আজ হ্যালোইনের রাত। ভয় ভয় অনুভূতি উদ্যাপনের সময়। ভয়ের মধ্যেও একধরনের মজা আছে। আর এমন হেমন্তের রাতে ফ্যান চালিয়ে হলেও কাঁথা মুড়ি দিয়ে চলুন জেনে নিই পাঁচটি গা ছমছমে গাছের গল্প।
১. ছাতিমগাছ
প্রকৃতিপ্রেমীদের হেমন্তের আগমনী বার্তার সঙ্গে সঙ্গে শীতের ছোঁয়া নিয়ে শোভা আর চেতনা অবশ করা সুবাস ছড়ায় ছাতিম ফুলের গোছা। অঞ্চলভেদে একে ছাতিয়ান, ছাইত্যানসহ বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। এ গাছকে ঘিরে অনেক মিথও রয়েছে। বলা হয়, ছাতিমগাছে নাকি অশরীরী বসবাস। ইউরোপ–আমেরিকায়ও ছাতিমগাছ নিয়ে রয়েছে নানা মিথ। ইংরেজিতে এই গাছকে ডাকা হয় ‘ডেভিলস ট্রি’ নামে। আর্দ্র, কর্দমাক্ত, জলসিক্ত স্থানে ছাতিম ভালো জন্মে। অনেকেই বলেন, ছাতিমগাছে নাকি ভূত থাকে।
লোকমুখে শোনা যায়, রবীন্দ্রনাথ প্রচুর ছাতিমগাছ লাগিয়েছিলেন। প্রাচীনকালে গ্রামে মেলার সময় ছাতিমতলায় এসে আস্তানা গাড়তেন মুনি-ঋষিরা। বৈষ্ণব–বৈষ্ণবীরা একতারা নিয়ে গানের আসর বসাতেন। ছাতিমগাছের ঘন পাতার জন্য রাতের বেলায় গা ছমছম করা ভাবও আসত। গ্রামের কুসংস্কারমনা লোকজন ছাতিমগাছ নিয়ে নানা ধরনের ভূতের গল্প ফেঁদে বসতেন। এ কারণে বাংলার অনেক লোকজ ছড়ায় বলা হয়, ‘শেওড়াগাছে পেতনি ঠাসা/ ছাতিমগাছে ভূতের বাসা।’
২. দুইশ বছরের পুরোনো রহস্যময় এক গাছ
চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার মিঠানালা রামদয়াল উচ্চবিদ্যালয়ের পুকুরপাড়ে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি গাছ। গাছটির বয়স প্রায় দুই শ বছর। বছরের পর বছর এই গাছ নিয়ে এলাকার মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। স্থানীয় লোকজনের দেওয়া ‘হানজ ফল’ নামেই এটি পরিচিত। গাছটির প্রকৃত পরিচয় স্থানীয় কারোর জানা নেই। স্থানীয় বাসিন্দাদের দেওয়া তথ্যমতে, গাছটি নিয়ে আসা হয়েছিল মিয়ানমারের রেঙ্গুন শহর থেকে। তাঁদের মতে, এ গাছে বছরের বসন্তকালে একধরনের ফল ধরে। যা দিনে ধরে এবং দিনেই পেকে খাওয়ার উপযোগী হয়। তাই তারা মিরসরাইয়ের আঞ্চলিক ভাষায় এটির নাম দিয়েছে হানজ ফল। প্রকৃত বাংলায় যার নাম দাঁড়ায় ‘তাৎক্ষণিক ফল’।
শুধু তাই নয়, এটিকে ঈশ্বরের অলৌকিক সৃষ্টি মনে করে এখানে মানত করা হয়। রোগমুক্তি, বিপদ-আপদে রক্ষা ও ঈশ্বরের কৃপা প্রার্থনায় ফুল, পাতা, গাছের ছাল এবং ফল দিয়ে করা হয় পূজা–অর্চনা। বছরের পর বছর গ্রামের সাধারণ, অতিসাধারণ আর শিক্ষিত শ্রেণি–পেশার লোকজনও এগুলো বিশ্বাস করে আসছে। উদ্ভিদবিশেষজ্ঞদের গবেষণায় জানা যায়, এটি ভারতের খুব পরিচিত একটি গাছ। এটি সংস্কৃতে মধুকা আর হিন্দিতে মহুয়া, মউয়া নামে পরিচিত। বসন্ত এলেই এ গাছ দেখতে আর এর একটি ফল বা ফুল মানত করে খেতে দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসে। গাছের ছায়ায় প্রতীক্ষায় থাকেন সবাই ঘণ্টার পর ঘণ্টা। গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা ভোরবেলায় গাছের নিচে পূজা দেন পাপমুক্তি আর স্বর্গ লাভের আশায়।
