ক্রিম আপাকে নিয়ে তোলপাড়, ৭টি লক্ষণ দেখে ভাবুন তো আপনি নিজেই টক্সিক প্যারেন্ট কিনা
শেয়ার করুন
ফলো করুন

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও অনেকের মনেই নাড়া দিয়েছে। ভিডিওতে দেখা যায়, এক নারী—যাকে নেটিজেনরা 'ক্রিম আপা' নামে চেনেন—নিজের শিশুকে বিভিন্ন ধরনের মেকআপ ও সাজগোজের কনটেন্ট বানানোর জন্য ব্যবহার করছেন। শুধু তাই নয়, অভিযোগ রয়েছে, তিনি সন্তানকে মারধর করেন, এমনকি তার চুলও ব্লিচ করে দিয়েছেন ভিডিও বানানোর জন্য। এই চিত্রটি একদিকে যেমন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ার 'লাইক-শেয়ার-ভিউ' কেন্দ্রিক মানসিকতার নগ্ন রূপ তুলে ধরে, অন্যদিকে এটিও দেখায়, একটি শিশুর প্রতি তার মায়ের দায়িত্বে কতটা অবহেলা হতে পারে।

'ক্রিম আপা' নামে পরিচিত এই কন্টেন্ট ক্রিয়েটরকে নিয়ে উঠেছে সমালোচনার ঝড়
'ক্রিম আপা' নামে পরিচিত এই কন্টেন্ট ক্রিয়েটরকে নিয়ে উঠেছে সমালোচনার ঝড়
ছবি: প্রথম আলো

একজন মা যখন সন্তানের চেয়ে কনটেন্ট ক্রিয়েশনের কথা আগে ভাবেন, তখন কি তাকে দায়ী করা যাবে না টক্সিক প্যারেন্ট হিসেবে? 'ক্রিম আপা'কে আমরা ধিক্কার জানাই। আমরা বলি— এমনও কি মা হয়?  কিন্তু প্রশ্ন হলো—আমরা কি নিজেদের দিকেও তাকাচ্ছি? আমরাও কি কখনো নিজেদের সন্তানকে না বুঝেই তার ক্ষতি করি না? আমরাও কি কখনো সন্তানকে নিজের ইচ্ছার পুতুল বানায় রাখি না? সন্তানের কথা না শুনে, শুধু নিজের কথাই চাপিয়ে দিচ্ছি না তো তাদের ওপর? এভাবে একটু একটু করে নিজেরাই টক্সিক প্যারেন্ট হয়ে উঠছি না তো? চলুন জেনে নেই  কোন ৭টি লক্ষণ দেখে বুঝবেন যে সন্তানের জন্য আসলে টক্সিক হয়ে উঠছেন আপনি।

নিজেরাই টক্সিক প্যারেন্ট হয়ে উঠছি না তো?
নিজেরাই টক্সিক প্যারেন্ট হয়ে উঠছি না তো?

টক্সিক বাবা–মা কারা

'টক্সিক' শব্দটি শুনলে আমাদের মাথায় সবার আগে আসে কেবল চরম নির্যাতনের কথা। কিন্তু অনেক সময় বাবা-মার ভালোবাসা, উদ্বেগ বা অভিভাবকত্বও এমন এক ধরনের দমবন্ধ করা নিয়ন্ত্রণের রূপ নেয়, যা শিশুর মানসিক বিকাশে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। টক্সিক প্যারেন্ট মানে এমন এক অভিভাবক, যিনি সন্তানকে নিজের অধীনস্থ মনে করেন। যার ফলে সন্তানের তার নিজ স্বত্ত্বা হারিয়ে ফেলে। এমন প্যারেন্টরা যেসব কাজ করেন তা হলো

বিজ্ঞাপন

১. সবসময় সন্তানকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া

আপনার সন্তানের কী পড়া উচিত, সে কোন বন্ধুদের সঙ্গে মিশবে, কোন পোশাক পরবে, এমনকি ভবিষ্যতে সে কী হবে—সব কিছু আপনি নির্ধারণ করে দিচ্ছেন। আর সবকিছু সেই অনুযায়ী হলে তবেই আপনি সন্তুষ্ট থাকেন। আপনি যদি এমন প্যারেন্ট হন তাহলে আপনি আপনার সন্তানের ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন। সন্তান যদি নিজের মতো করে ভাবতে ও সিদ্ধান্ত নিতে না শেখে, তবে ভবিষ্যতে তার মধ্যে স্বাধীনতা ও আত্মবিশ্বাসের অভাব হবে।

