হিরোশিমা দিবস ২০২৩: যে কারণে ওপেনহাইমার বম্বিংয়ের পর ‘গীতা’ পাঠ করেছিলেন
শেয়ার করুন
ফলো করুন

জাপানের চেরি ব্লসম উৎসবের জন্য যেমন উৎসুক হয়ে থাকে বিশ্ববাসী, তেমনি আজ ৬ আগস্ট হিরোশিমা দিবস উপলক্ষে জাপানের হিরোশিমায় ‘অ্যাটমিক বম্ব ডোম’কে ঘিরে জড়ো হওয়া শোকসন্তপ্ত জনতার সঙ্গে বিশ্ববাসীর মধ্যেও নেমে আসে শোকের ছায়া। আজকের এই দিবস বিশ্বজুড়ে পালিত হয় ইতিহাসের চরম দুর্ভাগ্যজনক একটি দিন হিসেবে। এদিন প্রাণ হারানো হতভাগ্য মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সারা বিশ্ব থেকে হাজার হাজার পর্যটক একত্র হন জাপানের হিরোশিমা শহরের পিস মেমোরিয়াল পার্কে।

শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মাতোইয়াসু নদীতে কাগজের লন্ঠন ভাসানো হচ্ছে
শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মাতোইয়াসু নদীতে কাগজের লন্ঠন ভাসানো হচ্ছে
ছবি: এএফপি

আজকের দিবসকে কেন্দ্র করে পার্কে সমাগত মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় দেড় মিলিয়নে। হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল পার্কটি জাপানি স্থপতি কেনজো টাঙ্গে দ্বারা পরিকল্পনা ও ডিজাইন করা হয়েছিল। প্রায় ১ লাখ ২২ হাজার ১০০ বর্গমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই পার্ক। এই পার্ক ঘিরে আছে পিস মেমোরিয়াল হল, মিউজিয়াম, অ্যাটমিক বম্ব ডোম, পিস ক্লক টাওয়ারসহ স্মৃতিবিজড়িত নানা স্থাপনা।

বিজ্ঞাপন

মাতোইয়াসু নদীর দুপাশজুড়ে পার্কের বিস্তৃতি। রয়েছে নানা স্মৃতিস্তম্ভ। তবে পার্কের দক্ষিণ পাশে ‘কেনবাকু ডোম’ বা ‘অ্যাটমিক বম্ব ডোম’ জাতিসংঘ থেকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের স্মারক হিসেবে স্বীকৃতি পায়। সে সময় পারমাণবিক বোমার আঘাতের পর ধ্বংসস্তূপে টিকে থাকা একমাত্র ভবন ছিল সেটি। পরবর্তীকালে জাপান সরকার ভবনটিকে এই ভয়ংকর বিপর্যয়ের স্মারক হিসেবে সেভাবেই সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়।
সম্প্রতি ‘ওপেনহাইমার’ মুভির বদৌলতে বিশ্বজুড়ে সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন ‘ফাদার অব দ্য অ্যাটমিক বম্ব’ রবার্ট জে ওপেনহাইমার।

 ‘ফাদার অব দ্য অ্যাটমিক বম্ব’ রবার্ট জে ওপেনহাইমার
‘ফাদার অব দ্য অ্যাটমিক বম্ব’ রবার্ট জে ওপেনহাইমার
ছবি: উইকিপিডিয়া

বিজ্ঞানের অসংখ্য ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ধাপ পেরিয়ে তাঁর নেতৃত্বে গঠিত একদল বিজ্ঞানীর দলগত প্রচেষ্টা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পারমাণবিক শক্তির ক্ষমতা এনে দেয়। কোনো ইতিবাচক কাজে তখন এর তেমন কোন প্রয়োগ লক্ষ করা না গেলেও গণহত্যা ও অভূতপূর্ব ধ্বংসযজ্ঞ করার জন্য এর প্রয়োগ পৃথিবীবাসী দেখেছে আজকের দিনে সেই ৭৮ বছর আগে। এর ফলে সৃষ্ট তেজষ্ক্রিয়তা জন্ম থেকে জন্মান্তরে বহন করতে হয়েছে বহু নির্দোষ সাধারণ মানুষকে। হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে দীর্ঘ কুড়ি বছর কোনো শস্য উৎপাদিত হয়নি, পারমাণবিক বিস্ফোরণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় বহু বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হয়েছে। বিকলাঙ্গ হয়ে যাঁরা বেঁচে ছিলেন, তাঁরা আজীবন মানসিক ও শারীরিক বিপর্যয় বয়ে চলেছেন।