৩. ওমবালান্টু বাওবাব বৃক্ষ
দেখতে ভৌতিক দর্শন হলেও এর রয়েছে আশ্চর্য গুণ। পৃথিবীতে এমন একধরনের গাছ রয়েছে, যেটি তার কাণ্ডের মধ্যে লাখ লাখ লিটার পানি ধারণ করে রাখতে পারে। নাম তার ‘বাওবাবগাছ’। হিন্দিতে গাছটি ‘গোরক্ষী’ নামেও পরিচিত। বাওবাবগাছের আসল নাম ‘অ্যাডানসোনিয়া ডিজিটাটা’। আঞ্চলিকভাবে এটি বব, বোবোয়া, বোতলগাছ বা উল্টানো গাছ হিসেবেও পরিচিত। আরবিতে আবার গাছটিকে ‘বুহিবাব’ নামে ডাকা হয়। যার অর্থ অনেক বীজযুক্ত গাছ।
এদিকে আফ্রিকায় এটি ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ট্রি’ হিসেবে পরিচিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাওবাবগাছ কাণ্ডের মধ্যে ১,১৭,৩৪৮ লিটার পানি ধরে রাখার ক্ষমতা রাখে। এ কারণে এ গাছগুলোকে জীবনদানকারী গাছও বলা হয়ে থাকে। এ ধরনের গাছ সাধারণত আফ্রিকার শুষ্ক অঞ্চলে দেখা যায়। আফ্রিকা মহাদেশের মাদাগাস্কারে এই প্রজাতির অনেক গাছ রয়েছে, যা বহু শতাব্দী প্রাচীন। মাদাগাস্কার দেশের এফেট্টি শহরে বহু শতাব্দী প্রাচীন এই গাছ রয়েছে, যে গাছের নাম দেওয়া হয়েছে ‘টি-পট বাওবাব’। গাছটির বয়স আনুমানিক ১ হাজার ২০০ বছর।
৪. ড্রাগনব্লাড ট্রি
যদিও এই গাছের নাম শুনতে বেশ ভয়ংকর লাগে; তারপরও এই গাছ দেখতে অদ্ভুত সুন্দর লাগে ইয়েমেনের সানা দ্বীপে। আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝে ক্যানারি দ্বীপে মূলত এগুলো দেখা যায়। কেন এ গাছকে ড্রাগনব্লাড ট্রি বলা হয়? এর পেছনে অনেক কাহিনি লুকিয়ে রয়েছে।
গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী হারকিউলিসকে হেসপেরাইডসের বাগান থেকে তিনটি সোনার আপেল ফিরিয়ে আনতে হতো। ওই আপেল পাহারা দিচ্ছিল শতমুখী ড্রাগন ল্যান্ডন। ড্রাগনকে না মেরে আপেল ফিরিয়ে আনা অসম্ভব ছিল। হারকিউলিসের সঙ্গে যুদ্ধে ড্রাগনের মৃত্যু হয়। ড্রাগনের গাঢ় লাল রক্ত ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। সেই রক্ত থেকেই নাকি এই ড্রাগনব্লাড ট্রির জন্ম। আর সেই থেকেই ড্রাগনের রক্ত বুকে বয়ে নিয়ে চলেছে এই গাছ।
৫. গিঙ্কো বাইলোবা
এই গাছটিকে 'রবীন্দ্রনাথ কখনো এখানে খেতে আসেননি'- এর চিরযৌবনা মুসকান জুবেরি বললেও ভুল হবে না । এটি মেইডেনহেয়ার নামেও পরিচিত। চীনে এই গাছ দেখতে পাওয়া যায়। এটি সহস্রাধিক বছর বেঁচে থাকতে পারে।
এর দীর্ঘায়ু হওয়ার পেছনে গোপন কী কারণ আছে বিজ্ঞানীরা সেটি সম্প্রতি খুঁজে বের করেছেন। বিজ্ঞানীদের পরীক্ষায় দেখা গেছে, এই গাছ এমন কিছু রাসায়নিক উৎপাদন করতে পারে, যা তাদের রোগজীবাণু ও খরা থেকে রক্ষা করে। আরও মজার ব্যাপার, এই গাছের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়।
ভূত বিষয়টা আসলে ভ্রমজনিত। তবে অমীমাংসিত কিছু রহস্য তো থেকেই যায়। অদেখা জগতের এই গল্পগুলো যত দিন পৃথিবী থাকবে, লোকমুখে চলতেই থাকবে। কারণ, রহস্যময় কিছুর প্রতি মানুষের আকর্ষণ অনন্তকাল থেকেই। সবাইকে ভূতচতুর্দশী এবং হ্যালোইনের শুভেচ্ছা ।
ছবি: ইন্সটাগ্রাম