নিয়মিত তুলনা করা সন্তানের সঙ্গে আপনার সম্পর্কেও দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারে
নিয়মিত তুলনা করা সন্তানের সঙ্গে আপনার সম্পর্কেও দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারে

২. সন্তানকে অন্যদের সঙ্গে তুলনা করা

তোমার বয়সী ছেলেমেয়েরা কত ভালো করছে! ও কত ভালো নম্বর পেয়েছে, আর তুই কিছুই পারিস না!—এই ধরনের তুলনামূলক কথা অনেক বাবা–মা সন্তানের সামনে বলেন। তাঁরা মনে করেন, এতে সন্তান লজ্জা পেয়ে অথবা প্রতিযোগিতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আরো ভালো করবে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ নেয়।এই ধরনের তুলনা সাধারণত সন্তানের মনে হীনমন্যতা, ব্যর্থতার বোধ জন্ম দেয়। এই নেতিবাচক মনোভাব ধীরে ধীরে তাকে মানসিকভাবে দুর্বল করে তোলে। এছাড়া নিয়মিত তুলনা করা সন্তানের সঙ্গে আপনার সম্পর্কেও দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারে।

বিজ্ঞাপন

৩. সন্তানের অনুভূতিকে অবহেলা করা

অনেক সময় আমরা যখন সন্তানের মুখে কষ্ট, হতাশা বা মন খারাপের কথা শুনি, তখন এইটুকু বয়সে এত কষ্ট? নাটক করিস না! তোমার আবার কী সমস্যা? তোমার তো কোনো চিন্তা নেই! ইত্যাদি কথাগুলো বলে থাকি। এগুলো হয়তো শুনতে আমাদের কাছে সাধারণ বা তুচ্ছ মনে হতে পারে, কিন্তু সন্তানের মনে এগুলো গভীরভাবে গেঁথে যায়। এ ধরনের মন্তব্য সন্তানের আবেগকে উপেক্ষার শামিল। সে মনে করে তার অনুভূতির কোনো মূল্য নেই, কেউ তাকে গুরুত্ব দেয় না।

এ ধরনের মন্তব্য সন্তানের আবেগকে উপেক্ষার শামিল
এ ধরনের মন্তব্য সন্তানের আবেগকে উপেক্ষার শামিল

এর ফলে শিশুটি ধীরে ধীরে নিজের আবেগ চেপে রাখতে শুরু করে। মন খারাপ হলেও বলে না, কষ্ট পেলেও প্রকাশ করে না। খুব বড় কোনো মানসিক চাপেও সে চুপ করে থাকে, কারণ তার মনে হয়—বলেও লাভ নেই, কেউ শুনবে না, কেউ বুঝবে না।

৪. ভালোবাসার নামে সন্তানকে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ করা

বেশিরভাগ বাবা-মাই মনে করেন সন্তানের প্রতিটি কাজে হস্তক্ষেপ করাই তাদের দায়িত্ব এবং সেটাই তাঁদের  ভালোবাসার প্রমাণ। সন্তান কী খাবে, কী পরবে, কাদের সঙ্গে মিশবে, কী নিয়ে ভাববে বা ভবিষ্যতে কী হবে—সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে তারা বারবার বলেন, তোমার ভালোর জন্যই বলছি।

তারা বারবার বলেন, তোমার ভালোর জন্যই বলছি
তারা বারবার বলেন, তোমার ভালোর জন্যই বলছি

এই কথাটি বাইরে থেকে যতটা স্নেহময় মনে হয়, বাস্তবে তা অনেক সময় টক্সিক আচরণে পরিণত হয়। ভালোবাসার ছায়ায় যখন সন্তানের উপর অতিরিক্ত এই নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দেওয়া হয়, তখন সে নিজের মত করে ভাবতে শেখে না, সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পায় এমনকি ভুল করতেও ভয় পায়। কারণ ছোট থেকেই তাকে শেখানো হয় তুমি কিছু বোঝ না, আমি যা বলি তাই ঠিক। কিন্তু সত্যি কথা হলো—একজন মানুষ ভুল না করলে সেখান থেকে শেখার সুযোগ পায় না। সন্তানকেও একইভাবে ছোট ছোট ভুল করার, সেখান থেকে শিক্ষা নেওয়ার, এবং ধীরে ধীরে পরিণত হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। যদি তার প্রতিটি সিদ্ধান্তেই আপনি হস্তক্ষেপ করেন, তাহলে সে পরবর্তীতে নিজের জীবনের দায়িত্ব নিতে ব্যর্থ হবে।

