আলো-ছায়ার অনন্য স্থাপত্যে বাইতুর রউফ মসজিদ
শেয়ার করুন
ফলো করুন

ঢাকাকে বলা হয় মসজিদের শহর। ঢাকার অলিগলিতে রয়েছে অনেক ঐতিহাসিক মসজিদ। পাশাপাশি গত দেড় দশকে তৈরি হয়েছে বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন মসজিদ। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এরই একটি ঢাকার অদূরে ফায়েদাবাদের বাইতুর রউফ মসজিদ। ২০১৬ সালে স্থাপত্যে আগা খান পুরস্কার ও ২০১৮ সালে স্থাপত্যের জামিল প্রাইজ বিজয়ী হওয়ায় বায়তুর রউফ মসজিদটি দেখা ও সেখানে নামাজ পড়ার আগ্রহ জন্মেছিল আগেই।

আর আবদুল্লাহপুরের জায়গাটা আগে থেকে চেনা বলে সরাসরি একদিন হাজির হয়ে যাই। সঙ্গী গুগল ম্যাপ তো আছেই। কিন্তু ফায়েদাবাদের কাছে এসে হোঁচট খেলাম। কারণ, ম্যাপে দেখানো পেট্রলপাম্পের টিকিটি পাওয়া গেল না। কাজেই শেষ মুহূর্তে স্থানীয় বাসিন্দাদের শরণাপন্ন হতে হলো। দিকনির্দেশনা এল, 'লাল মসজিদ? সামনে গিয়ে বাঁয়ে ঢুকে যাবেন'। সেই লক্ষ্মণ সেনের আমল থেকে বাঙালি অতিথিপরায়ণ। কাজেই মোড় ঘুরে একটু এগোতেই আমাদের চোখের সামনে উন্মোচিত হয়ে উঠল পুরস্কার বিজয়ী মসজিদটি।

বিজ্ঞাপন

মাইক্রোবাস থেকে নেমে এগোতে এগোতে খেয়াল করলাম, মূল রাস্তা থেকে যথেষ্ট ওপরে এর প্লিন্থ লেবেল। মসজিদের সামনে বেশখানিকটা জায়গা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অনেকটা কাছারির মতো। সেখানে বসার জায়গা আছে এবং কয়েকজন মুরব্বি সেখানে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। তবে আলো ফুরিয়ে আসছে দেখে দ্রুত মসজিদে ঢুকতে চাইলাম। আমাদের দেখে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন এক মুরব্বি। তিনি এ মসজিদের দেখভাল করেন। কেয়ারটেকার। বাড়ি সিরাজগঞ্জ। আমাদের মতো অতিথিরা হরদম আসেন বলে মনে হলো।

আসরের নামাজ পড়া প্রথম কাজ আমার আর কন্যা বিদুষীর। তাই ভেতরে ঢুকে আমি প্রথমে খুঁজে নিলাম অজু করার জায়গাটি। বেশ প্রশস্ত জায়গা। খেয়াল করলাম একটা ব্যতিক্রমী বিষয়; সচরাচর অজুর স্থানে আলাদা করে বসার জায়গা থাকে না। কিন্তু এখানে দেখলাম আছে। প্রথম দফায় মনে হতে পারে বসার জায়গাগুলো পরে স্ল্যাব বসিয়ে করা হয়েছে। কিন্তু মনোযোগ দিয়ে দেখলে বোঝা যায় সেটি নয়, এটি ডিজাইনের অংশ। অজু করে মসজিদের নামাজ ঘরে ঢুকলাম।

বিজ্ঞাপন

বিশাল হলরুম। প্রথমে চোখ গেল চারদিকে। না, মাঝখানে কোনো পিলার নেই। জিপিএইচ ইস্পাত আর প্রথম আলো মিলে একটা কাঠামো প্রকৌশলের কম্পিটিশন করেছি আমরা ইনজিনিয়াস নামে। সে কারণে স্ট্রাকচার প্রকৌশলী বন্ধু মাহবুব মোর্শেদের সঙ্গে আমার বেশ খাতির। তাঁর কাছ থেকে শুনেছি, এ রকম প্রশস্ত হলঘরের মাঝখানে যদি পিলার না দিতে হয়, তাহলে চারপাশের পিলারগুলোকে দশাসই হতে হয়। সে জন্য খালি ঘর দেখে দৃষ্টি ঘুরে এল চারপাশে। চারদিকে মোট আটটি কলাম। আকারে সত্যিই দশাসই। বুঝলাম সেগুলোর ওপরে আছে ছাদটা। আমরা যখন গিয়েছি, তখন পড়ন্তবেলা। তারপরও দেখলাম আলো আছে অনেকখানি। ছাদের দিকে তাকিয়ে আলো আসার কুঠুরিগুলো আবিষ্কার করলাম। কুঠুরির ওপরের অংশ কাচ দিয়ে আবৃত। ফলে আলো এলেও পানি আসতে পারে না।পানি আসতে না পারার কথা শুনে মন খারাপ হলো। শুনেছি, এখানে বর্ষার সময় পানি পড়ে। ভালোমতো খুঁজতে গিয়ে টের পেলাম এর অন্যরকম সৌন্দর্য। চারদিকে চারটি অর্ধবৃত্তাকার জায়গা আছে। সেখান দিয়ে বাদলের ধারা ঝরঝর করে পড়তে পারে। চমকে উঠেছি। কারণ, আধুনিক স্থাপত্য মানে শুধু আঁটসাঁট গাঁথুনি আর বাঁধাবাঁধি।

