আজ ২৩ ডিসেম্বর। গেল বছর এই দিনে আমার খুব প্রিয় এক বন্ধুকে হারিয়েছি। তাঁর সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গতা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। গেল বছর থেকে এ পর্যন্ত আমি একটা অক্ষরও লিখিনি। আজও যে খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে লিখতে পারছি তা–ও নয়; বরং লিখতে বসে সত্যিই অদ্ভুত কষ্ট দলা পাকাচ্ছে।
এমদাদ হকের সঙ্গে আমার পরিচয়, স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা না করলে, ১৯৯৭ সালে। দৈনিক জনকণ্ঠের মতিঝিল অফিসে। আমার সেই সময়ের বিভাগীয় প্রধান আরিফ রহমান শিবলী আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তরুণ ফ্যাশন ডিজাইনারের সঙ্গে। বলেছিলেন, ওর একটা সাক্ষাৎকার নিয়ো। পুরান ঢাকার উর্দু রোড লাগোয়া হায়দার বক্স লেনে তাঁদের বাড়িতে গিয়েছিলাম সেই সাক্ষাৎকার নিতে।
ফ্যাশন ডিজাইনার এমদাদ হক সেদিন থেকে হয়ে গিয়েছিলেন ‘চীনা’। এটা তাঁর ডাকনাম। আমি চীনা ভাই বলতাম। তারপর থেকে কতদিন যে তাদের ওই বাড়িতে গেছি, তার হিসাব নেই। বরং চিলেকোঠার ঘরে আমাদের কেটেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তাঁর উত্থান থেকে বিখ্যাত হয়ে ওঠার সাক্ষী থাকার সৌভাগ্য হয়েছে আমার।
নতুন কিছু করলে, কোনো আইডিয়া মাথায় এলেই ফোন দিতেন। কিছুদিন কথা না হলে নিজেই ফোন দিয়ে খোঁজখবর নিতেন। দারুণ মজা করে কথা বলতেন। মাঝেমধ্যে আবার অভিমানও করতেন। তবে সেটা মিটে যেতে সময় লাগত না।
পেশাজীবনের বাইরে আমাদের মধ্যকার বন্ধুত্বের গভীরতা ও রসায়ন ছিল অন্য রকম
আমার সঙ্গে তাঁর যখন পরিচয়, তত দিনে তিনি ব্র্যাক ছেড়ে গ্রামীণ উদ্যোগে যোগ দিয়েছেন। মার্কেটিংয়ের ছাত্র এমদাদ। কিন্তু ব্র্যাকে কাজ করতেন সিল্ক প্রজেক্টে। এই অভিজ্ঞতা তাঁর পেশাজীবনে কাজে লেগেছে বিশেষভাবে। ফ্যাশনের ভূতটা মাথায় চাপে বিচিত্রায় ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতায় কাজ করতে গিয়ে। সেটা শুরু করেছিলেন ছাত্রাবস্থায়। সেই মধ্য আশিতে। পরবর্তী সময়ে বিচিত্রা বন্ধ হয়ে গেলে সাপ্তাহিক ২০০০–এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।
গ্রামীণ উদ্যোগের অফিস ছিল মিরপুরে। গেছি সেখানে। সেই সময়ে তিনি কাপড় তৈরি করলেন মার্কিন এক অভিনেত্রীর জন্য। নিয়েও গেলেন আমেরিকায়। এরপর হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশে এলে তাঁর উপহারের জন্য ডিজাইন ও তৈরির দায়িত্বও বর্তায় এমদাদের ওপর।
