যে ৩ কৌশলে নিজেকে তৈরি করলে এআই কোনো দিন আপনার জায়গা নিতে পারবে না
শেয়ার করুন
ফলো করুন

অপরাজিতা নাম তার। মিষ্টি চেহারা, স্মিত হাসি আর কোমল মুখভঙ্গি দেখে বোঝার জো নেই যে সে রক্তমাংসের মানুষ নয়। আমাদের দেশে ব্যাপারটি নতুন হওয়ায় বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলের এআই সংবাদপাঠক এখন তুমুল আলোচনায়। আর এই আলোচনার অনেকটাই এআই মানুষের ভাত-কাপড় ধরে টান দেবে—এ আবর্তে ঘুরছে।যুগে যুগে প্রযুক্তির নানা উদ্ভাবন বিজ্ঞানের ফলিত রূপ হয়ে মানুষের কাজের ধারায় যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসছে। সেই আদিম যুগে ঘাড়ে-মাথায় করে পরিবহনের কষ্ট কমিয়েছে চাকা। আর তথ্যপ্রযুক্তির তেলেসমাতি দেখতে আর শুনতে বিস্ময়কর হলেও তা আসলে জাদু নয়, বরং প্রযুক্তিমাত্র। এখন আসা যাক এআইয়ের কথায়। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সংক্ষিপ্ত রূপ এই বহুল-চর্চিত এআই। একে জীবনের সব ক্ষেত্রে কাজে লাগিয়ে বাঁচানো যায় অনেকটা শ্রম ও সময়।

এআই টুলগুলো ক্ষেত্রবিশেষে একজন মানুষকে প্রতিস্থাপন করলেও তৈরি করবে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান। তবে তার জন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হবে, এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে দক্ষতা অর্জনের নতুন মাপকাঠিতে। এ সময়ে এসে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই টুল ও সহায়ক সফটওয়্যার ইত্যাদির ব্যাপারে জ্ঞান অর্জন করা, এগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার ও পরিচালনা করতে শেখার কোনো বিকল্প নেই। আর সেই সঙ্গে মেশিন করতে পারে না এমন কাজে নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, মেশিন হোক বা এআই টুলস—সবই আমাদের কাজে গতি আনতে পারে, সহজ করতে পারে।

বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসা-মনস্তত্ত্ব নিয়ে করা বিশেষজ্ঞরা মানুষের কাজের কার্যদক্ষতা কীভাবে বাড়ানো যায়, সে নিয়ে প্রচুর গবেষণা করে থাকেন। আর এসব গবেষণা বলে, তিনটি অত্যন্ত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দক্ষতা শুধু মানুষের পক্ষেই অর্জন করা সম্ভব, যেগুলো এআই দিয়ে করানো যাবে না। আর বুদ্ধিমান হলে তিনটি ক্ষেত্রে নিজেকে তুখোড় করে গড়ে তুলতে হবে অদূর ভবিষ্যতে এআইয়ের সঙ্গে তাল মেলাতে।

বিজ্ঞাপন

যে এআই টুলস নিয়ে এত কথা, সেগুলোও সেই মানবসৃষ্ট। মানুষ স্বভাবতই কৌতূহলী। কিন্তু সবকিছুতে এখন এআই আর তথ্যপ্রযুক্তি এমনভাবে ছেয়ে গেছে যে আমাদের মন ও বুদ্ধি একঘেয়ে, নতুনত্ববিহীন, পক্ষপাতদুষ্ট আর সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। গুগল আর চ্যাটজিপিটি বললেই হয়ে গেল! সাজেশনে যেভাবে রিলস আর রিকমেন্ডেশন আসছে, সেভাবেই দেখতে থাকি। স্ট্রিমিং বা ভিডিও সাইট হোক, আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম—এআই অ্যালগরিদমের দাসত্ব করা যাবে না এভাবে। খেয়াল রাখতে হবে, যেন আমাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আর নিজের মনোসংযোগের চাবিকাঠি নিজের হাতে থাকে। এসব বিষয় যেন নষ্ট না হয়ে যায়। কৌতূহল আর সৃষ্টিশীলতায় মানুষকে কখনো ছাড়াতে পারবে না যন্ত্র বা এআই।

