জীবনের পথে চলতে গিয়ে কেউ কেউ খুব কাছে চলে আসে, বন্ধু হয়ে দীর্ঘদিন পাশে থাকে। আবার কেউ হয়ে যায় অত্যন্ত কাছের মানুষ। বন্ধুর থেকেও কিছু বেশি। কিন্তু সেই কাছের মানুষ, যাকে আমরা সঙ্গী হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি, সেই মানুষটির হাতে হাত রেখে পথচলা কঠিন হয়ে যায়, যদি সে হয় চরম স্বার্থপর।
শুরুতে এটি তেমনভাবে বোঝা না গেলেও যতই সময়ে বয়ে চলে, তার আচরণের কিছু দিক খুব প্রকটভাবে তার স্বার্থপরতার জানান দেবে। আপনার মনকে করে তুলবে বিষণ্ন এবং হতাশ। তবু আপনি অভ্যাসবশত সেই মানুষটির সঙ্গেই জড়িয়ে থাকবেন আর এই সম্পর্কের জগদ্দল ভার একাই টেনে চলবেন। কিন্তু কিছুটা সচেতনতা আর নিজের প্রতি ন্যূনতম সম্মানবোধ আপনার স্বার্থপর সঙ্গীকে চিনে নিতে সহায়তা করতে পারে।
শিক্ষাজীবন অথবা ক্যারিয়ার—যেকোনো প্ল্যাটফর্মেই আপনার অর্জন অথবা প্রাপ্তি তাদের তেমনভাবে আলোড়িত করে না। ইন্টার্নশিপ রিপোর্টে এ প্লাস পাওয়া অথবা অফিসে সেরা কর্মীর পুরস্কার পাওয়া—যেকোনো কিছুর প্রতিক্রিয়ায় ‘বাহ!’ অথবা ‘ভালো!’ এ রকম দায়সারা দু–একটি শব্দে তাদের আনন্দের বহিঃপ্রকাশ আপনার অর্জনের উচ্ছ্বাসকে মিইয়ে দেয়। কিন্তু আপনি ধরে নেন, মানুষটা বুঝি এমনই, মুখচোরা। খুশি হলেও সেভাবে প্রকাশ করে না। আসলে এখানে বিষয়টি হলো, স্পটলাইটে আপনার উপস্থিতি বা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আপনাকে অগ্রাধিকার দিতে তিনি অনাগ্রহী। সে জন্যই অল্প কথায় আপনার অর্জনের উদ্যাপনে সমাপ্তি আসে।
সম্পর্কটিকে সমৃদ্ধ করতে দুজনের পক্ষ থেকেই দেওয়া-নেওয়ার যে সমঝোতা গড়ে ওঠার কথা, এ ক্ষেত্রে তা হয়ে ওঠে না। কেননা, স্বার্থপর সঙ্গীটি তাদের নানা রকম দাবি-দাওয়া ও চাহিদা নিয়ে আপনার সঙ্গে থাকে। প্রিয় সংগীতশিল্পীর গানের অনুষ্ঠান আর গুরুত্বপূর্ণ অফিস কর্মকর্তা বা আত্মীয়ের বিবাহবার্ষিকী—এই দুইয়ের মধ্যে আপনাকে সেখানেই যেতে হবে, সেখানে আপনার সঙ্গীটি যেতে চায়। দু-একবার এর ব্যতিক্রম হয়ে থাকলে তারা দীর্ঘসময় সেই ব্যতিক্রমের দিনগুলো আপনাকে মনে করিয়ে দেবে এবং এমনভাবে মনে করিয়ে দেবে, যেন আপনি অপরাধবোধে জেরবার হয়ে যান।
কোথায় দেখা হবে, কোন দিন দেখা হবে, কখন কথা হবে—এক শর মধ্যে এক শটি ব্যাপারেই সিদ্ধান্ত নেবে আপনার স্বার্থপর সঙ্গী। বিভিন্ন নিয়মের ব্যতিক্রম শুধু তখনই হতে পারবে, যখন আপনার সঙ্গীর পক্ষ থেকে কোনো অপারগতা আসে। তার অফিসে কাজের চাপ বা মিটিং রি-শিডিউল এমনকি মুড সুইং হলেও নিয়মে পরিবর্তন সম্ভব। যেকোনো পরিকল্পনা ঠিক করা ও বাতিল করারও এখতিয়ার শুধুই তার। এ সম্পর্কে থাকতে হলে তার এঁকে দেওয়া ছকেই আপনাকে হেঁটে যেতে হবে।
‘সব সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া আর এর ব্যতিক্রম হলেই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা স্বার্থপরতার এক প্রকট লক্ষণ। তার বিপরীতে থাকা মানুষটির জন্য কখনো কখনো এটা দম বন্ধ করা অনুভূতি দেয়। এ ক্ষেত্রে কৌশলে এবং খুব ধীরগতিতে বিপরীতে থাকা মানুষটির নিয়ম থেকে নিজেকে বের করে আনার জন্য সচেতনভাবে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।।খুব ছোট করে হলেও কিছু সীমারেখা টানা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, প্রতিবাদের চেয়ে প্রতিরোধ অনেক সময় বেশি ভালো কাজ করে।’ জানালেন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোথেরাপিস্ট তানজিলা হক।
জিমন্যাস্টিকস অথবা ড্রাইভিংয়ের মতো স্পোর্টসগুলোতে একটি কোমল স্প্রিংবোর্ডের মাধ্যমে বিপরীতমুখী শক্তির বলে ক্রীড়াবিদেরা তাঁদের খেলা আরম্ভ করেন। আলাপচারিতা, চ্যাটিং কিংবা দেখা–সাক্ষাৎ—যেকোনো ক্ষেত্রেই আপনাকে সেই স্প্রিংবোর্ডের অনুভূতি দেবে স্বার্থপর সঙ্গী। কথাবার্তায় সেই একঘেয়েমি। কথোপকথনে তার সারা দিন কোথায়, কীভাবে, কী কী অর্জন অথবা অপ্রাপ্তি হলো, সেসবের বিবরণ থাকলেও আপনার দুয়েকটি মনের কথা তার সঙ্গে শেয়ার করার কোনো উপায় খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। বলতে গেলে বা বলা শেষে শুনতে হবে, এই কথা এখন এভাবে বলাটা কত অনুচিত হয়েছে বা না বললেও হতো। আপনার কুশল-মঙ্গল জানতে চেয়েই আপনাকে ধন্য করেছেন তিনি—এ রকমই মনে হবে। ধীরে ধীরে অনুভব করবেন, এই সম্পর্কে আপনি তার জন্য কেবল স্প্রিংবোর্ডের মতো আছেন। যার কাজ বিপরীতে থাকা সঙ্গীর সাথি হয়ে থাকা। সাপোর্ট সার্ভিস যাকে বলে। এর বেশি কিছু নয়।
জনপ্রিয় লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের একটি উক্তি দিয়ে শেষ করলে তা হয়তো আপনার বোধোদয় ঘটাতে পারে, ‘সবচেয়ে বেদনাদায়ক হলো, অন্যের সঙ্গে সম্পর্কে জড়াতে গিয়ে নিজেকেই ভুলে যাওয়া।’ আর তাই নিজের সত্তাকে বাঁচিয়ে রাখতে সঙ্গীর স্বার্থপরতার লক্ষণগুলো জেনে নিয়ে সময়মতো সরে আসা খুব জরুরি।
ছবি: হাল ফ্যাশন ও পেকজেলসডটকম