দুটো আলাদা জিনিসকে জুড়তে হলে বাঁধন লাগবে। সেটা আঠা হতে পারে, হতে পারে সুতা কিংবা দড়ি। এমনকি হতে পারে পেরেক অথবা প্রখর তাপ—ওয়েল্ডিং। মোটকথা, সইতে হবে। দড়ির খসখসে স্পর্শের অস্বস্তি, শুকনো আঠার চটচটে অনুভব, নিজের গহিনে তীক্ষ্ণ অথবা ভোঁতা গজালের যন্ত্রণা আর রক্তপাত—জুড়ে নেওয়ার, জুড়ে যাওয়ার অনির্বচনীয় স্বস্তির জন্য সইতে হবে প্রবিষ্ট পেরেকের চারপাশে নিজেকে ছড়িয়ে, সরিয়ে নতুন বিন্যাসের বিস্ময়মাখা বেদনা। অথবা সইতে হবে প্রচণ্ড তাপ, সেই তাপে গলে গলে যাওয়া, নিজের গলিত অস্তিত্বের দামে দুই থেকে এক হওয়া। এই ব্যথা সইতেই হবে। চুম্বকীয় আবেশ তো আর সবকিছুকে কাছে টানে না, যা–ও টানে, তা–ও একান্তই নৈকট্যনির্ভর, পারস্পরিক মিলনির্ভর। সুতরাং দুজন মানুষের মধ্যে চুম্বকের রসায়ন সব সময় কাজ করবে না।
দুজনের মধ্যে মিলের চেয়ে অমিল বেশি থাকবে, এটাই বাস্তবতা। আর নৈকট্য তো সাধনার ধন, পাশাপাশি একদম গায়ে গা লাগিয়ে থাকলেই যে কাছাকাছি থাকা হবে, ব্যাপারটা এমন নয়। দুই খণ্ড পাথরের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই ভৌগোলিক নৈকট্য মানেই কাছে থাকা। কিন্তু মানুষ তো পাথর নয়। পাশাপাশি থেকে কাছাকাছিতে উত্তরণের জন্য মানুষকে কিছু কাজ অবশ্যই করতে হয়, দিতে হয় শ্রম ও সময়।
এখানেই বন্ধনের কথা আসে। সম্পর্কের জন্য সুতা, দড়ি, আঠা, পেরেক, ঝালাই চাই–ই চাই। এখানেই আসে কম্প্রোমাইজ আর স্যাক্রিফাইসের কথা।
কম্প্রোমাইজ মানে ‘তোমার থাকুক, কিন্তু আমারও থাকতে হবে’। কম্প্রোমাইজ মানে মনে হওয়া যে ছাড় দেওয়া হলো বুঝি অনেক! আদতে দুই পক্ষেরই স্বার্থরক্ষা হলো, স্বস্তি পেল অহম। পাশাপাশি থাকার অনিবার্য যে ঘর্ষণজনিত অস্বস্তি, সেটি খানিকটা সহনীয় হলো। এটি খুবই ভালো জিনিস। কিন্তু এতে বেদনা নেই। এটি সেলাই করে না, পোড়ায় না, পেরেক বিঁধায় না, গলায় না,—তাই জোড়েও না।
কম্প্রোমাইজে সম্পর্ক সমান্তরাল হয়, পরস্পর মেশে না। স্যাক্রিফাইস বেদনা দেয়। নৈকট্যসন্ধানে নিজেকে বিনাশ করতে, পোড়াতে, গলাতে, বিদ্ধ করতে যন্ত্রণা তো হবেই।
স্যাক্রিফাইস প্রকৃতিবিরুদ্ধ, অস্তিত্বনাশী কিছুই প্রাণিজগতের জন্য প্রেসক্রাইব করে না প্রকৃতি।
প্রাণিজগতে সারভাইভাল শেষ কথা। সর্বাগ্রে নিজে বাঁচাই মূলমন্ত্র। কেবল মানুষই পারে এই টিকে থাকার আদিম তাগিদের ঊর্ধ্বে উঠে যেতে। কী এক অপরূপ অনুভবে অভুক্ত একজন মানুষই আরেকজনকে বলতে পারে, ‘আমার খিদে নেই, তুমি খাও!’
স্যাক্রিফাইস মানে, ‘তোমার আছে, বেশ তো থাকুক না! আরেকটু কী চাই? চাইলে না–ও, এই যে আমার কাছ থেকে নাও।’
নিজেকে বঞ্চিত করার এই যে প্রবণতা, দিন শেষে সব বঞ্চনার ঊর্ধ্বে এক অপরিসীম অর্জন। যেকোনো সম্পর্কের যন্ত্রপাতিকে সচল ও সক্রিয় রাখতে এ হলো লুব্রিকেন্ট।
প্রতিটি মানুষ তার ভেতরে তীব্র এক অস্তিত্বকে ধারণ করে, যার নাম অহম। সম্পর্কের মাঝখানে কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে এই অহমের ক্ষমতা অপরিমেয়। এই কাঁটা তুলে ফেলা কঠিন। স্যাক্রিফাইস বা ত্যাগ যে নামেই ডাকি, এই কাঁটার ক্ষমতাকে খর্ব করে, সম্পর্ককে করে বিষমুক্ত।
কাজটি অত্যন্ত কঠিন। কেননা ত্যাগের যা মূল কথা, নিজেকে তুচ্ছ করা, সে প্রক্রিয়ায় প্রথম আঘাত আসে অহমের ওপর। তীব্র যাতনা হয়। একটু মমতা, সহনশীলতার মলমের জন্য প্রাণ কাঁদে। না পেলে ভাটা পড়ে স্যাক্রিফাইসে, সদিচ্ছায়।
স্যাক্রিফাইস নামের এই জোড়ের জোর দ্বিপাক্ষিকতায়। এ বড়ই দুর্মূল্য। একতরফা হয় না, জুড়তে চাইলে পেরেকে বিঁধতে হবে দুই পক্ষকেই, ঝালাইয়ের যাতনায় গলে পড়তে হবে দুই তরফকেই।