ফিনল্যান্ডের অধিবাসীরাই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। সুখ ধরাছোঁয়ার বাইরে হলেও সুখের অনুভূতিকে পরিমাপ করার জন্য বিজ্ঞানীরা একে বেঁধেছেন কিছু নির্দিষ্ট সূচকের ছকে। সবার প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে এ বছর প্রকাশিত ইউএন সাস্টেনেবল ডেভেলপমেন্ট সল্যুশনস নেটওয়ার্কের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টে ৭ম বছরের মতো চ্যাম্পিয়ন সুখী দেশ হয়েছে ফিনল্যান্ড। ১৪৫টি দেশের মানুষকে এই গবেষণার আওতায় আনা হয়।
সুখের পেছনে ছুটছে দুনিয়ার সবাই। কিন্তু নর্ডিক দেশ ফিনল্যান্ড কেন এদিক থেকে বহুদিন ধরে সবচেয়ে এগিয়ে, এ নিয়ে চলছে বিস্তর গবেষণা। সামাজিক মনস্তত্ত্ববিদেরা বিভিন্ন গবেষণাপত্রে এই সুখের মূলে ফিনিশদের যাপনরীতিকেই মূল অনুঘটক বলে রায় দিচ্ছেন। এমনিতেই ফিনল্যান্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সামাজিক নিরাপত্তার শক্তিশালী অবকাঠামো আর সমাজে সবার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার সংস্কৃতির মধ্যে ফিনল্যান্ডের সুখের জিয়নকাঠি রয়েছে। তবে ফিনিশদের জীবনযাপনের বিশেষ দিকগুলো সত্যিই চিন্তার খোরাক জোগানোর মতো।
১. কর্মক্ষেত্র ও ব্যক্তিগত জীবনের ভারসাম্য রাখা
অনমনীয় কর্মঘণ্টার রক্তচক্ষু অনুপস্থিত ফিনিশদের কর্মজীবনে। কাজ শেষ করাটাই মূলকথা। ছুটিছাটা পাওয়া যায় বেশ। কাজের পাশাপাশি পরিবারকে সময় দেওয়া বা ছুটি কাটাতে ভ্রমণ এ দেশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটানো. ছবির মতো দেশ ফিনল্যান্ড। প্রকৃতির মধ্যে যে সুখ মেলে, তা ঘরের চার দুয়ারের ভেতরে অধরাই রয়ে যায়; তা সে ঘর যতই বিলাসবহুল হোক—এ কথা ফিনিশরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। হাইকিং হোক, স্কিইং হোক অথবা হেঁটে ঘুরে বেড়ানো—ফিনল্যান্ডের মানুষ রোজ একবার বের হবেই।
২. জীবনযুদ্ধে ফিনিশ দর্শন 'সিসু'
ফিনিশদের জন্য যেকোনো প্রতিকূলতায় সিসু এক অত্যাবশকীয় জীবনদর্শন। সিসু অর্থ আসলে কোনো অবস্থাতেই হার না মানা; আর হারকে মেনে নিয়ে আবারও জয়ের পথে চলা।
৩. প্রত্যেকে তারা পরের তরে
বেশির ভাগ পশ্চিমা দেশ যেখানে ব্যক্তিগত জীবনে একলা চলো নীতিতে বিশ্বাসী, সেখানে ফিনিশদের সামাজিক বন্ধনগুলো অত্যন্ত গাঢ় হয়ে থাকে। স্থানীয় কারও উদ্যোগকে যথাসাধ্য সহযোগিতা ও সাফল্যকে প্রাণভরে উদ্যাপন করে ফিনিশরা। একা একা কি আর সুখী হওয়া যায়!
৪. শিক্ষার ক্ষেত্রে আপস নয়
মানসম্মত সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থার জন্য বিখ্যাত ফিনল্যান্ড। এখানে শিক্ষা মৌলিক অধিকার বলে স্বীকৃত আর তা শুধু কাগজে-কলমে নয়। শিক্ষার আলো সমাজের অন্ধকার দিকগুলো আলোকিত করতে সাহায্য করে আর জ্ঞান মানুষকে ভেতর থেকে সমৃদ্ধ করে, বলাই বাহুল্য।
৫. মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ দেখভাল
বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই মানসিক স্বাস্থ্য উপেক্ষিত, এ নিয়ে কথা বলা যেন এক সামাজিক ট্যাবু। অথচ ফিনল্যান্ডে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ও সামাজিকভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্রয়োজন হলে নিশ্চিত করা হয় চিকিৎসা।
৬. শরীর-মনে আরাম দিতে সনা-সংস্কৃতি
ঐতিহ্যগতভাবেই ফিনল্যান্ডে সনা বা স্টিমবাথ বেশ প্রচলিত। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, শরীর ও মনের ওপর তা সুপ্রভাব ফেলে। নিয়মিত সনা সেশনে অংশ নিলে তা স্ট্রেস কমায়। আবার সেখানে গল্পগুজব আর আড্ডাও চলে। সব মিলে এই সনা–সংস্কৃতির দারুণ ভূমিকা রয়েছে মন ভালো রাখতে।
৭. সচল আর সক্রিয় থাকা
জাতিগতভাবেই কর্মঠ ফিনিশরা শুয়েবসে কমই দিন কাটায়। তারা সবাই কোনো না কোনোভাবে নিয়মিত শরীরচর্চা করে। রাস্তায় বেরোলেই দেখা যাবে, সাইক্লিং বা জগিং করতে বের হয়েছে অনেকেই। ঘাম ঝরালে মনের বিষাদ আর দুশ্চিন্তাগুলোও ঝেড়ে ফেলা যায় সহজে—এ তো পরীক্ষিত বৈজ্ঞানিক তথ্য।
তথ্যসূত্র: বিবিসি সায়েন্স ফোকাস ম্যাগাজিন
ছবি: পেকজেলস ডট কম, উইকপিডিয়া