‘তুই মানসিকভাবে দুর্বল নাকি?’, ‘আরে ছেলেদের আবার কি মন খারাপ!’, ‘ছেলে হয়ে কাঁদছ কেন?’—সমাজে অহরহ পুরুষের প্রতি ছুড়ে দেওয়া এসব কথাই কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরে ফেলতে পারে নেতিবাচক প্রভাব। মানসিক স্বাস্থ্য বরাবরই আমাদের সমাজে উপেক্ষিত বিষয়। আর তা যদি হয় পুরুষের, তবে তা যেন আরও বেশি উড়িয়ে দেওয়ার বিষয়।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যেখানে পুরুষকে ভাবা হয় সাহস ও শক্তির প্রতিচ্ছবি, সেখানে তাঁর মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয় মানেই যেন পুরুষের দুর্বলতা। অথচ দুঃখ, কষ্ট, হতাশার বিষয়গুলো খুবই প্রাকৃতিক। এখানে নারী বা পুরুষ বিবেচনার কোনো জায়গা নেই। তা সত্ত্বেও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলতে পুরুষদের থাকে প্রচুর সংকোচ।
পুরুষের ওপর সমাজের একটি অদৃশ্য প্রত্যাশার চাপ অনেকেই অনুভব করেন। এ ছাড়া সমাজের তৈরি প্রথাগত লিঙ্গভিত্তিক ভূমিকা পালনের বিষয়টিও অস্বীকার করা যাবে না। পুরুষের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কম কথা বলার অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এই দুটি বিষয়কে। জানান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকো–সোশ্যাল কাউন্সিলর অ্যানি বাড়ৈ।
স্টেরিওটাইপ মানসিকতা ও প্রত্যাশার চাপ পুরুষদের মানসিক সমস্যায় সাহায্য চাওয়া বা আবেগের বিষয় নিয়ে কথা বলাকে কঠিন করে তোলে।
সম্প্রতি একটি গবেষণায় দেখা গেছে ৪০ শতাংশ পুরুষ তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কোনো দিনও কথা বা আলোচনা করেননি। সেখানে ২৯ শতাংশ পুরুষ বলেন, তাঁরা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলতে খুবই বিব্রত বোধ করেন। ২০ শতাংশ পুরুষ এ বিষয়ে নেতিবাচক ‘স্টিগমা’র কারণে কথা বলেন না। সাহায্যের দরকার তা স্বীকার করতে চান না বলে ১৭ শতাংশ পুরুষ মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলেন না। আর ১৬ শতাংশ পুরুষ নিজেকে দুর্বল বলে প্রকাশ করতে চান বলে এ বিষয়ে কথা বলতে নারাজ।
নাদিয়া নাসরিনও একজন সাইকো–সোশ্যাল কাউন্সিলর হিসেবে কাজ করছেন মানসিক স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ‘মনের বন্ধু’তে। প্রতিনিয়তই নারী ও পুরুষদের যেকোনো মানসিক সমস্যায় বিভিন্ন পরামর্শ দিতে হয় তাঁকে। আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবসে পুরুষদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে।
নাদিয়া নাসরিন জানান, মানসিক সমস্যা নিয়ে যেসব পুরুষ কাউন্সেলিংয়ের জন্য ফোন করেন, তাঁদের বেশির ভাগ সমস্যাই সম্পর্কজনিত হয়ে থাকে। বিবাহিত পুরুষেরা পরিবারকে সময় দিতে না পারা এবং এ নিয়ে নানা রকম মানসিক জটিলতায় থাকেন। স্ত্রীকে কম সময় দেওয়ায় সম্পর্কে তৈরি হওয়া টানপোড়েন পুরুষদের মধ্যে নানা ধরনের মানসিক সমস্যা তৈরি করে। আবার স্ত্রী নিজের কাজকে বা বন্ধুদের বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন, এমন উপলব্ধি থেকেও হতাশা তৈরি হয়। এ ছাড়া অবিবাহিত পুরুষদের ক্ষেত্রে বেশ কিছু দিন ধরে একটি সমস্যা খুব বেশি দেখতে পাচ্ছেন নাদিয়া নাসরিন। প্রেমিকার অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে গেছে বা বিয়ের কথা চলছে, এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই কাউন্সেলিংয়ের জন্য যোগাযোগ করেন। নাদিয়া নাসরিন জানান, বিষয়টি নিয়ে তাঁর কাছে ফোন করা অনেক পুরুষই খুব গুরুতর ডিপ্রেশনে আছেন। এ ছাড়া প্রেমিকার বাড়ি থেকে বিয়ের চাপ, নিজেকে স্বাবলম্বী করে বিয়ের তাড়া থেকেও হতাশা তৈরি হয়।
নাদিয়া নাসরিন আরও বলেন, গত দুই মাসে পুরুষদের দেওয়া কাউন্সেলিংয়ের মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ পুরুষকেই তিনি সম্পর্কজনিত কাউন্সেলিং দিয়েছেন। তিনি আরও জানান, নারীদের তুলনায় অনেক কমসংখ্যক পুরুষ মানসিক সমস্যায় কাউন্সেলিংয়ের জন্য যোগাযোগ করেন। সামাজিক স্টিগমা ও নিজের দুর্বলতা প্রকাশ পাবে—এমন ধারণাই এর অন্যতম কারণ।
নাদিয়া নাসরিন সম্পর্কজনিত সমস্যা সমাধানের জন্য কার্যকর যোগাযোগকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। আপনি কি চাচ্ছেন, সে বিষয়টি স্ত্রী বা প্রিয় মানুষকে জানানো খুব জরুরি। সে ক্ষেত্রে কথা বলার নেই বিকল্প। কারণ, আপনি না বললে নিজে থেকে বুঝে নেওয়াটা প্রায় অসম্ভব। এবারের আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবসের প্রতিপাদ্য ‘হেল্পিং মেন অ্যান্ড বয়েজ’ অর্থাৎ পুরুষ ও ছেলেদের পাশে দাঁড়ানো। আর এই সাহায্য সবচেয়ে বেশি দরকার তাদের পালনে।
পরিসংখ্যান: প্রায়রি গ্রুপ
মডেল: ইতমাম; ছবি: সাইফুল ইসলাম