যে কারণেই হোক, সম্পর্কে ইতি টানতে হয়েছে। আপনার কাছে পড়ে আছে বিভ্রান্তি, এলোমেলো অগোছালো কিছু মুহূর্ত আর একগুচ্ছ স্মৃতি। হয়তো একে অপরকে চেয়েছিলেন, কিন্তু জীবন সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। হয়তো আপনারা দুজনেই বদলে গেছেন অথবা জীবন বদলে গেছে।
এই বদলের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া সহজ নয়। অতএব এমন কেউ, যিনি আপনার জন্য নয়, তাঁকে ধীরে ধীরে, ধাপে ধাপে চলে যেতে দিন জীবন থেকে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকো থেরাপিস্ট তানজিলা হকের পরামর্শগুলো সেই একই কথা বলছে। তিনি বললেন, এমন কিছু ঘটে গেলে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করে নেওয়া যায় পুরো সময়টা।
যখন এটা নিশ্চিত হয়ে যাবে, তিনি আপনার সঙ্গে আর কোনোভাবেই নেই, তখন থেকে শুরু দিকের সপ্তাহগুলোতে তাঁর উপস্থিতি আপনি সর্বত্র টের পাবেন। গান, মুভি, কফি, টেক্সট মেসেজ, রেস্টুরেন্ট বা ক্যাফে—যেখানে আপনারা সময় কাটিয়েছেন, যে পোশাকে তিনি আপনাকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন—এ রকম ছোট-বড় সবকিছুতেই তাঁর উপস্থিতি টের পাবেন।
আর এসব অনুভূতি আপনাকে প্রতিনিয়ত আঘাত করতে থাকবে, যা অন্য কেউ বুঝবে না। এই বেদনাকে অনুভব করুন আর যতবার ইচ্ছা কাঁদুন। দমকা ঝোড়ো হাওয়ার মতো এসব অনুভূতি বইতে দিতে হবে। কে কী ভাববে, কী মনে করবে—এসব না ভেবে নিজের আবেগকে চেপে না রেখে আবেগের বহিঃপ্রকাশ করলে, তা মনের ভার হালকা করে দেবে। নিকটজন, প্রিয় কোনো বন্ধু অথবা মায়ের কাছে খুলে বলুন সব। তাঁদের সঙ্গে সহজ হতে না পারলে সাইকোথেরাপিস্টের সাহায্য নিন। কিন্তু বিশ্বাস রাখুন, যন্ত্রণাদায়ক এই তীব্র অনুভূতি একসময় কেটে যাবেই।
‘অস্তিত্ব মানেই পরিবর্তন, পরিবর্তন মানে পরিপক্ব হওয়া, পরিপক্ব হওয়া মানে নিজেকে অবিরাম তৈরি করা।’
—হেনরি বার্গসন
আপনি যতই নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করুন যে সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল, সম্পর্ক ভালোই ছিল—ব্যাপারটি তা নয়। বাস্তবতা হচ্ছে, কোনো একটি বিন্দুতে এসে আর সমতা রাখতে পারেনি এই বন্ধন। মেনে নেওয়া আর এগিয়ে চলা ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ নেই। জীবনের এই পরিবর্তন আপনাকে পরিপক্ব করে তুলবে, মনোবল মজবুত করবে এবং সামনে দেখতে শেখাবে।