১৯৯৯ সালে গ্রামীণ উদ্যোগ আউটলেট খোলার সিদ্ধান্ত নেয়। মিরপুর–২ নম্বরের সনি সিনেমার (বর্তমানে স্টার সিনে কমপ্লেক্স) নিচে সামনের দিকে একটা বড়সড় আউটলেট করে। বেশ সাড়া জাগাতেও সক্ষম হন। সেবার ঈদের সময় এমদাদের ডিজাইন করা একটা পাঞ্জাবি বিপুল জনপ্রিয় হয়েছিল। রোজার সময় সন্ধ্যার পর অফিস শেষ করে বাজার দেখার জন্য বেরোতাম। প্রায়ই চলে যেতাম মিরপুরে। দোকানের বাইরে বসে আমরা দুজন আড্ডা দিতাম। কথা হতো ঈদের পোশাক নিয়ে। একদিন, তখন ঈদের মাত্র কয়েক দিন বাকি, দুজন ঠেলাগাড়ির ওপরে বসে গল্প করছি। রাত প্রায় ১০টা। দোকানের শাটার নামানো অর্ধেকটা। ভেতরে বেশ কয়েকজন ক্রেতা সেই ডিজাইনের একটা পাঞ্জাবি নিয়ে রীতিমতো কাড়াকাড়ি করছেন।
বাজারটা দুর্দান্ত বুঝতেন। ধরতে পারতেন কাস্টমারদের পালস। ফলে বাজার কী নেবে আর কী নেবে না, সেটি এত নিখুঁতভাবে অনুমান করতে পারতেন যে যেটা বানাতেন, সেটিই বিক্রি হয়ে যেত। একটা ঘটনা মনে পড়ছে। একবার ঈদের প্রস্তুতি চলছে। ছেলেদের পাঞ্জাবির ডিজাইন করছেন। আমিও গেছি আড্ডা মারতে। তখন তিনি বাংলার মেলায়। দেখি কমলা রঙের অদ্ভুত একটা কাপড় নিয়ে তিনি ভাবছেন।
আমি বলি, কী হবে?
বললেন, ছেলেদের পাঞ্জাবি।
আমি তো হাঁ। বলি, এই কাপড়ে?
বললেন, হ্যাঁ, কেন খারাপ?
আমি কী আর উত্তর দেব।
তারপর নিজেই বললেন, দেখো কেমন চলে।
সত্যি তা–ই। সেটি ছিল সেবারের হট কেক।
বাংলাদেশের ফ্যাশন পরিমণ্ডলে দুটো চমৎকার বিষয় এমদাদ শুরু করেছিলেন। এক. তাঁর ডিজাইনের কাস্টমাইজড পোশাক কিনতে হলে ক্রেতাকে পুরান ঢাকায় যেতে হবে। অর্থাৎ তাঁর বাড়িতে যেতে হবে। দুই. বাংলাদেশে ডিজাইনারস কালেকশন বিয়ের পোশাকের তিনিই বলতে গেলে পথিকৃৎ। বিয়ের পোশাকে বিদেশনির্ভরতা হ্রাসে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
এমদাদ প্রথম দিকে দীর্ঘদিন কেবল ছেলেদের জন্য পোশাক ডিজাইন করতেন। পরে বাংলার মেলায় গিয়ে তিনি মেয়েদের পোশাক ডিজাইন করা শুরু করেন। গ্রামীণ উদ্যোগে থাকার সময় কতৃপক্ষের সঙ্গে তাঁদের খাপ খাচ্ছিল না। ফলে সমমনা কয়েকজন বেরিয়ে গিয়ে নতুন প্রতিষ্ঠান করেন। বাংলার মেলা। বনানী ১১ নম্বর রোডে।
সেই সময়ে ওই রাস্তায় ‘ফিয়েস্তা’ নামে কেবল একটা ফ্যাশন ব্র্যান্ড ছিল। সন্ধ্যা হতে না হতেই ওই রাস্তা ছিনতাইকারীদের দখলে চলে যেত। অথচ এক বাংলার মেলা ওই রাস্তার চেহারা বদলে দেয়। ছোট্ট দোতলা একটা বাড়িতে শুরু হয় বাংলার মেলা। সেখানে এখন আর নেই। বহুতল হয়েছে। একটা ব্যাংক আছে সেখানে। এই বাংলার মেলার বদৌলতেই বনানী ১১ নম্বর রোড হয়ে ওঠে ঢাকার হ্যাপেনিং প্লেস। কালক্রমে এই রাস্তা পরিণত হয়েছে ফ্যাশন স্ট্রিটে। এরপরে ফ্যাশনের সঙ্গে যোগ হয়েছে ফুড।