৫. সন্তানের ব্যর্থতা দেখলে অপমান করা

সন্তানের জীবনে ছোটখাটো ব্যর্থতা আসবে এটাই স্বাভাবিক। পরীক্ষা ভালো না হওয়া, খেলায় হেরে যাওয়া, কোনো প্রতিযোগিতায় সফল না হওয়া—এইসব ঘটনা জীবনের একটি অংশ মনে করতে হবে। কিন্তু অনেক বাবা-মা আছেন যারা এমন পরিস্থিতিতে খুব সহজেই রেগে গিয়ে বলে ফেলেন, তুমি কোনোদিনই কিছু করতে পারবে না, তুই সবকিছুতেই ফেল, তুমি আমাদের লজ্জার কারণ হয়ে গিয়েছ ইত্যাদি।এই ধরনের কথাগুলো শুধু ক্ষণিকের রাগ প্রকাশ নয় বরং সন্তানের মনে স্থায়ীভাবে দাগ কাটে। সে ধীরে ধীরে বিশ্বাস করতে শুরু করে যে—সে সত্যিই অযোগ্য, সে কোনো কিছুতেই সফল হতে পারবে না।

সে নিজের ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও  অন্যের স্বপ্ন বাস্তবায়নে বাধ্য হয়
সে নিজের ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও অন্যের স্বপ্ন বাস্তবায়নে বাধ্য হয়

৬. নিজের স্বপ্ন জোর করে সন্তানকে দিয়ে পূরণ করতে চাওয়া

অনেক বাবা–মা আছেন যারা ছোটবেলায় নানান কারণে তাদের নিজস্ব স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। কারও ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হওয়া, কেউ হতে চেয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ার, কেউবা হয়তো অভিনয় বা গানের জগতে যেতে চেয়েছিলেন। সেই অপূর্ণ স্বপ্নগুলো তারা নিজের অজান্তেই সন্তানের কাঁধে চাপিয়ে দেন। এতে শুধু চাপ নয়, সন্তানের ওপর এক ভয়ানক মানসিক ভার তৈরি হয়। কারণ সে নিজের ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও  অন্যের স্বপ্ন বাস্তবায়নে বাধ্য হয়।

৭. সন্তানের ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা

আপনি কি সবসময় ঠিক করে দিচ্ছেন সে কী পোশাক পরবে, কার সঙ্গে মিশবে, কোথায় যাবে বা যাবে না, এমনকি সে কীভাবে হাঁটবে, কথা সাথে কথা বলবে বা কিভাবে হাসবে? তাহলে আপনি হয়তো নিজের অজান্তেই আপনার সন্তানকে একটি মানুষ হিসেবে নয়, বরং একটি প্রজেক্ট হিসেবে গড়ে তুলছেন। আপনি ভাবছেন, যতটা আপনি নিয়ন্ত্রণ করবেন, ততটাই সে সঠিক পথে থাকবে। কিন্তু এই ধরণের মনোভাব সন্তানের আত্মপরিচয়ের বিকাশে ভয়ানক বাধার সৃষ্টি করে থাকে।

'ক্রিম আপা'র বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে
'ক্রিম আপা'র বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে
ছবি: প্রথম আলো

'ক্রিম আপা'র বিরুদ্ধে আজ না হয় আইনি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে । কিন্তু যারা ক্যামেরার সামনে নয়, চুপিচুপি সন্তানের আত্মাকে ধ্বংস করে দিচ্ছেন তাঁদের কি হবে! মনে রাখবেন আপনার সন্তান একজন স্বতন্ত্র মানুষ। তাকে শুধু ভালোবাসা দিয়ে নয়, উপযুক্ত সম্মান, বোঝাপড়া, আর স্বাধীনতার সুযোগ করে দিতে হবে। আপনার ছায়া যদি তাকে রোদ থেকে বাঁচায়, তাহলে তার ডানাও যেন তাকে উড়তে শেখায়। মনে রাখবেন, আপনি যদি সন্তানকে বুঝতে শেখেন, সে একদিন আপনাকে গর্বিত করতে ভুল করবে না।

তথ্যসূত্র: ক্লাম

ছবি: পেকজেলস ডট কম

প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ১৭: ৩১
বিজ্ঞাপন