অজ আইডিয়া স্পেস: টেকসই, পরিবেশবান্ধব আর মনজুড়ানো
শেয়ার করুন
ফলো করুন

কংক্রিটের জঙ্গল বললে ভুল হবে না মেট্রোপলিটন নগরী ঢাকাকে। মাঠ, গাছপালা, পার্ক, পুকুর—সবকিছু উজাড় বা ভরাট করে গড়ে উঠছে স্থাপনার পর স্থাপনা। পুরোনো বাড়িগুলোর গুটিকয় মনে হয় বাকি এখনো। যেগুলো আছে, সেগুলোও বহুতল ভবনে রূপান্তরের অপেক্ষায়। এই ঢাকার গুলশানের মতো জায়গা যেখানে বড় বড় দালান আর বিলাসবহুল রেস্টুরেন্টে পরিপূর্ণ, সেখানেই এক ভিন্নধর্মী আবহ নিয়ে এসেছে ‘অজ আইডিয়া স্পেস’।

অত্যন্ত ব্যতিক্রমী দর্শন ও ভাবনার প্রতিফলন দেখা গেল এখানে। গুলশানের এক পুরোনো বাড়িকে না ভেঙে সেটাকেই দেওয়া হয়েছে নতুন রূপ। নান্দনিক ও শৈল্পিক উপস্থাপনায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে এই জায়গার প্রতিটি কোণ। আর অত্যন্ত সচেতনভাবে এখানে পরিবশের কোনো ক্ষতি করা হয়নি; বরং সবকিছু সাজানো হয়েছে পরিবেশবান্ধব করে।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা শহরে একটু প্রাণভরে শ্বাস নেওয়ার জায়গার সত্যিই বড় অভাব। অজো সে ব্যবস্থাই করেছে। রেস্টুরেন্ট, আর্ট গ্যালারি, নার্সারি, গাছপালায় ঢাকা সবুজ ঘাসের উঠান, ছোট্ট জলাধার আর সুসজ্জিত বসার জায়গা মিলে সেজে উঠেছে এই জায়গা। যার নাম দেওয়া হয়েছে অজো আইডিয়া স্পেস।

ঢাকার গুলশানে উঁচু উঁচু দালানে ঠাসা ল্যান্ডস্কেপের মধ্যে এই জায়গাটাকে আসলেই ‘জায়গা’ বা ‘স্পেস’ বলে ডাকা উচিত। যেখানে কোথাও কোনো জায়গা খালি নেই, সেখানে অজো আইডিয়া স্পেসের এই শ্বাস নেওয়ার মতো চৌহদ্দিতে এলে যে কারোরই মন ভালো হয়ে যাবে, তা নিশ্চিত হয়ে বলা যায়। এখানে ঢুকলেই অনুভব করতে পারবেন একধরনের প্রশান্তি।

বিজ্ঞাপন

এখানকার রেস্তোরাঁটি ডিজাইন করা হয়েছে অনেকটা বৌদ্ধমঠের আদলে। প্রেরণা হয়েছে মহাস্থানগড়। পরিবেশকে বিবেচনায় রেখে নির্মাণের প্রায় সব ক্ষেত্রে দেশীয় উপকরণকে বিশেষভাবে পুনর্ব্যবহার করে তৈরি হয়েছে অজ আইডিয়া স্পেস।

নির্মাণের ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী কৌশল ও টেকসই ডিজাইনকে দেওয়া হয়েছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব। গ্রুপ অব আর্কিটেক্টস অ্যান্ড থিংকার্স নামের একটি কমিউনিটি এই নকশার পেছনের সৃজনশীল ভাবনার জোগান দিয়েছে। এয়ারকার্গো ব্যবহৃত পারটেক্স বোর্ড দিয়েছে হয়েছে দেয়াল।

জাহাজের স্ক্র্যাপ মেটালে তৈরি হয়েছে টেবিল। পল্লীবিদ্যুতের পুরোনো কাঠের খুঁটি কেটে তৈরি করা হয়েছে মেঝে এবং অন্যান্য জিনিস। সোফা আর চেয়ারের কাপড়ও গার্মেন্ট লেফটওভার।

বলাই যায়, বেশির ভাগ আসবাব ও গৃ্হসজ্জার সামগ্রী তৈরি হয়েছে রিসাইকেল করে। সেই ষাট বছরের পুরোনো এক সুইমিংপুলকে নতুন করে সাজিয়ে নেওয়া হয়েছে। কংক্রিট আর ইটের গাঁথুনির মাঝে প্রশস্ত জানালা দিয়ে পর্যাপ্ত আলো আসার ব্যবস্থা আছে। এশিয়ান ট্যাপেস্ট্রির ব্যবহার দেখা যাচ্ছে ফার্নিশিং ও আপহোলস্ট্রি হিসেবে।
দুনিয়াজুড়েই বর্তমানে একধরনের অস্থির অবস্থা বিরাজ করছে।

