আজিমপুর বেবি আইসক্রিম মোড় থেকে আজিমপুর কবরস্থানের দিকে কিছুটা এগোলেই আপনার মসজিদটি চোখে পড়বে। কবরস্থানের ১ নম্বর গেটের পূর্ব দিকেই এই লাল ইটের মসজিদ। দূর থেকে মসজিদের মূল ভবনটি আপনার দৃষ্টিগোচর হলেও, যতই এগোবেন, ততই এর অন্য রকম সৌন্দর্য আপনাকে মোহিত করবে। আর একদম সামনে যখন আপনি আপনার বাহন থেকে নেমে পড়বেন, তখন টের পাবেন এই মসজিদের মূল ভবনের সামনে বিরাট একটি শান।
মসজিদের মূল নামাজঘরটি দোতলা। তবে সেখানে যেতে হয় একটি শানবাঁধানো চত্বর পার হয়ে। এই ‘শানে’র ব্যাপারটি মোগল আমলের মসজিদ থেকে অনুপ্রাণিত বলে এর স্থপতি রফিকুল আযম বিভিন্ন সাময়িকীকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন। তবে শান বলেন বা বড় খোলা বারান্দা বলেন, এটি দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে মসজিদের মূল নামাজঘরের প্রায় সমান। এই শানেও সবাই নামাজ পড়েন। শুক্রবারে আগেভাগে যেতে না পারলে শানেও জায়গা হয় না।
শান পেরিয়ে আপনি মসজিদের উত্তর দিকে চলে যেতে পারেন। সেখানে গেলেই শহরের কোলাহলময় হৈহট্টগোল থেকে আপনি এক শান্ত জায়গায় পৌঁছে যাবেন। কারণ, মসজিদের উত্তর দিকের সীমানাদেয়ালের পরই আজিমপুর কবরস্থানের শুরু। চিরনিদ্রার স্থান। আর তখনই আপনি উপলব্ধি করবেন এই মসজিদটি আপনাকে একদিকে দুনিয়ার ব্যস্ততার সঙ্গে যেমন যুক্ত করছে, তেমনি জানিয়ে দেবে আপনার শেষঠিকানা হবে শান্ত ও নিরিবিলি পরিবেশে।
স্থাপত্য সাময়িকী ডিজিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে স্থপতি রফিকুল আজম এটিকে বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘মসজিদটি যেন দুই জীবনের মাঝখানে একটি জানালার মতো। এর দক্ষিণে পৃথিবীর ব্যস্তময় সড়কে জীবিতদের জীবনযাত্রার খণ্ডচিত্র আর উত্তর দিকে চিরনিদ্রার জায়গা।’ আজিমপুর কবরস্থানের সঙ্গে লাগোয়া এই মসজিদটি ঢাকার প্রয়াত মেয়রের নামে ‘মেয়র মোহাম্মদ হানিফ’ জামে মসজিদ।
মসজিদের দুটি অংশ। মাঝখানের শানের অংশ আগেই বলেছি। মূল নামাজঘরে গেলে আপনি মোগল আমল থেকে আধুনিক স্থাপত্য ভুবনে চলে যাবেন। নিচতলায় ব্যাঙের ছাতার মতো কলামগুলো ছাদটাকে ধরে রেখেছে। তবে পুরোটাজুড়ে ছাদ কিন্তু নেই। ইমামের কাতারের সমপরিমাণ জায়গা ছাদে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে এবং এর ওপরের ছাদে কংক্রিটের ঢালাইয়ের পরিবর্তে দেওয়া হয়েছে কাচ। উত্তর দিকের দেয়ালজুড়ে বড় বড় কাচের পার্টিশন। ফলে দিনভর আলোর কমতি নেই। বিকেলে আলোর উপস্থিতি এক ভিন্ন দ্যোতনা তৈরি করে।
দেতলার সিঁড়ি খুঁজতে গিয়ে আপনি টের পাবেন মূল নামাজঘরের সঙ্গে কোনো সিঁড়ি নেই। আপনার ভাবনা ডানা মেলার আগেই আপনি শানের উত্তর দিকে মাথার ওপরে একটি ব্রিজ দেখতে পাবেন। তখন আপনি পূর্ব দিকে মসজিদের দ্বিতীয় অংশটি দেখবেন। এই অংশের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে হয়। এরপর শানের ওপর ব্রিজ পেরিয়ে আপনি দোতলার নামাজঘরে পৌঁছাতে পারবেন। শুক্রবার জুমার নামাজের সময় অনেকেই এই ব্রিজে নামাজ পড়েন।
এই ব্রিজ থেকে আপনি আজিমপুর কবরস্থানের অনেকখানিই দেখতে পাবেন। ভবনের এই অংশের দোতলায় নারীদের নামাজ পড়ার জায়গা আছে। নারীদের নামাজ পড়ার জায়গার দক্ষিণ দিকে খানিকটা জায়গাজুড়ে সবুজ একটি আবহ তৈরি করা হয়েছে গাছগাছালি দিয়ে। পোড়ামাটির ইট দিয়েই এটি বিনির্মিত। কোথাও কোথাও টেরাকোটা ব্যবহার করা হয়েছে ডিজাইনের জন্য। ডিজাইনের সময় সযত্নে বাহুল্য বাদ দেওয়া হয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস। মোগল আমলের চিন্তাধারার সঙ্গে আধুনিক চিন্তা ও নির্মাণসামগ্রীর সংমিশ্রণ মসজিদটিকে সাধারণের মাঝে অসাধারণ একটি আবহ দিয়েছে। মসজিদের উত্তর দিকে মুসল্লিদের অজু করার জায়গা। সেখানেও আলোর ব্যবহার আপনাকে মুগ্ধ করবে।
ঢোকার সময়ে আপনি হয়তো খেয়াল করবেন না, কিন্তু বেরোনোর সময় মূল দরজার পশ্চিমে, মসজিদের দক্ষিণে নিরেট একটি দেয়াল দেখে আপনি এর মিনারটি দেখতে পাবেন। সুউচ্চ মিনার। বৃত্তাকার ও খোলামেলা যে মিনারগুলো দেখতে আমরা অভ্যস্ত, এটি তার ব্যতিক্রম। বর্গাকার এই মিনারটির চারদিকেই নিরেট দেয়াল। এর একেবারে ওপরে মাইক বসানো। দোতলার নামাজঘর থেকে সেখানে যাওয়ার পথ আছে।
মসজিদ থেকে আপনি যখন বের হবেন, তখনো আপনার মন থাকবে সেখানে। পার্থিব ও অপার্থিব জগতের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করেছে স্থাপত্যের অনন্য নজির এই মেয়র মোহাম্মদ হানিফ মসজিদ।
ছবি: দীপু মালাকার