শুরুর দিনগুলোতে দেখেছি, বাংলার মেলা নিয়ে মানুষের উচ্ছ্বাস। ঈদের সময় ভিড় সামলাতে হিমশিম খেয়েছে তারা। পরে অভিমান করে ছেড়ে দেন বাংলার মেলার ডিজাইনের দায়িত্ব। যদিও আমৃত্যু ছিলেন পরিচালক। পরে হক’স এমদাদ বলে একটা ব্র্যান্ড করেন। ফ্যাশন ডিজাইন শেখানোর জন্য একটা পাঠশালাও করেছিলেন। পরে মন্ডল গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ‘এমব্রেলা’তেও উপদেষ্টা ছিলেন। ছিলেন ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা সহসভাপতি। তাঁর জীবন ছিল বিচিত্র সব কর্মকাণ্ডে মুখর। কিন্তু অসুস্থতাই তাঁর এই বহুধাবিস্তৃত সৃজনজীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়।
নানা সময়ে দুজনে বসে কত পরিকল্পনা করেছি। আর বাস্তবায়নের পর কত মানুষ বাহবা দিয়েছেন। বিরাগভাজনও হয়েছেন কেউ কেউ।
লিখতে বসে জড়ো হচ্ছে হাজারো স্মৃতি। মনে হচ্ছে, তারা গুটি গুটি পায়ে এসেছে ঘিরে ধরেছে আমাকে। সেসব লিখতে গেলে রাত শেষ হয়ে যাবে। এমদাদ তথা চীনাকে কাছ থেকে দেখার, দীর্ঘদিনের উল্লেখ করি সেটিই বুঝতে পারছি না।
প্রিয় পাঠক, আপনি হয়তো ভাবছেন আমি তার গুণগানই করে চলেছি। আসলে তা নয়; বরং যা দেখেছি তা–ই লিখছি। একেবারে এসব আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা।
দোষ–গুণে মানুষ। ভাবতে পারেন তার কি কোন দোষ নেই? হ্যাঁ আছে। খেতে এবং খাওয়াতে ভালোবাসতেন তিনি। বিরিয়ানি তাঁর খুবই প্রিয় ছিল। কিন্তু একটা সময়ের পর স্বাদকোরকে একটু লাগাম টানা প্রয়োজন ছিল। সেটি করেননি। ফলে কিডনির জটিলতা বেড়েছে। তারপর ভারতে গিয়ে ট্র্যান্সপ্ল্যান্ট করিয়ে আসেন। বেশ ভালোই ছিলেন। করোনার সময়েও থাকতেন খুবই সাবধানে। মাঝেমধে৵ই কথা হতো। নানা কিছু করার প্ল্যান করতেন। বাসায় টুকটাক কাজ করতেন। নিজে একটা স্টুডিও করে নিয়েছিলেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে প্যাকওয়ার্কের চমৎকার একটা কু্ইল্ট কালেকশন করেন। দারুণ ফটোশুটও করেছিলেন। সেসব ছবি আমাকেই পাঠিয়েছেন প্রথমে।
গত বছর কোরবানির ঈদের কথা। কী করা যায় তা নিয়ে একদিন কথা হয় তাঁর সঙ্গে। বললেন, এক কাজ করো, বেশ মজা হবে। পাঁচজন ডিজাইনার একটা করে পোশাক তৈরি করবেন, আর প্রত্যেকে একটা করে ডিশ রান্না করবেন। দুজন মিলে একটা তালিকা করা হলো। সেখান থেকে চারজনকে নেওয়া হলো আর তিনি থাকলেন। কাজটা হলোও খুব মজা করে।
বাবা দিবস, নারী দিবস ইত্যাদিসহ যখন যে অনুরোধ করা হয়েছে, কখনো ফেলেননি। মনে আছে বেশ অনেক বছর আগে নিজে গ্লাসি রান্না করলেন একটি সাময়িকপত্রের অনুরোধে। কোনোদিন কোনো কিছু বলে পাওয়া যায়নি, সেটা হয়নি।