শুধু আইটি–পেশাজীবী নয়, তৈরি হতে হবে সবাইকে

আইটি বা তথ্যপ্রযুক্তি আর টেকনোলজি নিয়ে কাজ করলেই যে কেবল এআই নিয়ে ভাবতে হবে, তা নয়। এখন দিনই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার। এতে সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন সৃষ্টিশীল পেশার মানুষেরা। এই যে চ্যাটজিপিটি মার্কেটিং কপি থেকে শুরু করে রচনা, কবিতা লিখতে পারে, দিতে পারে নানা পরামর্শ। মিডজার্নি এঁকে দিচ্ছে এআই ইমেজ। এগুলো এখন বাস্তবতা।তবে পুরো ব্যাপারটিকে ভয় পেয়ে আসলে কোনো লাভ নেই। বরং নিজের কৌতূহল আর নতুন কিছু শেখার অদম্য আকাঙ্ক্ষাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। আর এই কৌতূহল এমন এক জিনিস, যা কখনো কোনো যান্ত্রিক সত্তা ধারণ করতে পারবে না৷ মাথা খাটিয়ে এসব এআই টুল ব্যবহার করার নতুন নতুন বুদ্ধি বের করতে হবে। এতে এআই কারও চাকরি কেড়ে না নিয়ে; বরং তাঁর কাজটাই তাঁকে আরও দক্ষতা ও দ্রুততার সঙ্গে করতে সাহায্য করবে। আর এ জন্য তৈরি হতে হবে বিশেষ তিনটি ক্ষেত্র ধরে।

বিজ্ঞাপন

১. নতুন টুলগুলোকে ভালোভাবে জানা, প্রশ্ন করা আর সৃজনশীল মনকে জাগিয়ে রাখা

একটা তালিকা করা যাক। যেখানে আপনি যেসব কাজ করতে কোনো ধরনের সাহায্য প্রয়োজন বলে মনে করেন, সেগুলো লিখে নিন। কিছু কাজ থাকে একেবারেই নিত্যকার, এগুলোয় সেভাবে মাথা খাটানোর কিছু নেই, সৃজনশীলতার প্রয়োগেরও সুযোগ নেই—ঠিক এসব কাজই এআইয়ের ওপর ছেড়ে দেওয়া যায়। ওপেন এআই ব্যবহার করে ফ্রি অ্যাকাউন্ট খুলে বিভিন্ন নিরীক্ষা চালানো যেতে পারে। বিভিন্ন কাজ দিয়ে দেখলে, এআই টুলস নিয়ে একটু খেলা করলেই বোঝা যাবে, নির্ভুল না হলেও এআই প্রায়ই নতুন নতুন উপায় খোঁজে একই সমস্যা সমাধান করতে। আবার আপনি জানেন না, এমন বিষয়ে আপনার কাজ করে দিতে পারে এআই। পুনরাবৃত্তি ধরনের ডিজাইন এআই করে দিয়ে আপনার সময় বাঁচাতে পারে। আর সেই বেঁচে যাওয়া সময় আর খরচ না হওয়া মানসিক স্ট্যামিনা আপনি তখন ব্যবহার করতে পারেন কৌশল নির্ধারণ, পরিকল্পনা, সম্পর্ক তৈরির জন্য।