লুই আই কানের জাতীয় সংসদের বড় বড় খোলা স্পেস দেখেও চোখে দেখি না আমরা। চেষ্টা করি সবকিছু একটা বাক্সের মধ্যে ঢুকাতে। হয় ইট-সুরকি, না হলে নিদেনপক্ষে কাচ দিয়ে বন্ধ করে ফেলি আজকাল। ফল হয় মারাত্মক। কারণ, কাচের আবদ্ধ ঘর মানে গ্রিনহাউস। আলো-তাপ ঢুকতে পারে সহজে, কিন্তু ঘরের ভেতরে কিছুটা শোষিত হয়ে পাল্টে যায় এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য। আটকা পড়ে ঘরের মধ্যে। ঘর হয়ে ওঠে একটা গুদাম। এর ফলে শুধু গরম আর গরম। বাধ্য হয়ে কিনতে হয় টনের পর টন এসি। বুঝলাম গরমেও কেন আমাদের তেমন অস্বস্তি হচ্ছে না। কারণ, অর্ধবৃত্তাকার জায়গা নয়, একটি চারকোনা স্পেসও ফাঁকা আছে; তা দিয়ে বাতাস আর বৃষ্টি একসঙ্গে আসতে পারে। ওখানে থাকতে থাকতে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছি তা নয়। কিন্তু পরে মূল ডিজাইন দেখে বুঝলাম, একটি চারকোনা জায়গার মধ্যে নল ঢুকিয়ে দিলে যেমন হয়, তেমন একটি ব্যাপার এখানে আছে। বৃষ্টির দিনে পানি এসে পড়ে প্রবল বেগে। কোথা দিয়ে যায়? সরু নালা আছে। তবে নালাগুলো ঢেকে দেওয়া হয়েছে নুড়িপাথর দিয়ে। তাই নালা-নালা ভাবটা নেই। বৃষ্টির দিনে জোহর থেকে আসর ওয়াক্ত পর্যন্ত একদিন মসজিদে থাকার ইচ্ছে বেড়ে গেল।

ভেন্টিলেশনের ব্যাপারটা খুব মনোযোগ দিয়ে সামলানো হয়েছে। তবে মনোযোগ দেওয়া হয়েছে ম্যাটেরিয়ালেও। লাল মাটির ইটের মসজিদ (এ জন্য লোকে লাল মসজিদ বলে)। দেয়ালগুলো আস্তর করা হয়নি। ফলে রং করার বাহুল্য নেই। নিয়মিত পুরো মসজিদ ধুয়ে ফেললে হয়। তাই ময়লা খুব একটা জমতে পারে না। প্রতিবছর রঙের পেছনে যে খরচ হতো, সে তুলনায় ধোয়া কেবল সাশ্রয়ী নয়, বরং এলাকাবাসীকে মসজিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার চমৎকার উপায় বটে।

মেরিনা তাবাশ্যুমের একটি লেখায় পড়েছি, এ মসজিদের জমি তাঁর নানির দেওয়া। কেয়ারটেকারের কাছে জানতে চাইলাম মেরিনা তাবাশ্যুমের নানাবাড়ি কোথায়? আমাকে চমকে দিয়ে তিনি জানালেন, উনার নানা কখনোই এ এলাকায় থাকেননি। কিন্তু এখানে কিছু জমি ছিল। শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে এল মহীয়সী নারী সুফিয়া খাতুনের জন্য। এ আক্রার বাজারে ওই জমির ম্যালা দাম। আশপাশে অনেক হাইরাইজ বিল্ডিং সেটাই বলে। কিন্তু মেরিনা তাবাশ্যুমের নানি সুফিয়া খাতুন সেই পথে পা বাড়াননি। তিনি জমি দিয়েছেন এ অসম্ভব সুন্দর মসজিদ তৈরির জন্য। ফেরার সময় মুরব্বিদের আড্ডার জায়গায় একটু দাঁড়ালাম। মুরব্বিদের কথা শুনে বোঝা গেল, এলাকাবাসী কেমন করে এটি ধারণ করেন। সময় পেলে আপনিও একদিন বাইতুর রউফ মসজিদে নামাজ পড়তে যেতে পারেন।

ছবি: আর্কডেইলির সৌজন্যে

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৩, ২২: ৫৯
বিজ্ঞাপন