতার পর ব্যক্তির অনুভূতি ও প্রতিক্রিয়া কী রকম ছিল, সেটা বলার জন্য ব্যক্তিকে কোনোভাবেই চাপ দেওয়া যাবে না। তবে ব্যক্তি যদি নিজ থেকেই তাঁর অনুভূতি ও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে চান, তাহলে মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে।

৩. কোনো ধরনের ভুল তথ্য ও অবাস্তব ভরসা দেওয়া যাবে না।  

৪. কোনো কিছুই অতিরঞ্জিতভাবে উপস্থাপন করা যাবে না।

৫. বিপর্যস্ত ব্যক্তির দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে পরবর্তী সময়ে কোনো ধরনের সুবিধা নেওয়া যাবে না।

৬. ব্যক্তি যা প্রকাশ করবেন, সবই গোপন রাখতে হবে। তবে ব্যক্তির নিজের জন্য ক্ষতিকর বা অপরের জন্য ক্ষতিকর, এমন কোনো বিষয় থাকলে সেগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে।

৭. ব্যক্তির অনুভূতি ও আচরণকে কোনোভাবেই ভালো-মন্দ মাপকাঠিতে বিচার করা যাবে না।

লেখক: ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ও পলিটিক্যাল সাইকোলজিতে বিশেষজ্ঞ

ছবি: পেকজেলসডটকম

প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০২৩, ১৩: ০০
বিজ্ঞাপন