কিন্তু এই অবস্থায় কখনোই নিজেকে দোষ দেওয়া যাবে না। আরও একটু চেষ্টা করা যেত, আরও একটু সময় নেওয়া যেত অথবা আমি যদি আরও একটু আবেদন নিয়ে তাঁর কাছে যেতাম সব ঠিক হয়ে যেত—এসব ভ্রান্ত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে শিখতে হবে। কেননা সত্যিটা হলো, আপনি এমন একজনের সঙ্গে আবদ্ধ ছিলেন, যিনি আপনার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নন অথবা সম্পর্কে অনেক আগে থেকেই ফাটল ছিল, যা একটি বিন্দুতে এসে ভেঙে গেছে। এমন অনিশ্চিত একটি মানুষের স্মৃতি বয়ে বেড়ানোর চেয়ে নিজেকে মুক্ত করতে শিখে নেওয়ার সময় এটাই। অবশ্যই তাঁকে আপনার মনে পড়বে, কিন্তু প্রাথমিক তীব্র অনুভূতির চেয়ে সেটা কিছুটা হলেও কম। এবং ইতিমধ্যে সেই অনুভূতির সঙ্গে বসবাস করতে আপনি শিখে যাবেন। সকাল, বিকেল, রাতের সেই দমবন্ধ অস্থির ভাব এখন আর নেই। পড়ে আছে স্মৃতি। কিন্তু আপনার মন এটা বুঝতে শিখে যাবে যে স্মৃতিগুলো বহন করার জন্য খুবই ভারী ছিল। একদিন তার তিক্ত স্বাদ আর টের পাওয়া যাবে না আর।
শেষেরও শেষ আছে। সবচেয়ে কাছের মানুষটি এখন আর আপনার কেউ না। কিন্তু দিন শেষে যা আপনি হারিয়েছেন বলে মনে করতেন, তার চেয়ে অর্জন করেছেন অনেক বেশি কিছু। সময় এসেছে আবারও মনের টুকরা টুকরা অংশগুলোকে একত্র করার। যেসব দিক সম্পর্কের টানাপোড়েনে এত দিন অবধি একেবারেই আলোকিত ছিল না, সেদিকে আলোকপাত করুন। মন ও শরীর যেহেতু অভিন্ন, কাউকে বাদ দেওয়ার উপায় নেই। আপনি যা প্রত্যাশা করেন এবং আদতেই যে লক্ষ্যে যেতে চান, সেই উদ্দেশ্যে এগিয়ে যেতে নিজেকে ফোকাস করার বিকল্প আর কিছু নেই।
কাজে মন দিন, নিজেকে সমৃদ্ধ করুন। নিয়মিত শরীরচর্চা, ইয়োগা, সূর্যের আলোকরশ্মিতে নিজেকে কিছুটা সময়ের জন্য রাখা আর পর্যাপ্ত ঘুম আপনার প্রতিটি দিনকে আরও সুন্দর করে তুলবে। ইতিবাচক ভাবনাগুলো নিয়ে থাকুন। যদি ইচ্ছা করে সাদা কাগজে জলরঙে কিছু আঁকুন। অনেকেই প্রকৃতির মাঝে প্রশান্তি খুঁজে পান, তাই দূরে কোথাও যাওয়া সম্ভব না হলেও নিজের ঘরে কিছু গাছের সমারোহ অথবা ঘরের সেট আপ পরিবর্তন আপনার মনকে ধীরে ধীরে নতুনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সাহায্য করবে। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই নতুন অনুধাবনগুলো নিয়ে ভাবুন। নিরাময়ের সময় এখন। ভেঙে আবার নতুন করে গড়ার এই প্রক্রিয়াকে জাপানিজ ভাষায় বলা হয় ‘কিন্টসুগি’ (Kintsugi)। যেখানে ভেঙে ফেলা পটারির টুকরাগুলোকে সোনার প্রলেপ দিয়ে আবারও জুড়ে দেওয়া হয় এবং সেই সোনার প্রলেপের সিরামিকের পটারি হয়ে ওঠে আরও নান্দনিক ও আকর্ষণীয়। সেই সঙ্গে মূল্যবানও। নিজেকে ভেঙে গড়ার মাঝে জীবনের নতুন সম্ভাবনা খুঁজে পাওয়ার আনন্দ আপনার মনে নিরাময়ের সুবাতাস এনে দেবেই একদিন।
হিরো ইমেজ: মিস্টার মোমেন্টওয়ালা
ছবি: পেকজেলস ডট কম