২. এআইয়ের বানানো রুটিনে নিজেকে বন্দী করে ফেলা যাবে না

আমার জন্য এআই, এআইয়ের জন্য আমি নই—কথাটি গেথে ফেলতে হবে মনে। এআইয়ের বাঁধা ছকে নিজেকে বন্দী করে ফেলা যাবে না। চ্যাটজিপিটির মতো সফটওয়্যারগুলো আসলে ফাস্টফুডের মতো। সাময়িক আরাম আর সন্তুষ্টি দিলেও এর নেশায় পড়লে বিপদ। এমন যদি হয়, আপনি এই টুল ছাড়া কোনো কাজই করতে পারছেন না, তবে বলতে হবে আপনি ফাঁদে পড়েছেন। আর এই আলস্য বা মাথা খাটানোর কাজে বিমুখ হয়ে শুধু অটোমেটেড সমাধানে একবার আসক্ত হয়ে গেলে সহজে পিছু ফেরা যায় না। একঘেয়ে, নৈমিত্তিক কাজের রুটিনে নিজের উৎসাহ-উদ্দীপনা আর কৌতূহল জাগিয়ে রাখা এত সহজ নয়। একটু অন্যভাবে ভাবা যায় বিষয়টা। এআই টুলগুলোকে নিয়ামক হিসেবে ব্যবহার করতে হবে, যা আমাদের নিজস্ব কল্পনাশক্তি, কৌতূহল আর সৃজনশীলতা জাগিয়ে তুলবে। আর তার জন্য প্রথমেই যা করতে হবে, তা হলো মাঝেমধ্যে ইচ্ছা করেই এআই টুলস ব্যবহার থেকে বিরত থাকা। সশরীর বিভিন্ন জায়গায় হাজির হতে হবে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে। নিজের যেসব শখের কাজের সঙ্গে ডিভাইস বা আইটির কোনো যোগসূত্র নেই, সেগুলোতে খেয়াল করে নিজেকে নিয়োজিত করা। হতে পারে তা রংতুলিতে ছবি আঁকা বা একেবারে খাতা-কলম হাতে কবিতা লেখা। একা একা প্রকৃতির মধ্যে বা অদেখা কোনো জনপদে ঘুরে বেড়ানো। প্রযুক্তি থেকে এ রকম কিছু বিরতি নিলে কাজে ফিরে নিজেকে অনেক আত্মবিশ্বাসী মনে হবে।

৩. এআই যা বলে, তা–ই যেন শেষ কথা না হয়

আজকাল প্রায়ই শর্টকাটে গুগল ট্রান্সলেটর বা চ্যাটজিপিটি দিয়ে করা কাজ ধরা পড়ে গিয়ে পেশাগত জীবনে অপমান এমনকি শাস্তির সম্মুখীন হতে হচ্ছে দেশে-বিদেশে অনেককেই। এআই এযাবৎ সংগ্রহ করা বা অবহিত করা তথ্যের ওপর নির্ভর করেই নিজের যুক্তি বা লজিক খাটিয়ে সমাধান দেয়, তার বাইরে কিছু করতে পারে না। এআই টুলস আমাদের তাই দেখায় বা রেকমেন্ড করে, যা আমাদের জন্য সুবিধাজনক আর যা আমরা দেখতে চাই। একে কনফার্মেশন বায়াস বলা হয়। এটি আপনাকে স্থবির করে ফেলতে পারে আর অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে ভোগাতে পারে। তাই এআইয়ের তৈরি করা কনটেন্ট বা সাজেশন পরখ করে দেখা উচিত বা যুক্তি দিয়ে ভেবে দেখা উচিত। এই যেমন সংবাদ পড়ার সময় ছবি বা লেখা আসতে দেরি হলে, যান্ত্রিক ত্রুটি হলে বা উদ্ভূত যেকোনো পরিস্থিতি এআই সংবাদপাঠকের সামাল দেওয়ার ক্ষমতা নেই। তাই অন্ধভাবে এআই টুলসের ওপর নির্ভরতা একেবারেই বোকামির শামিল। বরং নিজের দক্ষতা আর সবচেয়ে শক্তিশালী সক্ষমতার জায়গাটি চিনে নিয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এআইয়ের ব্যবহার ও প্রয়োগে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হবে সবাইকে। আর অবশ্যই তা নির্ভয়ে।

লেখক: প্রকৌশলী

তথ্যসূত্র: হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ

ছবি: পেকজেলসডটকম

প্রকাশ: ২২ জুলাই ২০২৩, ১১: ৩৪
বিজ্ঞাপন