বরং কত মানুষের সঙ্গে যে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। এখন তাই কোনো কিছু করতে গেলে প্রথমে তাঁর কথা মনে হয়। এক গভীর শূন্যতা ঘিরে ধরে। বারবার মনে হতে থাকে, চীনা থাকলে কাজটা সহজ হয়ে যেত। কী যে নির্ভরতার জায়গা ছিল তা বলে বোঝানো যাবে না।
আমেরিকার পর স্পেনে গেছেন। পরে নেপালে। যেখানেই গেছেন বলে গেছেন। ফিরে এসে দীর্ঘ আলাপ হয়েছে। ছবিগুলো দিয়েছেন আমাকে সবার আগে।
তাঁর আন্তরিকতার উষ্ণতা ছুঁয়ে যেত সবার। আর মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার দারুণ ক্ষমতা ছিল। আজকের প্রতিষ্ঠিত মডেলদের বেশির ভাগই তাঁর হাত ধরে উঠেছেন। এখনকার ব্যস্ত আর জনপ্রিয় নায়ক ইমন তখন ছোট একটা ছেলে। এসে বসে থাকত। তারপর মডেলিং করল। আস্তে আস্তে বিখ্যাত হয়ে গেল। আমাদের চোখের সামনেই।
দারুণ বৈঠকি মানুষ ছিল এমদাদ। জমিয়ে গল্প করতে পছন্দ করত। একা কখনো কিছু ভাবেনি। ভাবতে পারেনি। সবাইকে নিয়েই ভেবেছে। তাঁর কারণেই তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও সখ্য হয়েছে। বিশেষ করে রেন্টু ভাই (ইস্তাম্বুল হক) আর বিজলী আপা (ফ্যাশন ডিজাইনার বিজলী হক)।
এক সময় পুরান ঢাকা ছেড়ে মিরপুর ডিওএইচএসে থাকতে শুরু করে এমদাদ। ঐ বাসায় নিয়মিত না হলেও গেছি। কত সময় যে এমদাদের সঙ্গে আমার কেটেছে কাজে অকাজে তার এখন আর বলে শেষ করা যাবে না। এর মধ্যে শিক্ষনীয় কত কিছু যে ছিল। কাপড়ের প্রতি যে তাঁর অনুরাগ, ভালবাসা, নিরীক্ষার ঐকান্তিকতা ছিল ঈর্ষণীয়।
সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃকভিটা কিশোরগঞ্জের মসুয়া গ্রাম ঘুরে এসে দুঃখ করে বলেছিলেন, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এটাকে নিয়ে কিছু একটা করতে চাই। ওখানেই একটা প্রদর্শনী করব। আর ঢাকাতেও। তুমি থাকবে আমার সঙ্গে এই প্রকল্পে?
আমি যে থাকব সেটা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে! দুজনের এক সঙ্গে যাওয়ারও কথা ছিল সেখানে। এমদাদ ডিজাইনও করা শুরু করে দিয়েছিলেন। কিন্তু কোথা থেকে কী যে হয়ে গেল!
হাসাপাতালে যেদিন ভর্তি হয় তার দুই কি তিনদিন আগেও আমার সঙ্গে কথা হয়েছে। লন্ডন থেকে তাঁর জন্য আমি চা এনেছিলাম। আর তাঁর এক বন্ধুও কয়েক প্যাকেট চা দিয়েছিল। সেগুলো দিয়েও এসেছিলাম। কিন্তু দেখা আর হয়নি।
হাসপাতালে গিয়ে সেই যে চোখ বুজলেন, সেই ঘুম আর ভাঙল না। রবীন্দ্রনাথের কথার পুনরাবৃত্তি করেই বলতে হয় মৃত্যুর ঝরনা স্থির করে তোলে জীবনের জলকে। এমদাদও বোধ করি সেটিই করলেন। কিন্তু জানি না কিসের ছিল এত তাড়া! কেন যতি টেনে দিলেন এতটা আগে!
ছবি: এমদাদ হকের ফেসবুক পেজ