প্রতিনিয়ত ছুটে চলা আর সভ্যতার উৎকর্ষের নামে পৃথিবী ও জলবায়ু ধ্বংসের সব আয়োজনই মানুষ তার জীবনের অংশ করে নিয়েছে। ফলে একই সঙ্গে পরিবেশ বিপর্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক সমস্যার মতো নানা সংকটের মুখে পড়ছি আমরা। সব মিলিয়ে তাই নাগরিক জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। এই সংকটকে মোকাবিলা করতেই নগরবাসীর জন্য একটুখানি স্বস্তিময় সময় কাটাতে শান্তিপূর্ণ স্থান হিসেবে দারুণ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে অজ আইডিয়া স্পেস।

এই জায়গাটি মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সহজাত সংযোগ স্থাপনের সুযোগ করে দিয়েছে। নগরীর মধ্যে এভাবে নিজের মতো করে ঘাস, গাছ, কাঠ আর মাটির সংস্পর্শ পাওয়ার মতো জায়গা বিরলই বটে। অজ আইডিয়া স্পেসের কর্ণধার খালিদ মাহমুদ বলছিলেন, অজ আসলে কাজের অবসরে বা ছুটির দিনে চটজলদি মজার কিছু খেতে চাইলে তা আরাম করে খাওয়ার একটি জায়গা। তবে তা সাধ্যের মধ্যে।

আর শৈল্পিক ছোঁয়া রাখার চেষ্টা করা হয়েছে এখানকার খাবার, আবহ, নকশা আর পুরো ভাবনার মধ্যে।গুলশানের এই শান্তিময় স্পেসটির বাগানে ইকেবানার এক্সপেরিয়েন্স সেন্টারের কল্যাণে জাপানি জেন গার্ডেনের ভাব রয়েছে। রয়েছে গোল্ডফিশ আর কচ্ছপের পুকুর আর বিশাল সব গাছ।

খালিদ মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের এই জায়গা পরিবেশের দিক থেকে টেকসই, অর্গানিক আর সাদামাটা। এখানে এসে সবাই নিজের মস্তিষ্কের জটগুলো খুলতে পারবেন। আর শান্ত পরিবেশ উপভোগ করতে পারবেন প্রাণভরে।’

এবারে বলতে হয় অজর খাবারের কথা। একেবারে স্থানীয় উপকরণগুলোকে এখানে দেওয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক মাত্রা। স্প্যানিশ টাপাস প্ল্যাটার, ইন্ডিয়ান নান উইথ কারি, পাস্তা, ফ্রায়েড কালামারি, কফি, চা—সবকিছুই দেশি উপকরণ দিয়ে তৈরি। অজর মেনুতে আছে বেশ কিছু চমৎকার মকটেল। রংবাজ, দুই পয়সার আলতা, সঞ্চারিণী, সবুজ সাথির মতো মজার সব নাম দেওয়া হয়েছে এই ককটেলগুলোর।

একটি ঠিকঠাক ডাইন ইন রুম যেমন আছে এখানে, তেমনি রাখা হয়েছে আরও একটু আরাম করে খাওয়ার জন্য লাউঞ্জ। বাইরেও জলাশয় ঘেরা বসার জায়গা রয়েছে। খালেদ মাহমুদ বললেন, এই পানির উপস্থিতির কারণে ভেতরের তাপমাত্রা বাইরের চেয়ে দুই ডিগ্রি কম থাকে। সব ক্ষেত্রেই পরিবেশ আর দেশের শিল্প বাঁচানোর ভাবনা থেকে চা-কফির কাপ বাদ দিয়ে মাটির গ্লাস বা ভাঁড় ব্যবহার করতে চাইছেন তিনি, জানালেন খালেদ।

উল্লেখ্য, অজ আইডিয়া স্পেসের একই সীমানার ভেতরে রয়েছে ‘১০১ এন আর্ট স্পেস’, ব্যাগের আউটলেট ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ আর ‘ইকেবানা বাংলাদেশ’। এ ছাড়া প্রতি বুধবার জেনজিদের জমায়েতের জন্য রাখা হয়েছে একটা আলাদা রুম। এখানে তাঁরা মেতে উঠতে পারবেন নানা ভাবনা নিয়ে। করতে পারবেন বিতর্ক, আলোচনা, সেমিনার, কর্মশালা ইত্যাদি।

বলে রাখা ভালো, অজ আইডিয়া স্পেসের এটা দ্বিতীয় শাখা। প্রথমটা উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরে। তবে গুলশানের অজ আইডিয়া স্পেসও ঢাকার সব ধরনের মানুষের দুদণ্ড সময় কাটানোর চমৎকার ঠিকানা হতে পারে। হতে পারে অনবদ্য আড্ডার জায়গা। আবার মন চাইলে একেবারে একাকী নিজের মতো করে সময় কাটাতেও অজ আইডিয়া স্পেসের জুড়ি নেই।

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৬: ০০
বিজ্ঞাপন