বিজ্ঞাপন

সরকারি তথ্যমতে এই ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে প্রাণ হারান ১ লাখ ৪০ হাজার নিরীহ মানুষ। এর তিন দিন পরে নাগাসাকি শহরে আরও একটি নিউক্লিয়ার বোমা বিস্ফোরিত হয়, যেখানে প্রাণ হারান প্রায় ৮০ হাজার মানুষ। মানবতার এই বিপর্যয় মেনে নিয়ে জাপানের তৎকালীন সম্রাট হিরোহিতো আত্মসমর্পণ করেন এবং ইতিহাসিবিদদের মতে, সে সময় ৭ আগস্ট থেকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির সূচনা হয়। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে বর্তমান পিস পার্কে সংঘটিত হয়েছিল ইতিহাসের সর্বাধিক ধ্বংসাত্মক পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ।

নিউক্লিয়ার বোমা নিহতদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে জ্বালানো হয়েছে অগ্নিশিখা
নিউক্লিয়ার বোমা নিহতদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে জ্বালানো হয়েছে অগ্নিশিখা
ছবি: এএফপি

প্রতিবছর ৬ আগস্ট পিস মেমোরিয়াল পার্কে শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে আয়োজিত হয় শান্তি স্মারক অনুষ্ঠান। রাষ্ট্রপ্রধানের ভাষণ, ৮টা ১৫ মিনিটে এক মিনিট নীরবতা পালন আর সেনোটাফ সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করার মধ্যে দিয়ে লাখো শহীদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। আনন্দ-উৎসবের পাশাপাশি শোক ও বিপর্যয় নিয়েও মানুষের যাপিত জীবন। আগস্ট মাস এলেই তাই পুরো পৃথিবীবাসী এই দিবসকে স্মরণ করেন।

এখন এ প্রসঙ্গে যে তথ্য বেশ আলোচনায় উঠে এসেছে, তা হলো, ওপেনহাইমারের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আমেরিকান প্রমিথিউস’-এ বলা হয়েছে যে বোমা ফেলার পরপরই তিনি ‘গীতা’ থেকে শ্লোক পাঠ করেছিলেন। এর একটি চরণে বলা হয়েছে, ‘এখন আমিই মৃত্যু’। জানা যায়, রবার্ট ওপেনহাইমার খুব ভালো সংস্কৃত জানতেন। প্রায়ই ‘গীতা’ পড়তেন তিনি আর শ্লোক উদ্ধৃত করতেন।

পিস মেমোরিয়াল পার্কে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন সাধারণ মানুষ
পিস মেমোরিয়াল পার্কে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন সাধারণ মানুষ
ছবি: এএফপি

ত্রিশের দশকেই তিনি ‘গীতা’র প্রতি আগ্রহী হন। সংস্কৃতের অধ্যাপকদের কাছ থেকে নিষ্ঠাভরে এই ভাষা শিখেছিলেন তিনি। ‘ওপেনহাইমার’ মুভিতেও গীতাপাঠের দৃশ্য রয়েছে আর এ নিয়ে আপত্তিও উঠেছে ভারতীয় দর্শকদের তরফে। ওপেনহাইমার শুধু ‘গীতা’ নয়, কালিদাসের ‘মেঘদূত’ ও ‘বেদ’ও ভালোভাবে আয়ত্ত করেছিলেন বলে জানা যায়। আর বিভিন্ন সময় জীবনের বিভিন্ন ইতিবাচক ও নেতিবাচক পর্যায়ে এসব গ্রন্থ থেকে বিভিন্ন উক্তি শোনা গেছে তাঁর মুখে।

সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, হিস্ট্রি চ্যানেল

হিরো ইমেজ: এএফপি

প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২৩, ১২: ৪০
বিজ্ঞাপন